বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
টড ফিলিপসের হাত ধরে সেলুলয়েডে ‘ব্যাটম্যান ব্যাডি’ জোকার। ডি সি স্ট্যান্ড অ্যালোন সিরিজের প্রথম ছবি। এই প্রথম শুধু জোকারকে নিয়ে এক আদ্যোপান্ত গল্প বুনেছেন টড ফিলিপস আর স্কট সিলভার।
ছবির শুরুতে ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’-এর রেট্রো লোগো দেখলেই এই ছবির সময়কাল বুঝতে বাকি থাকে না কারও। আটের দশকের গথাম শহর। ময়লাকুড়ুনিরা ধর্মঘট ডেকেছে। সারা শহরে ময়লার স্তূপ। ধেড়ে ইঁদুরের আনাগোনা। এমনই হাল যে থমাস ওয়েন (গথামের সম্ভাব্য মেয়র) পারলে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা খুঁজে ধরে আনবেন। শহর জুড়ে এই আবর্জনার স্তূপ যতটা আক্ষরিক ততটাই রূপক। যে শহর জুড়ে ইমার্জেন্সি, যেখানে মানুষ দিনরাত চাকরির জন্য হন্যে সেই শহরে আর্থার ফ্লেক (জোয়াকিন ফিনিক্স) এক পার্টি ক্লাউন। মানুষের দুঃখকে সাময়িক দূর করতে যার চেষ্টা সেই ক্লাউনের মুখে হাসি কিন্তু চোখ দুটো বিষাদে ভরপুর।
এ ছবি ফ্লেকের সাধারণ মানুষ থেকে গথামের ক্লাউন প্রিন্স হয়ে ওঠার গল্প বলে। যে গল্পের পরতে পরতে বিষাদ। যে গল্পের পরতে পরতে মাখানো ফ্লেকের আর্তনাদ মেশানো হাসি, যা কানে বাজে। এ হাসি প্রাণখোলা হাসি নয়। এ হাসি হৃদয় নিংড়ানো দুঃখের হাসি। ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যে হাসির রেশ থেকে যায় সারা শরীর হিম করা এক শিরশিরানি অনুভূতির মতো। সাত রকমের ওষুধ খেয়েও আর্থার যখন বলে ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ফিল ব্যাড এনিমোর’ তখন তার আর্তিতে এই অভিব্যক্তি স্পষ্ট যে সমাজ থেকে ভালো থাকার আর কোন রসদই খুঁজে পাচ্ছে না সে। টড ফিলিপসের পরিচালনায় ‘জোকার’ দেখতে দেখতে একটা কথাই মনে পড়বে বারবার – ‘অল ইট টেকস ইজ ওয়ান ব্যাড ডে টু রিডিউস দ্য সেনেস্ট ম্যান অ্যালাইভ টু লুন্যাসি।’
আটের দশকের ভিন্টেজ গথাম যেন মার্টিন স্করসিসির ছবি থেকে উঠে আসা কোনও দৃশ্য। এ ছবি দেখে বোঝা যায় যে, স্করসিসির ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ কতটা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে পরিচালককে। আর এই ভিন্টেজ গথামের বুকে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে প্রতিনিয়ত বিষাদে তলিয়ে যাওয়া ফ্লেকের গল্প জোয়াকিনের ছোঁয়ায় এক আশ্চর্য মানবিকতার গল্প হয়ে উঠতে থাকে। এত দুঃখের মধ্যে দাঁড়িয়েও সে হাসে। হাসতেই থাকে। চাকরি চলে যাওয়ার পর দেওয়ালে লেখা ‘নেভার ফরগেট টু লাফ’ এর ফরগেট টু অংশটুকু কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিতে দিতে সে হাসে। ট্রেনে তিন পুরুষ যখন এক মহিলাকে উত্যক্ত করে, তখনও সে হাসে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শককে জোক বলার আগেই জোরে জোরে চিৎকার করে হাসতে থাকে জোকার। একাই হাসে সে। আর কেউ হাসে না। পরিচালক এই গল্পে আর্থারকে এক আজব অসুখ দিয়েছেন। ‘প্যাথলজিক্যাল লাফটার’। সে এক দম বন্ধ হয়ে আসা হাসি। আর্ত চিৎকার মেশানো হাসি।
এই ‘জোকার’এর সঙ্গে হিথ লেজার অভিনীত জোকারের কোনও তুলনা চলে না। বরং জ্যাক নিকলসনের জোকারের চরিত্রায়নের সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া যায়। সিনেমা জগতে জোয়াকিন ফিনিক্সের মাস্টারপিস অভিনয় হয়ে থেকে যাবে এই ফ্লেক থেকে জোকার হয়ে ওঠার গল্প। ফ্লেকের অসহায়তা থেকে ক্লাউন প্রিন্স হয়ে ওঠার কনফিডেন্স জোয়াকিনের প্রতিটি শারীরিক ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে পরিষ্কার।
এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য প্রায় ২৫ কেজি ওজন কমিয়েছেন তিনি। খালি গায়ে পাঁজরের হাড় স্পষ্ট। চোখে বিষাদ, দম বন্ধ করা হাসি, হঠাৎ নাচের ভঙ্গিমা আর সবকিছু ছাপিয়ে সেই সিগনেচার জোকার ওয়াক—প্রতি দৃশ্যে তিনি বুঝিয়ে দেবেন যে এ ছবি তাঁকে ছাড়া প্রায় অসম্ভব ছিল। জোয়াকিন ছাড়া এই ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে হিলদুর গুয়ানাদতিরের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, যার রেশ হল থেকে বেরিয়েও থেকে যাবে।
টক শো হোস্ট মারে ফ্র্যাঙ্কলিনের চরিত্রে রবার্ট ডি নিরোকে যথাযথ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। এমনকী, আর্থারের মা পেনি ফ্লেকের চরিত্রে ফ্রান্সেস কনরয়কেও ভালো লাগবে। লরেন্স শেরের সিনেমাটোগ্রাফি ও জেফ গ্রথের সম্পাদনা ছবিকে যোগ্য সঙ্গত করেছে।
এই ছবি বিষন্নতার প্রতীক। তাই ছবির নামও প্রতীকী। ‘দ্য রিচ আর টেরিবল অ্যান্ড দ্য পুওর আর মিজারেবল’ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা কোথাও কোথাও। আর তাই এই সামাজিক, মানসিক উত্তাল সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি শুধু সিনেম্যাটিক ভিশনে আটকে থাকে না। ছবির টাইমিং হয়ে ওঠে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ।
টড ফিলিপসের জোকার এক মানসিক অবস্থানের গল্প বলে। এমন এক অবস্থানের কথা বলে যা আপাতভাবে মানসিক ভ্রম মনে হলেও চকচকে মোড়কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কঠিন বাস্তব। ছবিতে ফিলিপস তাঁর জোকারের চরিত্রকে বিচার করার চেষ্টা করেননি। বরং তাকে সহানুভূতির চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন। আবার সহানুভূতির চোখে দেখতে গিয়ে তাকে আইডলাইজও করে ফেলেননি। আর সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এই ছবিতে জোকারের যে পোর্ট্রেট আঁকতে চেষ্টা করেছেন সেটাই দেখার। সেখানেই এই ছবির ম্যাজিক লুকিয়ে।
দেবত্রী ঘোষ