সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ডাইনিং টেবিলে বসে সঞ্জয় গান্ধী মাকে বললেন, ‘সাউথ ইন্ডিয়ায় একটা সিনেমার পোস্টারে কী লেখা হয়েছে জানো?’ ইন্দিরা গান্ধী পেপার পড়ছিলেন। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। সঞ্জয় বললেন,‘একটা নতুন হিন্দি সিনেমার পোস্টারে লেখা হয়েছে, ‘এই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীকে দেখুন স্ক্রিনে!’ তোমার কোনও অটোবায়োগ্রাফি হচ্ছে নাকি? ইন্দিরা মাথা নাড়লেন। সেদিন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আই কে গুজরালকে ডাকলেন ইন্দিরা। আপনি কী এই ছবির কথা শুনেছেন? গুজরাল জানেন। বললেন, হ্যাঁ। সেরকম তো কোনও বিতর্ক নেই। তাই সেন্সর অনুমোদন দিয়েছে। তবু আপনি বললে একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং করতে পারি। আর একবার দেখা যেতে পারে। ইন্দিরার থেকে সম্মতি পেয়ে গুজরাল দিল্লির মহাদেব রোডে ফিল্ম ডিভিশনের স্ক্রিনে আবার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। ছবির নাম ‘আঁধি’। পরিচালক গুলজার। ইন্দিরা নিজের পার্সোনাল দু’জন স্টাফ মেম্বারকেও গোপনে পাঠালেন দেখতে। তাঁরা খবর দিল, না ম্যাডাম। সেরকম কিছু নেই। ‘আঁধি’ রিলিজ হয়ে গেল। কিন্তু সুচিত্রা সেনকে দেখে ভারতজুড়ে জল্পনা চলতেই থাকল যে, ছবির আরতি আসলে ইন্দিরা গান্ধী। প্রধান কারণ ওই এক্সক্লুসিভ হেয়ার স্টাইল। গুজরাতে বিধানসভা ভোট। হঠাৎ গুজরাত কংগ্রেসের থেকে আপত্তি উঠল। কারণ কী? কারণ ছবিতে দেখানো হচ্ছে সুচিত্রা সেন ড্রিংক করছেন এবং সিগারেট খাচ্ছেন। এমনিতেই গোটা দেশে চর্চা যে ছবিটা আসলে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়েই তৈরি। আশঙ্কা হল ভোটে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। সুতরাং রিলিজের ২০ সপ্তাহ পর ব্যান করে দেওয়া হল ‘আঁধি’। পরে আবার সেটি মুক্তি পায় কয়েকটি দৃশ্য বাদ দিয়ে ও একটি দৃশ্য যুক্ত করে। প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে বই লেখা আর সিনেমা তৈরির প্রবণতায় নবতম সংযোজন ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। সঞ্জয় বারু নানাবিধ সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ তিনি প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংয়ের মিডিয়া অ্যাডভাইসর হিসাবে কাজ করেন। ৭ নং রেস কোর্স রোড এবং সাউথ ব্লক। ভারতের এই সর্বোচ্চ পাওয়ার করিডরে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া অ্যাডভাইসর হওয়ার সুবাদে সঞ্জয় বারু চার বছর ধরে মনমোহন সিংয়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গতিপ্রকৃতি খুব কাছ থেকে লক্ষ করেছেন তা বলাই বাহুল্য। এরপরই তিনি বইটি লেখেন। সেই বইয়ের কাহিনী অবলম্বেনেই এই ছবি। ট্রেলার রিলিজ হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক তুঙ্গে। কারণ আড়াই মিনিটের ট্রেলারে স্পষ্ট যে সোনিয়া গান্ধী বনাম মনমোহন সিং ইগোর লড়াই এবং মনমোহনের আত্মসম্মানে ক্রমাগত আঘাত লাগাই এই ছবির ভরকেন্দ্র। তাছাড়াও বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে বিজেপি নিজেদের অফিশিয়াল ট্যুইটার থেকেই এই ট্রেলার প্রোমোট করে দেওয়ায়। যা দেখে কংগ্রেস পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়ে জানিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে, এটা বিজেপির হয়ে প্রচারের একটি ফিল্ম। এই ছবির প্রযোজক কে? রত্নাকর গুট্টে। কে তিনি? মহারাষ্ট্রের সুগার ব্যারন এক বিজনেসম্যান। ২০১৪ সালে যিনি বিজেপির শরিক রাষ্ট্রীয় সমাজ পক্ষ নামক দলের হয়ে নির্বাচনে লড়াই করেন। পরিচালক কে? ওই রত্মাকর গুট্টেরই পুত্র বিজয় গুট্টে। প্রধান চরিত্রে কে? অনুপম খের। যাঁর স্ত্রী বিজেপির এমপি। সুতরাং প্রত্যাশিতভাবেই রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
ছবি ঘিরে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। কিন্তু দিনের শেষে দর্শক দেখতে চান ছবিটির মেকিং কেমন? শুধুই কি প্রোপাগান্ডা? নাকি সত্যিই সিনেম্যাটিক ভ্যালু রয়েছে? এই ছবিতে যা যা দেখানো হয়েছে সব কি সত্যি? স্বয়ং লেখক সঞ্জয় বারু বইটির ভূমিকাতেই লিখেছিলেন, এই বইয়ের সবকিছু আমার সামনে ঘটেছে তা নয়। মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধী রুদ্ধদ্বার কক্ষের বৈঠকে কী কী কথা বলেছেন সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, কিছু শোনা ঘটনা আর কিছু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেও লিখতে হয়েছে। ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ নিয়ে সবথেকে বেশি আগ্রহের ব্যাপার যেটি, সেটি হল অনেক গোপন সত্য নাকি জানা যাবে! কোনও ছদ্মনামের আড়াল নেই। সরাসরি ছবিতে এসেছেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, প্রণব মুখোপাধ্যায়রা। এই ছবির ট্রেলারের শুরুতেই বলা হয়েছে প্রাচীন মহাভারতে দুটি পরিবার ছিল। আর আজকের মহাভারতে একটাই পরিবার। অর্থাৎ গান্ধী পরিবার। সোনিয়া রাহুলের কিছুটা খুশি হওয়ার কথা যে আজও ভারতে এই পদবি আর পরিবার সেলেবল কমোডিটি! তাই বই হয়, সিনেমা হয়! এখন দেখা যাক, ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ সিনেমা হয়ে ওঠে? নাকি ডকুমেন্টারি? তথ্যনিষ্ঠ? নাকি শুধুই প্রোপাগান্ডা?
সমৃদ্ধ দত্ত