বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
রাজ্য-রাজনীতির চার পক্ষ—তৃণমূল, বিজেপি, বাম এবং কংগ্রেসের মধ্যে নানা কারণেই তৃণমূলের ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে রাজ্য তো বটেই, সারা দেশেই যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। বলা যায় ১৯ জানুয়ারি সারা দেশের রাজনৈতিক মহলের চোখ থাকবে ব্রিগেডের সমাবেশের দিকে। এই আগ্রহের পেছনে মূল কারণগুলি হল—
ক) বিমুদ্রাকরণের সময় থেকে তৃণমূল নেত্রী সারা দেশেই মোদি-বিরোধী অন্যতম মুখ হিসাবে উঠে এসেছেন। সুতরাং, মোদির বিরোধিতায় লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী রাজনৈতিক বক্তব্য এই সমাবেশ থেকে উঠে আসে তা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও যথেষ্ট আগ্রহ থাকবে।
খ) ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশকে তৃণমূল নেত্রী সর্বভারতীয় বিজেপি-বিরোধী মঞ্চ হিসাবে তুলে ধরতে চাইছেন। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিজেপি-বিরোধী সমস্ত দলকে। ১৯ তারিখের ব্রিগেডে কোন কোন বিরোধী দলনেতা মমতার ডাকে সাড়া দেন সেই দিকে শাসক-বিরোধী সমস্ত নেতৃত্বের নজর থাকবে।
গ) বিজেপি শিবিরে একাধিক নেতা নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন যশোবন্ত সিন্হা, শত্রুঘ্ন সিন্হা, অরুণ শৌরি এবং রাম জেঠমালানি। মমতা শেষ পর্যন্ত বিজেপির চার বিক্ষুব্ধ নেতাকে ব্রিগেড সমাবেশে হাজির করতে পারেন কি না সেই বিষয়েও রাজনৈতিক মহলের আগ্রহ রয়েছে।
ঘ) মমতার ব্রিগেড সমাবেশে বিজেপি-বিরোধী জোটের প্রকৃতি নিয়েও যথেষ্ট আগ্রহ থাকবে। রাহুল গান্ধী হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপিকে পরাজিত করবার পর ডিএমকে সমেত বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনের পক্ষে। অন্যদিকে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা ফেডারেল ফ্রন্টের পক্ষে। মায়াবতী, নবীন পট্টনায়করা আবার এখনই কোনও শিবিরে যেতে চাইছেন না। ব্রিগেড থেকে মোদি-বিরোধী জোটের কোনও চেহারা বের হয় কি না সেই বিষয়েও নজর থাকবে।
ঙ) কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার প্রশ্নে ব্রিগেড সমাবেশ থেকে মমতা নতুন কিছু কর্মসূচি বা ভাবনার কথা জনতার কাছে পেশ করেন কি না সেই বিষয়েও সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকবে। মোদির সরকার পরিচালনা নিয়েও যথেষ্ট সোচ্চার মমতা। অতএব মমতার ঝুলিতে সরকার পরিচালনায় নতুন কোনও ভাবনা রয়েছে কি না সেই বিষয়েও জল্পনা থাকবে।
মমতার ডাকা ব্রিগেড সমাবেশের তুলনায় বিজেপির ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ হবে এককভাবে রাজ্য বিজেপির উদ্যোগে। মমতার ডাকা ব্রিগেডের মতো সেই সমাবেশের সর্বভারতীয় চরিত্র থাকার সম্ভাবনা নেই। কেবলমাত্র মোদি-কেন্দ্রিক সমাবেশ। অন্যদিকে, ব্রিগেডে সমাবেশ করে বামেদের লক্ষ্য থাকবে রাজ্য-রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে রাখা। ওই সমাবেশ তৃণমূলের মতো না-হলেও বাম নেতৃত্ব চাইছেন মোদি-মমতা বিরোধী সমাবেশ হিসাবে সর্বভারতীয় চেহারা দেবার। কংগ্রেসও চাইবে রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখে পূর্ব ভারতে মোদি-বিরোধী সর্বভারতীয় সমাবেশ ব্রিগেডে আয়োজন করতে। ততদিনে নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে এই রাজ্যে যদি আসন সমঝোতা হয়ে যায়, তবে কংগ্রেসের ডাকা ব্রিগেডও বিরোধীদের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আয়োজিত ব্রিগেডের পর মূল প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসবে, কোন দলের ব্রিগেড সমাবেশে কত মানুষের ভিড় হয়েছিল? সাধারণত শাসক দলই এই ক্ষেত্রে অ্যাডভান্টেজ অবস্থায় থাকে। তৃণমূলের আজ সারা রাজ্যে যে ধরনের সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে তাতে কেবলমাত্র উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকেই লোক এনে মাঠ ভরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে, যেমনভাবে একসময় সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তী কেবলমাত্র উত্তর ২৪ পরগনা থেকেই লোক এনে ব্রিগেড ভরে দেবার দাবি করতেন। প্রশাসন হাতে থাকলে বাস, লরি পেতে যেমন সুবিধে, তেমনি সরকারের উপভোক্তাদের সহজেই দলীয় সমাবেশে হাজির করা যায়। সেই তুলনায় বিরোধীদের ক্ষেত্রে ব্রিগেড ততটা সহজ নয়। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন একাধিকবার ব্রিগেডে ঐতিহাসিক জনসমাবেশে করেছিলেন। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে মমতার ডাকে ব্রিগেড ছিল আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। ওই সমাবেশে তিনি বামফ্রন্টের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে বাম-বিরোধিতাকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে ব্রিগেড ভরলেই যে ভোটের বাক্স ভরবে তেমন নিশ্চয়তা নেই। বাংলায় বুথ যার ভোট তার। বুথস্তরে এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া এই রাজ্যে বিজেপি-সিপিএম বা কংগ্রেস কোনও দলেরই মজবুত সংগঠন নেই। ফলের ব্রিগেড ভরালেও ভোটের বাক্স ভরবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। যদিও লোকসভা নির্বাচনের আগে শক্তি প্রদর্শন করে কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের কাছে বার্তা দেওয়ার সুযোগ কোনও দলই হাতছাড়া করতে চায় না।
১৯ জানুয়ারি তৃণমূলের ব্রিগেড সভার তুলনা টানা চলবে দুইদিক থেকে: (এক) ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে ৩০ জানুয়ারি, ২০১৪-য় যে ব্রিগেড জনসভা হয়েছিল এবং (দুই) বিভিন্ন সময়ে দিল্লির রামলীলা ময়দানে কিংবা বিহারের পাটনায় বিরোধী নেতাদের নিয়ে যে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়।
২০১৪-র ৩০ জানুয়ারি ব্রিগেডে বিপুল জনসমাবেশ দেখে সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইন্দিরা-মুজিবর রহমানের জনসভার তুলনা করেছিলেন। তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ—২০১৪ ভিড়ের রেকর্ডকে অতিক্রম করা। অতীতের রামলীলা ময়দানের বা পাটনায় বিরোধী নেতাদের ডাকা সমাবেশগুলির সঙ্গে মমতার ডাকা এই ব্রিগেড সমাবেশেরও কিন্তু একটা তুলনা আসবে। এখানেই আঞ্চলিক নেতা হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য।
এই সমস্ত বিষয় ছেড়ে ১৯ জানুয়ারি মমতার ব্রিগেডের মূল চর্চার বিষয় কিন্তু মোদি-বিরোধী জোটের অভিমুখ এই সভা থেকে পাওয়া যাবে কি না। সেই বিষয়ে উত্তরে কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লা থেকে দক্ষিণে চন্দ্রবাবু নাইডু, পূর্বে লালুপ্রসাদের পুত্র তেজস্বী যাদব থেকে পশ্চিমে দলিত নেতা জিগনেশ-অল্পেশ-হার্দিকরা, বা উত্তর-ভারত থেকে অখিলেশ-অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা থাকবেন। কিন্তু মমতার ব্রিগেডে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী আসবেন কি? রাহুল এলে ফেডারেল ফ্রন্টের সঙ্গে কংগ্রেসকে কীভাবে মেলাবেন? না কি মমতা কংগ্রেস বা ইউপিএ-র সমান্তরালভাবে ফেডারেল ফ্রন্টকে মোদির বিরুদ্ধে পরিচালনা করবেন?
মমতার ব্রিগেড থেকে এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। তবে, মোদির বিরুদ্ধে একাধিক ফ্রন্ট তৈরি করলে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিজেপির লাভের সম্ভাবনা থাকছে। বহু মানুষ বিজেপিকে চায় না যেমন সত্য, তেমনি ১৯৮৯ বা ১৯৯৬-এর মতো কেন্দ্রে অস্থির সরকার গঠিত হোক সেটারও বিরুদ্ধে মানুষ। বিজেপি-বিরোধী দলগুলি যদি একাধিক ফ্রন্টে বিভক্ত থাকে তবে ১৯৮৯ বা ১৯৯৬-এর অভিজ্ঞতা ভোটারদের শুনিয়ে মোদি আবারও দিল্লির মসনদে বসবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়?