বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হাজারো প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দেশের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতি মুহূর্তে খাটো করার, ছোট করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। অনেক লবি সক্রিয় হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বাঙালির জাত্যভিমান কোনওদিনই তেমন প্রকট, প্রবল নয়। তবু সৌরভ কিন্তু হার মানেননি। বুক চিতিয়ে দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বেহালার হার-না-মানা ছেলেটা। লর্ডসে জামা উড়িয়ে তাঁর সেই জয়োচ্ছ্বাস আজও প্রতিটি বাঙালির স্মৃতিতে ভাস্বর। এমনভাবেই সঙ্গীতে, বিজ্ঞানে, সমাজের অন্ধকার মুছে দেওয়ার কাজে বাঙালি কখনও পিছিয়ে থাকেনি। বিনয় বাদল দীনেশ থেকে ক্ষুদিরাম, কাকে ছেড়ে কার নাম করব! স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলি থেকেই বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের এই ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা। কিন্তু তবু গত প্রায় ৭০ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ইতিহাসে বাঙালির প্রাপ্তি বলতে সামান্যই। তেমন কিছুই মেলেনি। মাঝে ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু, তাঁর দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি ভোটাভুটিতে প্রয়োজনীয় সম্মতি না-দেওয়ায় কিংবা বলা ভালো, দলের একটি অংশ পিছন থেকে ছুরি মারায় সে-যাত্রায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয় জ্যোতিবাবুর। যে কলঙ্ক আজ আর শুধু একটা রাজনৈতিক দলের নয়, গোটা বাঙালি জাতির। লাল পার্টির সেই ঐতিহাসিক ভুলের দায় সমগ্র বাঙালি জাতির। যে জনগোষ্ঠীর জাত্যভিমান নেই, খালি পিছন থেকে টেনে ধরা, কাঠি করা স্বভাব, তার প্রাপ্তির ভাণ্ডার সবসময় শূন্যই থাকে। জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না-হতে দেওয়ার সেই কলঙ্ক থেকে সহজে আমাদের মুক্তি মিলবে না। এরপর আর কোনও বাঙালির সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসেনি। অতর্কিতে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর প্রাণ হারানোর পর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে ’৮৪ সালেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ছিল। বিশেষ একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসি শাসনে নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সেও বাঙালি জাতির এক দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস। সেই গোটা অধ্যায় যথেষ্ট বিতর্কিতও বটে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ অর্থমন্ত্রী থেকে তাঁর পাঁচ দশকের বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্বে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির জয়মুকুট প্রণববাবুর মাথায় উঠলেও, বলতে দ্বিধা নেই, একজন অত্যন্ত সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই আমরা তাঁকে দেখতে চেয়েছিলাম। দেশের এক নম্বর নীতিনির্ধারকের আসনে তাঁর অভিষেক হওয়া উচিত ছিল। অনেকের চেয়ে বেশি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে প্রণববাবুকে আমরা রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেলেও এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের প্রধানমন্ত্রী না-হওয়া বাঙালির হাজারো না-পাওয়ার হতাশা ও বঞ্চনার পরিচয়কেই বহন করছে। দেশের সংসদীয় ইতিহাসে প্রণববাবুর মতো এমন যোগ্য ব্যাক্তিত্ব ক’জন এসেছেন? বাঙালির সেই আক্ষেপ, সেই দীর্ঘশ্বাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ২০১৯-এ বাস্তবায়িত হবে কি না, তা কোটি টাকার প্রশ্ন। তবু আশায় বুক বাঁধতে অসুবিধা কোথায়?
আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হচ্ছে মোদিজির বহুচর্চিত আচ্ছে দিন কি দেশের আম জনতা দেখতে পেয়েছে? ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা কি ঢুকেছে—নাকি প্রয়াত বাজপেয়িজির আমলের শাইনিং ইন্ডিয়ার মতো এবারও নোটবন্দি, জিএসটি এবং দুর্বল কৃষি নীতিতে বিপন্ন দেশবাসী শাসক দলের রথ উল্টে দেবে? এমনিতে দেশের মানুষ যে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের উপর খুব একটা খুশি নন, তা সদ্যসমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনী ফলাফলেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থান—তিন বৃহৎ রাজ্যেই শাসক বিজেপি ক্ষমতা হারিয়েছে। সেইসঙ্গে মিজোরাম ও তেলেঙ্গানাতেও দাঁত ফোটাতে তারা ব্যর্থ। সর্বত্রই খেটে-খাওয়া গরিব মানুষের আস্থা হারিয়েছে মোদির সরকার। কংগ্রেস দীর্ঘ ব্যর্থতার পর কিছুটা সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মাত্র ৪৪টি আসন জেতার কলঙ্ক ঢেকে শেষ পর্যন্ত সোনিয়া-রাহুলের দল দেড়শো আসন পেরতে পারবে কি না, তা বড় প্রশ্ন। আর কংগ্রেস, বিজেপিকে বাদ দিয়ে তৃতীয় বৃহত্তম দল হওয়ার দৌড়ে আছে বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষ-এর দল তৃণমূল কংগ্রেস। যদি শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের সরকার এরাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী জনপ্রিয় নেত্রীর মুখাপেক্ষী হয়, তাহলে বাঙালির দীর্ঘ অপ্রাপ্তির ইতিহাসে যবনিকা পড়তে পারে। বাঙালির সেই শাপমুক্তি জননেত্রীর হাত ধরেই হয় কি না, সেদিকেই আপাতত নজর থাকবে গোটা জাতির। সেইসঙ্গে প্রার্থনা, এবার বাঙালি যেন বিনা বাধায় শীর্ষে পৌঁছায়।