বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
তিন তালাকের বিলে কী বলা হয়েছে? মুসলমান কোনও পুরুষ তাঁর স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক উচ্চারণ করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং পুরুষটির তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। বিল অনুযায়ী, তিন তালাক হল ফৌজদারি অপরাধ। ওদিকে সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করেছে গত বছরেই, কিন্তু দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেনি। কোনও ধর্মের আইনে বা ধর্মশাস্ত্রে এমন অবৈধ বিচ্ছেদকে দণ্ডনীয় হিসাবে ঘোষণা করা হয়নি; কেন মুসলমানদের পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন ভাবনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তিন তালাকের অবৈধকরণ নিয়ে একটু পিছু হাঁটলে দেখতে পাওয়া যাবে, ২০১৭ সালের অগস্ট মাসে সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের দু’জন—প্রধান বিচারপতি জে এস খেহর ও এস এ নাজির তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা ছয়মাসের জন্য স্থগিত রেখে সরকারকে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি (জাস্টিস জোসেফ, নরিম্যান ও ললিত) তাঁদের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক ও অ-ইসলামীয়। পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা তাঁরা বলেননি। স্পষ্টতই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় (যেটি প্রকৃত রায় বলে গৃহীত) গ্রহণ না করে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে পার্লামেন্টে তালাক বিল এনেছে বিজেপি সরকার।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক অবৈধ, অসাংবিধানিক, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় সত্ত্বেও নতুন করে সংসদে আইন প্রণয়নের তোড়জোড়ের কোনও অর্থ দেখতে পাওয়া যায় না। ওই সময় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় যেহেতু এই তালাককে বাতিল করা হয়েছে, তাই পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কোনও প্রয়োজন নেই। কোর্টের নির্দেশ না মানা হলে দেশের যে গার্হস্থ্য আইন রয়েছে সেই মোতাবেক দোষীর বিচার ও শাস্তি হবে। যা অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলমান পুরুষদের জন্য তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ বলে শাস্তি দেওয়ার বিল আনল সরকার। লোকসভায় সেই বিল পাশ
হয়েছে, রাজ্যসভায় পেশ হলেও মান্যতা পায়নি।
সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, একজন মুসলমান স্বামী তাঁর মুসলিম স্ত্রীকে ‘তালাক তালাক তালাক’ (তোমার সঙ্গে থাকছি না) বললেও বিবাহ-বিচ্ছেদ হবে না। এত কাল যে হত, সেটাই চরম লজ্জার। ধর্মীয় অনুশাসন না মেনে এক দল লোক এমন কুপ্রথাকে আঁকড়ে ছিল। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সেই লজ্জা দেরিতে হলেও ঘুচেছে। এখানেই বিষয়টা শেষ হয়ে যেতে পারত। তেমন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তালাক বিলে মুসলমান পুরুষদের শাস্তির (অন্য ধর্মে এটা দণ্ডনীয় নয়) কথা বলে সংবিধানের সমানাধিকারে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। তালাক বিলে বলা হয়েছে, স্বামী যদি ‘বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ’ এহেন কথা স্ত্রীকে বলে, তবে তাঁর তিন বছর পর্যন্ত জেল হবে। এমন ফৌজদারি অপরাধ হল নন-কগনিজেবল অফেন্স। কিন্তু এখানে অপরাধটি ঠিক কী সংঘটিত হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। যদি কোনও স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন যে গত রাতে উনি নিভৃতে তিন বার তালাক শব্দ উচ্চারণ করেছেন, পুলিশ ওই পুরুষকে প্রমাণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যেতে পারবে। তার পর জেলের ঘানি টেনে ওই পুরুষের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কের উন্নতি হবে নিশ্চয়! ওই কারাবাসের তিন বছর স্ত্রীর দেখভাল করবে কে, কে তাঁর ও সন্তানদের খোরপোষ দেবে, সেসব কথা বিলে লেখা নেই! ফুসকুড়ি (তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে ফুসকুড়ি বলা হচ্ছে না) ভাল করতে গিয়ে গোটা পা-টাকে কেটে বাদ দেওয়ার নিদান দেওয়ায় এই বিলকে মানবতা-বিরোধী আখ্যা দেওয়া যায়। শাস্তিতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী, যে-কোনও শাস্তির পিছনে চরম অনিবার্যতা না থাকলে ওই শাস্তি হয়ে পড়ে অত্যাচার, প্রজাপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহার। সরকার এই বিলের ক্ষেত্রে তাই করতে চলেছে।
জেরেমি বেন্থাম বলেছিলেন, তিনটি ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন ব্যবহার করা যাবে না, যার অন্যতম হল—যেখানে কুকর্মের চেয়ে শাস্তির ওজন বেশি। বর ঝগড়ার সময় বউকে যদি ‘তোমার সঙ্গে বাস করা যায় না’ বা ‘আর থাকছি না তোমার সঙ্গে’ জাতীয় কথা বেশ কয়েক বার বলে ফেলেন, দম্পতিরা যা আকছার নিজেদের ঝগড়ায় বলে থাকেন; এমন ক্ষেত্রে বরের জেল হবে। কুকর্ম ও শাস্তির পার্থক্য এখানে পাতাল আর আকাশ। তাছাড়া, এই তালাক বিল যে আইন আনতে চলেছে, আধুনিক শাস্তিতত্ত্ব অনুযায়ী তা মধ্যযুগীয়। আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ গত বছরেই বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তালাক হল পাপ। মুসলমান আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া অনিবার্য। মন্ত্রীমশাই জানেন না যে, এই দেশের শাস্তিতত্ত্ব মধ্যযুগীয় প্রতিশোধাত্মক মতবাদে বিশ্বাসী নয়। ভারতে নিবৃত্তিমূলক শাস্তির প্রচলন আছে। শাসক দল ‘ন্যায়-এর পথ অনুসরণ না করে ‘ক্ষমতা’র অপব্যবহার করছেন। সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, এই রায় যথেষ্ট। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদির সরকার আসলে মুসলমান সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনছে। সেইসঙ্গে নিজের অপদার্থতা, কুশাসন ইত্যাদির অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে এই ধর্ম-অধর্ম সার্কাসে।
২০১১ সালে আদমশুমারি অনুয়ায়ী, এই দেশে প্রায় ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলা স্বামী পরিত্যক্তা, আইনিভাবে বিচ্ছিন্না নন। ওই মহিলারা স্বেচ্ছায় আলাদা থাকেন নাকি স্বামীরা তাঁদের ত্যাগ করেছেন বা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন তা জানার উপায় নেই। ওই মহিলাদের মধ্যে ১৯ লক্ষ হিন্দু আর ২.৮ লক্ষ মুসলমান। সুতরাং যাঁরা ভাবছেন যে মহামারীর মতো মুসলমান নারী স্বামী পরিত্যক্তা হচ্ছেন, অতএব তিন তালাক বিল এনে মুসলমান পুরুষদের ভয় না দেখালে চলবে না, তাঁরাও ভুল ভাবছেন। পক্ষান্তরে, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, মুসলমানদের মধ্যে আইনি বিবাহবিচ্ছেদের পরিমাণ ০.৫৬%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ০.৭৬%। এই দেশে দেওয়ানি আইনের ভিন্নতা থাকলেও ফৌজদারি আইনের তেমন ভিন্নতা নেই বলেই জানা ছিল। এই তালাক বিল সেই বৈষম্যের সূচনাও করল।
দেশে যদি স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের জন্য আইন হয় এবং সংশ্লিষ্ট পুরুষকে শাস্তির আওতায় আনা ন্যায়বিচার বলে মনে করা হয়, তবে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ নামক স্লোগান মেনে ওই হতভাগ্য ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার নারীর সকলের ক্ষেত্রেই তা হোক। সেটাই হবে সর্বজনীন ন্যায়। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রহিম শেখ-রামা কৈবর্তরা অভিন্ন ফৌজদারি আইনের একটি ছাতার নীচে আসবেন।