বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
মহাকাশ জয় নিয়ে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন অন্তত একজন ভারতীয় মহাকাশে যাক। আর তার জন্য বন্ধু দেশ রাশিয়ার সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। ইতিহাস তৈরি হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২ এপ্রিল। সোভিয়েত রিপাবলিক অব কাজাখিস্তানের একটি স্পেসপোর্ট থেকে সয়ুজ টি-১১ রকেটে চেপে মহাশূন্যের পথে উড়ে গিয়েছিলেন ভারতের উইং কম্যান্ডার রাকেশ শর্মা। সঙ্গে দু’জন রুশ নভশ্চর। ইউরি মেলিশেভ এবং গেনাডি স্টেকালভ। রাকেশ শর্মা ও তাঁর সঙ্গে থাকা মহাকাশচারীরা মহাকাশে প্রায় ৮ ঘণ্টা সময় কাটান। রাকেশ যখন মহাকাশে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, উপর থেকে কেমন লাগছে ভারতকে? কসমোনট শর্মার জবাব ছিল, ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’। কোনও ভারতীয়ের মহাকাশ থেকে ভারত ভূখণ্ডকে দেখা সেই প্রথম। পরে রাকেশ শর্মা বলেছিলেন, ‘ভারতকে মহাকাশ থেকে অনেক সুন্দর দেখায়। এখানে রয়েছে বিশাল সমুদ্রতটরেখা। তিনদিকে বেষ্টিত অনন্যসুন্দর নীল মহাসাগর। আছে শুষ্ক মালভূমি, বন, নদীর সমতলভূমি, মরুভূমির সোনালি বালু। রাজকীয় হিমালয়কে গোলাপি দেখায়। কারণ, সূর্যালোক এর উপত্যকায় পৌঁছতে পারে না। রয়েছে তুষারশিখর পর্বতমালা। আমাদের তো সবকিছুই আছে।’
সেদিন গোটা দেশকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন রাকেশ শর্মা। এর মাঝে ৩৪ বছরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো বহু মাইল পার করেছে। মঙ্গলে যান পাঠিয়েছে। গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে মহাকাশে পাঠিয়েছে একের পর এক উপগ্রহ। নজরে সৌরজগতের আরও এক গ্রহ শুক্র। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৩ সালেই শুক্রে মহাকাশযান পাঠাবে ভারত। কিন্তু এখনও অধরা নিজস্ব যানে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর কৃতিত্ব। সেই অনন্ত অভিযানের স্বপ্নকে ফের চাগিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত বছর ১৫ অগাস্ট লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বছর পূর্ণ হবে ২০২২ সালে। সেই বছরই ভারতের কোনও সন্তান ভারতের পতাকা নিয়ে যাবে মহাকাশে। এই ঘোষণায় সিলমোহর দিয়েছে ইসরো।
একটা সময় ছিল, যখন মহাকাশে মানুষ পাঠানো নিয়ে আমেরিকা-সোভিয়েতের সমানে সমানে লড়াই চলত। আমেরিকার নভোচরদের বলা হত অ্যাস্ট্রোনট, রাশিয়া নাম দিয়েছিল কসমোনট। এবার ইসরোর পাঠানো মহাকাশচারীকে বলা হবে ‘গগনট’। আর ভিনদেশের নয়, দেশের এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যানে মহাকাশে যাবে ভারত। জানিয়েছেন ইসরো চেয়ারম্যান কে শিভান। ‘গগনযান’ নামে সেই মিশনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। জানা গিয়েছে, সাতদিনের ওই অভিযানে তিনজনকে পাঠানো হবে। শ্রীহরিকোটা মহাকাশ বন্দর থেকে রওনা হওয়ার ১৬ মিনিটের মধ্যে মহাকাশে পৌঁছে যাবেন তিন নভোশ্চর। ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটারের একটি কক্ষপথে অবস্থান করবে সেই স্পেসক্রাফট। অভিযাত্রীরা থাকবেন একটি ক্রু মডিউলে, যা একটি সার্ভিস মডিউলের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এই দুই মডিউল নিয়ে তৈরি অরবিটাল মডিউলটিকে মহাকাশে বয়ে নিয়ে যাবে ‘জিএসএলভি এমকে-থ্রি’ রকেটের অত্যাধুনিক সংস্করণ।
তবে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর আগে ২০২০ ও ২০২১ সালে দুটি মানবহীন যানও পাঠাবে ইসরো। গোটা পথটা পরীক্ষা করে দেখতে। ২০২২-এর মধ্যে পুরো প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গোটা বিশ্বে রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের পর ভারতই হবে চতুর্থ দেশ, যারা মহাকাশে মানুষ পাঠাবে। তবে, চাঁদে বা মঙ্গলে মহাকাশযান পাঠানোর তুলনাতেও এই প্রকল্প অনেক বেশি কঠিন। মহাকাশে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল মহাকাশচারীদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলেই মহাকাশযানগুলি বায়ুর সঙ্গে ঘর্ষণে প্রবল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই তাপকে সহ্য করার মতো প্রযুক্তি তৈরিই মহাকাশে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর তা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে ইসরো।
শ্রীহরিকোটা মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে জোর কদমে চলছে লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রস্তুতি। হাতে সময় ৪০ মাস। ইসরোর তরফে জানানো হয়েছে, ৪০ মাসের মধ্যে হবে প্রথম অভিযান। মহাকাশ-যাত্রার যাবতীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে এই সময়ের মধ্যেই। ইসরোর দাবি, ২০০৮-এর পরিকল্পনা মোতাবেক উৎক্ষেপণ যান ‘জিএসএলভি এমকে-থ্রি’ অনেকটাই তৈরি হয়ে গিয়েছে। ১৭৩ কোটি টাকা খরচ করেও আর্থিক কারণে মাঝে খানিকটা থমকে যায়। কেউ কেউ বলেছেন, টাকার অভাব। কিন্তু ইসরোর অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, টাকা নয়, আসল অভাবটা প্রযুক্তির। এ দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা গোঁ ধরে বসেছিলেন, তাঁরাই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করবেন। সেই প্রযুক্তিই বিশ্ব-সেরা হবে বলে তাঁদের ধারণা। তাই তাঁরা আউটসোর্সিংয়ের ভাবনাটাকে বরাবরই দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন।
২০১৮ সালের জুলাই মাসেই প্রায় ১৩ টনের ক্রু মডিউল প্যাড অ্যাবোর্ট পরীক্ষা করা হয়। যাতে উৎক্ষেপণের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বাঁচানো সম্ভব হয় তিন মহাকাশচারীকে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এমন একটা মহাকাশযান তৈরি, যা মহাশূন্যে অনেকটা ওজন বহনে সক্ষম। মানববহনকারী মহাকাশযানকে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৬ টন ওজন বহন করতে হবে। ইসরোর প্রধান উৎক্ষেপণযান পিএসএলভি, যা চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান মিশনে ব্যবহৃত হয়েছিল, তা খুব বেশি হলে ২ টন ওজন বহনে সক্ষম, এবং তাও পৃথিবীর ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। সেই কারণেই প্রস্তুতি চলছে ‘জিএসএলভি এমকে-থ্রি’- এর। যে উৎক্ষেপণযান মহাকাশের বেশি গভীরে, বেশি ওজনের মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করতে পারবে। ইসরোর দাবি, এই অভিযান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশকে নতুন দিশা দেবে। কৃষি থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরি কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণেও এই অভিযান থেকে বিপুল তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সামরিক ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে আজকের দুনিয়ায় নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আগে আমেরিকা ও রাশিয়া এক্ষেত্রে নিজেদের অগ্রগতি দেখালেও এখন চীনও অনেক এগিয়েছে। ভারতও হাত গুটিয়ে বসে নেই। শুধু ২০১৮-র কথাই ধরুন। ৩০টি সহযাত্রী উপগ্রহ-সহ গত বছর ১২ জানুয়ারি ইসরোর ৭১০ কেজির কার্টোস্যাট-২ রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। ২০১৮-র ২৯ মার্চ জিস্যাট-৬এ উপগ্রহ জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার কক্ষে উৎক্ষেপণ করা হয়। জিস্যাট-৬এ একটি সংযোগমূলক উপগ্রহ, যেটি মোবাইল সংযোগ পরিষেবায় সাহায্য করে থাকে। ১২ এপ্রিল ১,৪২৫ কেজির আইআরএনএসএস-২ উপগ্রহ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর উৎক্ষেপণ করা হয় দুটি উপগ্রহ নোভাসার এবং এস১-৪। ২৯ নভেম্বর ভূ-পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের একটি শক্তিশালী উপগ্রহ ‘হাইসিস’-সহ ৩০টি বিদেশি উপগ্রহকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। ৫ ডিসেম্বর ইসরোর সবথেকে ভারী এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত সংযোগমূলক উপগ্রহ জিস্যাট-১১টি উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর সংযোগমূলক উপগ্রহ জিস্যাট-৭এ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে ইসরো। যাকে বলা হচ্ছে ইসরোর ‘অ্যাংরি বার্ড’। ভারতীয় বায়ু সেনার হাতে থাকা অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও যুদ্ধ বিমানের নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে সাহায্য করবে এই উপগ্রহ। একে সাফল্য বলবেন না? শুধু তাই-ই নয়! চলতি বছরে আরও ৩২টি মহাকাশ অভিযান চালাবে বলে জানিয়েছে ইসরো। ‘২০১৯ সাল ইসরোর কাছে একটা চ্যালেঞ্জিং বছর।’ সহকর্মীদের নতুন বছরের বার্তায় বলেছেন ইসরো প্রধান কে শিভান। কারণ, এ বছরই রয়েছে ‘চন্দ্রযান-২’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অভিযান।
মহাকাশ-চর্চায় ভারতের সাফল্যে স্যালুট জানাচ্ছে গোটা দুনিয়া। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে প্রতিবেশী চীন—বিশ্বের প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সংবাদমাধ্যমে এখন ইসরোর সাফল্যের চর্চা। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড সৃষ্টি করে একসঙ্গে ১০৪টি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায় ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। যেভাবে ভারত মহাকাশভিত্তিক নজরদারি ও যোগাযোগ স্থাপনের বাণিজ্যিক ক্ষেত্র দখল করছে, তা প্রশংসার দাবিদার বলে জানিয়েছে বিশ্বের সবক’টি প্রধান সংবাদমাধ্যম। মহাকাশ চর্চায় বাণিজ্যিক ক্ষেত্রের দখল এখন ভারতের হাতে। তুলনামূলক অনেক কম খরচে অন্য দেশের স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর ভূমিকায় ভারত উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে বলে লিখেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কথায়, একবারেই আগের রেকর্ডের তিনগুণ বেশি সংখ্যক স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়ে ভারত যে রেকর্ড গড়েছে, তাতে তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। সিএনএন-এর মতে, ‘আমেরিকা বনাম রাশিয়ার মহাকাশ যুদ্ধ এখন অতীত। মহাকাশের আসল লড়াই চলছে এশিয়াতেই।’ ভারত এখন মহাকাশ গবেষণার এলিট গ্রুপে ঢুকে পড়েছে বলে জানিয়েছে লন্ডনের টাইমস পত্রিকা। একই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে চীনের সংবাদমাধ্যমও।
আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, ‘ঘুমন্ত হাতি’ ভারত এখন দৌড়াচ্ছে, গোটা বিশ্ব সেই দৌড় দেখছে।