বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে তল্লাশির সময় তাঁর প্রিয় পুতুলটিও পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল পাক বাহিনী। ১১ বছরের মেয়েটি আজও ভোলেনি সেদিনের যন্ত্রণার কথা। ছোটবেলায় ছিলেন কিছুটা অগোছালো প্রকৃতির। নিজের ঘরে এককোণে মাথাগুঁজে গান শুনতে আর বই পড়তেই ভালো লাগত তাঁর। নিজের ঘরে নিজের মতো। বাড়ির সকলে সেই ঘরের নাম দিয়েছিল ‘আলসেখানা’। ছোট বোন শেখ রেহানা বলেন, ‘আমার খুব মন চায়, আজ যদি মাকে বলতে পারতাম তোমার হাসু আর আলসেখানায় থাকে না। বনানী কবরস্থানে গিয়ে ভাবি, তাঁকে যদি এখনও চিঠি লিখতে পারতাম!’
কী লিখতেন রেহানা? তাঁর আপার আলসেখানার বাসিন্দা থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার কাহিনী? যে কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে একটা গোটা পরিবার হারানোর চরম দুঃখ। একের পর এক হামলার পরও বেঁচে থাকা। হাহাকার। আত্মোপলব্ধি।
প্রধানমন্ত্রী সত্তার চেয়েও আজও তাঁর কাছে মুখ্য পিতার কন্যা পরিচয়টুকুই। মুজিব কন্যা। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সেই ১৯৭৫-র ১৫ আগস্ট। ভোরের আলো ফোটার আগেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি পরিণত হয়েছিল এক টুকরো নরকে। নরপিশাচদের গুলি থেকে রেহাই পাননি মহিলা-শিশু, মুজিব পরিবারের কেউই। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকেও খুন করা হয়েছিল সেদিন। উদ্দেশ্য, ভারতকে বার্তা দেওয়া। বহু ভারতীয় গোয়েন্দাকর্তার আক্ষেপ, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যায়নি এটা শুধু নবজাতক এক রাষ্ট্রের নয়, ভারতেরও ব্যর্থতা। ভাগ্যক্রমে দু’বোনই তখন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। সেই একেকটি গুলির আওয়াজ যেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নাড়িয়ে দেয়। আজও। এরপর দুই বোনের স্বজনহীন জীবন কাটানো। বহু বছর। প্রসঙ্গ উঠলেই মুজিব কন্যা বারবার বলেন, সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর তথা ভারতের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা।
আজও ৩২ নম্বর বাড়িতে গেলে দরজার পাশে তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। নির্বাক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘এখানেই, এই জায়গাতেই আমার ভাই শেখ রাসেল প্রথম হাঁটা শুরু করে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে পরিবারটার এত ত্যাগ, সেই পরিবারের গল্পে তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে যান। শেখ রেহানার এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরো ব্যাপারটা যদি স্বপ্ন হতো? কেবল এক দুঃস্বপ্ন? ‘ডিকেন্সের একটা বই ছিল। টেল অব টু সিটিজ। দুই বোন রিপাবলিকান। কাঁটা দিয়ে উল বুনছে। আর ওদের যারা অত্যাচার করত তাদের কথা ভাবছে। তো যখন শেষ উলটি বুনল তখন বলল, থার্টি টু। মানে ক’জনকে মারছে সেটা গুনছিল দুই বোন মিলে। তো আমি দিল্লিতে থাকতে আপাকে বলতাম, আপা, আমরা এরকম করব। তখন কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলতে পারবে না। আপা বলত, মাথা ঠান্ডা কর, মাথা ঠান্ডা কর।’ রেহানার আপা আজও মাথা ঠান্ডা রেখেই বলেন, ‘মৃত্যুকে ভয় পাই না। মৃত্যুর আগে মরতেও রাজি নই। যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ মানুষের জন্য কাজ করে যাব।’
দেশটাকে নতুন করে গড়তে চান। হেলায় যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসিতে লটকে দেন। ইমরানদের জামাত প্রেম তাঁকে টলাতে পারেননি। ২০১৬ সালের গুলশান হামলার পর জঙ্গি দমনের সাফল্য তো সকলের জানা। তাঁর বিদেশনীতিতে ভারত চিরকাল ছিল নির্ণায়ক স্থানে। আজও আছে। ভোটের ময়দান থেকে কূটনীতির ময়দান, সর্বত্র বলেন, ‘আমরা কোনও জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিই না, আশ্রয় দিই না কোনও জঙ্গিকেও। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার স্থান এই দেশে নাই।’ এই ভোটেও ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতবিরোধী কোনও শক্তিকে মাথা তুলতে দেব না।’
তাঁর জীবন মানেই এক পিতৃহারা কন্যার বেড়ে ওঠার গল্প। নিজের দেশের হাল ধরার কাহিনী। শেখ হাসিনা। ১৯৮১-র ১৭ মে ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিস্নাত দিনে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তারপর? মাথায় ঘোমটা কখন যেন হয়ে গিয়েছে ট্রেডমার্ক। হাতের বালাটা থেকে মাঝে মাঝে হীরক-বিচ্ছুরণ। মুখে একটা স্মিত হাসি। সে হাসির মধ্যেই লুকিয়ে অদ্ভুত এক উষ্ণতা। তা হতে পারে আতিথেয়তার, সৌজন্যের বা কৃতজ্ঞতার। যাঁর মমতার হাত ছুঁয়ে গিয়েছে সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন, কুতুবদিয়া থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদ। শুধু জল ও স্থলই নয়, অন্তরীক্ষেও আজ বাংলাদেশের গৌরবময় বিচরণ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়েও এক টুকরো বাংলাদেশ স্থাপন করে সেদেশের আত্মবিশ্বাস ও সাহসকে গগনচুম্বী করেছেন। বাংলাদেশ আজ সম্ভাবনাময় একটি দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থার সমীক্ষায় পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ ২০৫০ সালের আগেই বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রের তালিকায় ২৩ নম্বর স্থানে পৌঁছে যাবে। বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘও স্বীকার করে নিয়েছে বাংলাদেশের অগ্রগতি ।
পাশে আছে ভারতও। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন ঘটেছিল ২০১৫ সালে। যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে যান। দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা ছিটমহল, ভূমি ও সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে এই সফরেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওই সফরে আকাশ, তথ্য ও প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস, সাইবার নিরাপত্তা, অসামরিক পারমাণবিক বিদ্যুৎসহ ৯০টির বেশি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এছাড়া দুই দেশের বাণিজ্য ৭ বিলিয়ন থেকে বর্তমানে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পায়। মোদি প্রতিবেশী এই দুই দেশ সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ বলেই মন্তব্য করেছিলেন।
আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মতো কাজও করেছেন হাসিনা। গত ১০ বছর হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কারণে বাংলাদেশ আজ জিডিপি ৭.৮ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি ৬-এর নীচে। বাস্তবায়ন করেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন। খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৩.৬ কোটি টন। বৈদেশিক মুদ্রা মজুত ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। গুদামে মজুত খাদ্যের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ টন। বাংলাদেশ এখন খাদ্যশস্য বিদেশে রপ্তানি করার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট ১.৭০ লাখ কোটি টাকা। বছরের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বই বিনামূল্যে সরবরাহ করে। প্রায় ১৫ হাজার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু। সাধারণ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ওষুধও বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। দারিদ্র্যসীমা আজ ৪৮ থেকে ২৩ ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। একজন কৃষি মজুর দৈনিক যা আয় করে তা দিয়ে ১০ কেজি চাল কেনা সম্ভব। একজন রিকশা শ্রমিক এখন ১০ হাজার টাকা মাসে আয় করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। পথেঘাটে ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। দেশের মাদ্রাসাগুলিতেও তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া, সেখানেও উন্নত জীবনের, ভালো জীবনের আকাঙ্ক্ষা। দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে বিদ্যুৎ। ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে তেরো কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। ল্যাপটপ ব্যবহার করছে শতকরা ষাট ভাগের উপর ছাত্রছাত্রী। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় শতভাগ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্থান অনেকটাই রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো। আগুনের ছাই থেকে উঠে এসে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের। মানুষ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন দেশ নিজের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরি করছে। সেতুর দুপাড়ের জমি কিনছে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী। কর্মসংস্থান হবে হাজার হাজার তরুণের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ দেখছে সেখানে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ হাব, তৈরি হচ্ছে কয়লাবন্দর। দেশে নতুন যে সমুদ্রবন্দর হয়েছে, পায়রাবন্দরের কাজ এখনও আংশিক শুরুই হয়নি, তাতেই ওই এলাকা বদলে গিয়েছে।
তবুও একটাই শঙ্কা, যে ভয়ঙ্কর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিএনপি, জামাত, ঐক্যফ্রন্ট, রব, মান্না, কাদের সিদ্দিকী, তারেক রহমান, খালেদা জিয়া খড়কুটোর মত ভেসে গিয়েছেন, সেই জোয়ারে যেন গণতন্ত্র, মানবাধিকারও ভেসে না যায়। কারণ, নিরাশার খবরও তো আছে। ছাত্রলিগের গুন্ডামি। নেতাদের দাদাগিরি। সর্বোপরি হেফাজতের সঙ্গে মাখামাখি। কে না জানে, বেকারত্ব যখন সরাসরি আঘাত হানে পেটে, তখন ধর্ম সেখানে সিঁধ কাটে। যদি চোরাপথে ধর্মীয়স্বত্বাকে বাঙালিয়ানার উপর ঠাঁই দেন, বিডিআর বিদ্রোহের থেকেও ভয়াবহ হবে পরিণাম। শেখ হাসিনা কথা দিয়েছেন, সংখ্যালঘু-কল্যাণে মন্ত্রক গড়বেন। হাজার হাজার তরুণের কাজের ব্যবস্থা করবেন।
মুজিবকন্যার কথায়, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না। তাঁর রাজনীতি নিজের জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নেই তাঁর এই পথচলা। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা শুরু করেন। আজও।