একত্ব ও সমষ্টিত্ব মূলত এক। আগন্তুক ও আকস্মিক ধর্মেই ব্যাপক বস্তুকে খণ্ডিত করিয়া ব্যষ্টিতে পরিণত করে। অতএব আগন্তুক ধর্ম বিদূরিত হইলেই মেঘনির্মূক্ত সূর্যের ন্যায় আপন স্বরূপে অবস্থান করে। সূর্যের বিকীর্ণ রশ্মিজাল (divergent rays) মূল এক কেন্দ্রে সংহত। জীব নানত্বও (plurality) এক কেন্দ্রে সংহত। এই কেন্দ্রই সমষ্টিত্ব—ইহাই ঈশ্বর। ভগবান ত্রিকালে তিন অবস্থায় অবাধিত। অতএব তিনি সত্য বস্তু। তিনি প্রমাণের বিষয় নহেন। অতএব নিত্যসিদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। যাহা সৎ, যাহা জ্ঞান, তাহাই আনন্দ। জীবের সমষ্টি—আনন্দই তিনি। অতএব ভগবান সচ্চিদানন্দ। জ্ঞান, ক্রিয়া, বল প্রভৃতি তাঁহার স্বাভাবিক। এ স্থলে স্বাভাবিক অর্থে ঔপাধিক। কারণ ঈশ্বর নিষ্ক্রিয়। কেবল উপাধি মায়া সহযোগেই তিনি ক্রিয়াশীলের ন্যায় প্রতিভাত হন। আনন্দাংশে জীবপ্রবাহ, আর সত্তা ও চৈতন্যাংশে তিনি পূর্ণভাবে জীবরূপে বিবর্তিত হইয়াছেন। ‘তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ’ শ্রুতি উদাত্ত কণ্ঠে ইহাই উদ্ঘোষিত করিয়াছেন। তিনি সর্বত্র অনুস্যুত—‘সূত্রে মণিগণা ইব’,—সূত্রাত্মরূপে তিনি সর্বব্যাপী। অসীম ও সসীম দেশ সকলই আমি জানি। মন যে ব্যাপক হইয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরিয়া আসে, তাহার মূলেও ব্যাপকতা। আমি মনেরও আধার। অতএব আমি আরও ব্যাপক। সমষ্টি ব্যাপক বস্তু সর্বদেশ ব্যাপিয়া এবং তাহাও অতিক্রয় করিয়া আছেন। কারণ তিনি দেশের আধার। দেশের পরিচ্ছেদ তাঁহার নাই। ত্রিকালকেই তিনি জানিতেছেন। অতএব কালের আধারও তিনি, তাহা হইলে কালের পরিচ্ছেদও তাহার নাই। তিনি দেশ, কাল, বস্তুর পরিচ্ছেদশূন্য। তিনি সর্বব্যাপী। তিনি আকাশের মতো সর্বব্যাপী। সর্বব্যাপী বলিয়াই তিনি নির্মল। কেহ আপত্তি তুলিতে পারেন—আকাশের ন্যায় বলায় তিনি ভৌতিক আকাশের মতো জড় বস্তু হইতে পারেন। আমরা তদুত্তরে বলিব—এ আপত্তি হইতে পারে না। দৃষ্টান্ত ও দার্ষ্টান্তিক কখনই সর্বাংশে এক হইতে পারে না। কোনও বিষয়ের সাদৃশ্য লইয়াই দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয়। সর্বাংশে এক হইলে সাম্য হয়, তাহাতে দৃষ্টান্তের কোনও তাৎপর্য থাকে না। যখন আমরা ‘চন্দ্রবদন’ বলি তখন চন্দ্রের ন্যায় গোল মুখের প্রশংসা করি না। চন্দ্রের স্নিগ্ধত্বের সহিত সাদৃশ্য তুলিয়া স্নিগ্ধত্বেরই প্রশংসা করি। ভৌতিক আকাশের ন্যায় তিনি অসীম, অনন্ত। কিন্তু তিনি জড় নহেন। আকাশের আনন্ত্যও তাঁহার ভিতরে, অর্থাৎ তিনি আকাশ হইতেও অসীম। কিন্তু বুঝাইবার জন্য দৃষ্টান্ত দিতে হইলে আকাশের ন্যায় বস্তু আর কিছুই নাই, এজন্য ঐরূপ দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হইয়াছে; অতএব আপত্তির অবসর নাই।
ভগবান সকল ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ, সকল দেহের জ্ঞাতা। কেহ আপত্তি তুলিতে পারেন যে , তাহা হইলে তিনি সংসারী হইয়া পড়েন এবং ধর্মাধর্মের দ্বারা আক্রান্ত হন। এবং জীব ও ঈশ্বর এক হইলে সংসারী জীবের অভাব হওয়ায় সংসারেরই অভাব হয়। ঈশ্বরের সংসারিত্ব এবং সংসারের অভাব এই দুইই অনিষ্টের কারণ। বন্ধনমুক্তি প্রভৃতির এবং শাস্ত্রের আনর্থক্য হয়। সুখদুঃখময় সংসার প্রত্যক্ষসিদ্ধ। জগতে বৈচিত্র আছে। বৈচিত্রের মূলে ধর্মাধর্ম আছে। ধর্মাধর্মের জন্যই সংসার পরিদৃষ্ট হইতেছে, কিন্তু জীবেশ্বরের একত্বে এই সকলই অনুপপন্ন হয়। আমরা এতদুত্তরে বলিব—এ আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারে না। কারণ জ্ঞান ও অজ্ঞান পৃথক বস্তু। অজ্ঞানবশেই লোক-ব্যবহার চলিতেছে। জ্ঞানের দ্বারাই অজ্ঞানের নাশ হয়। পরস্পরাধ্যাসেই জগতের ব্যবহার। অধ্যারোপে আত্মার ধর্ম অনাত্মবস্তুতে এবং অনাত্মবস্তুর ধর্ম আত্মাতে আরোপিত করিয়া আমি দুঃখী, আমি সুখী, আমি পণ্ডিত, আমি ব্রহ্মণ প্রভৃতি ব্যবহার করিতেছি। অপবাদে নিত্যশুদ্ধ নিষ্প্রপঞ্চ অসংসারী আত্মাই বিভাত হন। দ্রষ্টার ভোক্তৃত্ব সমবন্ধ থাকিলেও এ আপত্তি উত্থাপিত হইতে পারিত। আত্মা দেহ থাকিয়াও নির্লিপ্ত। তিনি কোনও পাপ পুণ্য গ্রহণ করেন না। আকাশবৎ বিভু যিনি তাঁহাতে মলিনতা আসিতে পারে না। বালক অল্পবুদ্ধি বলিয়াই আকাশে মলিনতাদির আরোপ করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক জানেন যে উহা বায়ুস্তরের উপর আলোকের বিম্বমাত্র। কারণ আকাশ প্রত্যক্ষের বিষয়ীভূত নহে। ‘আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তো ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ’। আত্মাও মনের অধ্যাসেই ভোক্তৃত্ব। এই ভোক্তৃত্ব অজ্ঞানকৃত। এই ভোক্তৃত্বের বশেই সংসার-প্রবাহ। সংসার-প্রবাহই কর্মভূমি। কিন্তু আত্মা নির্লিপ্ত। জ্ঞানরূপ—আত্মার কখনও ক্ষয় ব্যয় নাই।’
স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতীর ‘কর্ম্মতত্ত্ব’ থেকে