ভক্তের পক্ষে এই সকল শুল্ক বিষয় জানার প্রয়োজন, কেবল নিজ ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করা মাত্র। এতদ্ব্যতীত উহাদের আর কোন উপযোগিতা নাই। কারণ তিনি এমন এক পথে বিচরণ করিতেছেন, যাহা শীঘ্রই তাঁহাকে যুক্তির কুহেলিকাময় ও অশান্তিপ্রদ রাজ্যের সীমা ছাড়াইয়া প্রত্যক্ষানুভূতির রাজ্যে লইয়া যাইবে; তিনি শীঘ্রই ঈশ্বরকৃপায় এমন এক অবস্থায় উপনীত হন, যেখানে পাণ্ডিত্যাভিমানিগণের প্রিয় অক্ষম যুক্তি অনেক পশ্চাতে পড়িয়া থাকে, আর বুদ্ধির সাহায্যে অন্ধকারে বৃথান্বেষণের স্থানে প্রত্যক্ষানুভূতির উজ্জ্বল দিবালোকের প্রকাশ হয়। তিনি তখন বিচার বা বিশ্বাস কিছুই করেন না। তিনি একরূপ প্রত্যক্ষ অনুভব করেন। তিনি আর তর্ক করেন না, প্রত্যক্ষ করেন। আর এই ভগবান্কে দেখা, তাঁহাকে উপলব্ধি করা ও তাঁহাকে সম্ভোগ করা কি অন্যান্য সমুদয় বিষয় হইতে শ্রেষ্ঠ নহে? শুধু ইহাই নহে, অনেক ভক্ত আছেন, যাঁহারা ভক্তিকে মুক্তি হইতেও শ্রেষ্ঠ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। আর ইহা কি আমাদের জীবনের সর্ব্বোচ্চ প্রয়োজনও নহে? এমন লোক জগতে আছেন, তাঁহাদের সংখ্যাও অনেক, যাঁহারা স্থির সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, যাহা মানুষকে পাশব সুখ প্রদান করিতে পারে তাহাতেই বাস্তবিক প্রয়োজন ও উপকারিতা আছে। ধর্ম্মই বল, ঈশ্বরই বল, পরকালই বল, আত্মাই বল এগুলিও কোন কাজের নয়, যদি ইহাদের দ্বারা অর্থ বা দৈহিক সুখ না পাওয়া যায়। এরূপ লোকের মতে যাহাতে তাঁহাদের ইন্দ্রিয় চরিতার্থ না হয়, যাহাতে তাঁহাদের পরিপূর্ত্তি না হয়, তাহাতে কোন প্রয়োজন নাই। যে ব্যক্তির আবার যে বিষয়ে আগ্রহ প্রবল তাহার তাহাতেই অধিক লাভ বোধ। সুতরাং যাঁহারা পান, ভোজন, অপত্যোৎপাদন ও তৎপরে মৃত্যু—ইহার উপর আর উঠিতে পারেন না, তাঁহাদের হৃদয়ে উচ্চতর বিষয়ের জন্ম সামান্য ব্যাকুলতা পর্য্যন্ত জন্মিতে অনেক জন্ম লাগিবে। যাঁহাদের চক্ষে কিন্তু আত্মার উন্নতিসাধন ঐতিক জীবনের ক্ষণিক সুখাপেক্ষা গুরুতর বোধ হয়, যাঁহাদের চক্ষে ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কেবল অবোধ শিশুর ক্রিড়াপ্রায় বোধ হয়, তাঁহাদের নিকট ভগবান্ ও ভগবৎ-প্রেমই মানবজীবনের সর্ব্বোচ্চ ও একমাত্র প্রয়োজন বলিয়া বিবেচিত হয়। ঈশ্বরেচ্ছায় এই ঘোর ভোগলিপ্সাপূর্ণ জগতে এখনও এইরূপ মহাত্মা বিরল নহেন।
...ভক্তি পরা ও গৌণী এই দুই ভাগে বিভক্ত। গৌণী অর্থ সাধন ভক্তি, পরাভক্তি উহারই পরিপক্কাবস্থা। ক্রমশঃ বুঝিতে পারিব, এই ভক্তিমার্গে অগ্রসর হইতে হইলে সাধনাবস্থার কতকগুলি বাহ্য সহায় না লইলে চলে না। বাস্তবিক সকল ধর্ম্মের পৌরাণিক ও রূপক ভাগই আপনাআপনি আসিয়া থাকে ও প্রথমাবস্থার উন্নতিকামী আত্মাকে ভগবানের দিকে অগ্রসর হইতে সাহায্য করে। আরও ইহা একটি বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, যে সকল ধর্মপ্রণালী পৌরাণিকভাববহুল ও অনুষ্ঠানপ্রচুর সেই সকল ধর্ম্মসম্প্রদায়েই বড় বড় ধর্ম্মবীর জন্মিয়াছিলেন। যে সকল শুল্ক ঘোঁড়ামিপূর্ণ ধর্মপ্রণালীতে,—যাহা কিছু কবিত্বময়, যাহা কিছু সুন্দর, যাহা কিছু মহান্, যাহা কিছু ভগবৎপথে স্থলিত পদে অগ্রসর সুকুমার মনের দৃঢ় অবলম্বন-স্বরূপ—সেই সমুদয় ভাবগুলিকে একেবারে উৎপাটন করিয়া ফেলিতে চাহে, যে সকল প্রণালীতে ধর্ম্মরূপ ছাদের অবলম্বন-স্তম্ভগুলিকে পর্য্যন্ত ভঙ্গ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করে, ও সত্য সন্মন্ধে অজ্ঞান ও ভ্রম্পূর্ণ ধারণা লইয়া—যাহা কিছু জীবনীশক্তিসঞ্চায়ক, যাহা কিছু মানবাত্মারূপ ক্ষেত্রে উৎপাদ্যমান্ ধর্ম্মরূপ লতিকার গঠনোপযোগী উপাদান—তাহাদিগকে পর্য্যন্ত দূর করিয়া দিতে চাহে; সেই সকল ধর্ম্ম শীঘ্রই দেখিতে পাওয়া যায় যে, কেবল অন্তঃসারশূন্য একটি আধার মাত্র—অনন্ত শব্দরাশি ও তর্কভাসের স্তূপমাত্র,—হয়তো একটু সামাজিক আবর্জনা নিরাকরণ বা তথাকথিত সংস্কারপ্রিয়তার গন্ধযুক্ত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।
স্বামী বিবেকানন্দের ‘ভক্তিযোগ’ থেকে