বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
ব্রহ্ম যদি কেবলই নির্গুণ নিরুপাধিক হত, আমাদের সোপাধিক সত্তার প্রত্যক্ষ সত্যটির সাথে তার যদি চিরন্তন বিরোধ থাকত, তবে লয়ই হত যথাযথ পরিসমাপ্তি—কিন্তু প্রেম আর আনন্দ আর আত্মসংবিৎকেও ত গণনার মধ্যে আনতে হবে।
বিশ্ব শুধুই গাণিতিক সূত্র নয় যে তার সহায়ে সংখ্যা ও তত্ত্ব নামে কতকগুলি নির্ব্বস্তুক মানসজল্পনার পারস্পরিক সম্বন্ধ কষে, শেষে একটা শূন্যে বা নিরালম্ব এককে পৌঁছতে হবে; বিশ্ব আবার যে কেবল একটা স্থূল-ভৌতিক প্রক্রিয়া, তার মধ্যে ধরা দিয়েছে বিভিন্ন শক্তি ধারার একটা সমীকরণ, এমনও নয়। বিশ্ব হল এক আত্মপ্রেমিকের আনন্দ, এক অপূর্ব্ব শিশুর খেলা, নিজের অফুরন্ত সৃষ্টিসামর্থ্যের উল্লাসে আপনহারা এক মহাকবির অফুরন্ত আত্মবিকিরণ।
বলা যেতে পারে বটে ভগবান যেন এক গণিতকার, তিনি বহু রাশির একটা বিশ্বরূপী অঙ্ক কষে চলেছেন; অথবা তিনি যেন এক মনীষী, পরীক্ষা করে করে একটা সমস্যা পূরণ করা তাঁর কাজ—সমস্যা হল নানা তত্ত্বের মধ্যে নানা সম্বন্ধ নির্ণয় আর নানা শক্তির সাম্যতা সাধন নিয়ে। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আবার এ কথাও বলা উচিত যে তিনি যেন প্রেমিক, বিশ্বগত ও ব্যষ্টিগত সুরসঙ্গতির শিল্পী তিনি, তিনি শিশু, তিনি কবি। চিন্তার দিকটি যথেষ্ট নয়, আনন্দের দিকটিও সমগ্রভাবে গ্রহণ করতে হবে। ভাবনা, শক্তি, সত্তা, তত্ত্ব সবই শূন্য ছাঁচ, যদি ভগবৎ-আনন্দের ধারায় তাদের পূর্ণ না করা হয়।
এ সব জিনিষই প্রতিরূপ বটে, কিন্তু সারা বিশ্বই একটা প্রতিরূপ। বস্তু-বিচ্ছিন্ন তত্ত্ব দেয় ভাগবত সত্যের বিশুদ্ধ ধারণা, প্রতিরূপ দেয় তাদের জীবন্ত বাস্তবতা।
ভাবনা শক্তিকে আলিঙ্গন ক’রে লোকরাজির জন্ম দিয়েছে, আনন্দময় সত্তা আবার জন্ম দিয়েছে ভগবানকে। অসীম অনন্ত আপন গর্ভে অগণিত আনন্দধারা ধারণ করেছিল বলেই ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড সব সৃষ্টি হয়েছে।
সত্তার চেতনা আর সত্তার আনন্দ হল আদি জনক-জননী। তাঁরাই আবার অন্তিম পারান্তর। মাঝখানে অচেতনা হল চেতনার একটা সাময়িক মূর্চ্ছা বা তমসাচ্ছন্ন সুপ্তি। বেদনার, আত্মবিলোপের অর্থ আনন্দময় সত্তার নিজের কাছ থেকে নিজেকে অপসৃত করা, উদ্দেশ্য অন্যস্থানে বা অন্যভাবে আবার নিজেকে লাভ করা। সত্তার আনন্দ কালে সীমাবদ্ধ নয়—তার আদিও নাই, অন্তও নাই। জিনিষের এক রূপের ভিতর থেকে ভগবান বাহির হয়ে আসেন আর-এক রূপের মধ্যে প্রবেশ করবার জন্য।
ভগবান সত্যই তবে কি? চিরন্তন এক শিশু, চিরন্তন এক কুঞ্জবনে এক চিরন্তন লীলায় মগ্ন।
পুরুষরূপী মানুষ
ভগবান প্রকৃতির দিকে নিরন্তর আনত না হয়ে থাকতে পারে না, মানুষও ভাগবত সত্তার দিকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে না চলে থাকতে পারে না। অনন্তের সঙ্গে সান্তের এই হল চিরন্তন সম্বন্ধ। যখন মনে হয় তারা দুটিতে দুদিকে চলেছে, তখন তার অর্থ নিবিড়তর মিলনের জন্যই তারা পরস্পর হতে দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মধ্যে জগৎ-প্রকৃতি পুনরায় সচেতন হয়েছে যাতে সে তার ভাগবত ভোক্তার অভিমুখে দ্রুততর বেগে চলে আসতে পারে। এই ভোক্তা-পুরুষকেই নিজের অজ্ঞাতসারে সে ধারণ করে আছে, জীবন-ধারা আর ইন্দ্রিয়-বৃত্তিও একেই ধারণ করে আছে অথচ অস্বীকার করছে, অস্বীকার করছে বলে আবার অনুসন্ধান করছে।
শ্রীঅরবিন্দের ‘চিন্তা-কণা দৃষ্টি-নিমেষ’ থেকে