দিদি বিনে গতি নাই। প্রথমে দিদির দল ভাঙিয়ে দলবদলুদের নিয়ে ঘর সাজানো, তারপর দিদিরই জনমোহিনী নীতির অনুকরণের চেষ্টা করে ইস্তাহার প্রকাশ। ২৯৪টি আসনে প্রার্থী দিতে যে দল হিমশিম খাচ্ছে, প্রতিটি বুথে কর্মী বসাতে পারবে কি না সন্দেহ, সেই দলটি সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে যে ইস্তাহার প্রকাশ করল তা অনেকটা সোনার পাথরবাটি। ইস্তাহারের ছত্রে ছত্রে পরানুকরণের মরিয়া প্রয়াস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পগুলিকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা! এমন ঢালাও প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মোদি সরকারের ক্ষমতায় আসার আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। যার অধিকাংশই পূরণ হয়নি। পরবর্তীকালে ধাপ্পা বলে প্রমাণ হয়েছে। যেমন কালো টাকা উদ্ধার, বছরে ২ কোটি চাকরি, প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি বরং বেকারি বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় মানুষ মোদি জমানায় ভালো নেই। আবার ভোট এসেছে। বাংলার ভোট। দেশের সর্ববৃহৎ দলটি যেন কল্পতরু। ফের প্রতিশ্রুতি বিতরণ! প্রত্যেক পরিবারে একজনের কর্মসংস্থান, রাজ্য সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ, দেদার ভাতা, বিপুল পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা বলা হল। কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? দিশা নেই। তাই প্রশ্ন উঠছে, বঙ্গে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর গেরুয়া শিবিরের এ এক নয়া ভাঁওতা নয়তো? একই জিনিস বারবার ব্যবহারে তার ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়। ঘষা-মাজারও দরকার পড়ে। তাই নতুন মোড়কে আগের মতোই প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা ফের দেখল বাংলা। আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখাতে অর্থের প্রয়োজন হয় না। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে টাকা লাগে। এ প্রশ্ন উঠতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যা বললেন তা পাশ কাটানো প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। বললেন, আমি বানিয়া, হিসেব কষেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যে সরকার দেশের সম্পদ বেচে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে তাদের মুখেই এমন কথাই শোভা পায়! বানিয়াই বটে! বিজেপি নাকি যা বলে তাই করে। এমন হাস্যকর দাবিতে ঘোড়ায় হাসবে। বছরে ২ কোটি চাকরির বদলে মোদি জমানায় গত একবছরে কাজ খুইয়েছে ১৩ কোটি ভারতবাসী। তা নির্মম হলেও সত্য। ফের ইস্তাহারে প্রত্যাশার অসংখ্য ফানুস ওড়ানো হল। মোদি জমানায় মানুষ বুঝেছে, এই সরকার জনকল্যাণকামী ভূমিকাতে বিশ্বাসই করে না। বরং তাদের নীতি হল উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে হিন্দুত্বের জিগির তুলে মানুষকে মজিয়ে রাখা। ইস্তাহারেও সেই সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বে ঢাকা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ফোকাসে এসেছে সিএএ কার্যকর করা, পুরোহিত ভাতা, পুরোহিত কল্যাণ বোর্ড, মন্দির সংস্কারের জন্য টাকা বরাদ্দ, নারায়ণী সেনার মতো বিষয়গুলি।
সোনার বাংলা গড়তে আসল পরিবর্তনের ডাক বিজেপির। ‘আসল’ পরিবর্তন কিন্তু গোটা দেশে, এমনকী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যাশ্রী রূপশ্রীর মতো সহায়তা প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে গেছে বাংলার ঘরে ঘরে। বামা বাহিনীর বড় অংশ মমতার পক্ষে বুঝে সেই ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসানোর মরিয়া প্রয়াসও দেখা গেল। কেন্দ্রে বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণ না করলেও বাংলাতে সেটাই করার প্রতিশ্রুতি ইস্তাহারে। নারীশক্তি জাগরণের জন্য এমন ‘আসল পরিবর্তন’ অন্যত্র হচ্ছে না কেন? প্রশ্ন ওঠে, কেন এই দ্বিচারিতা? যেখানে সারা দেশে রেশন গ্রাহকের সংখ্যা কমাতে উদ্যোগী কেন্দ্র সেখানে বাংলার আমজনতার মন পেতে ইস্তাহারে দিল পিডিএসের প্রতিশ্রুতি! যা করেনি অন্যত্র, তাই নাকি করবে বঙ্গে। সবই ক্ষমতায় আসার বাসনায়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে যেখানে নারী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা, মহিলা নিরাপত্তা তলানিতে, সেখানে এরাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে মেয়েদের জন্য কত কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিল। কেজি টু পিজি বিনামূল্যে শিক্ষা, নিখরচায় যাতায়াত, ১৮ বছরে পৌঁছলে ২ লক্ষ টাকা সহায়তা দেওয়ার সাতকাহন। একেবারে কল্পতরু। বঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যারা এত ভাবছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে সে ভাবনা অনুপস্থিত। এও আর এক দ্বিচারিতা। মহিলাদের স্বনির্ভর করার চেষ্টা তো এই রাজ্যে চলছেই। তবে বিজেপি এবার আস্তিন থেকে সবচেয়ে বড় যে অস্ত্রটি বের করেছে তা হল নয়া নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি। ভোট বৈতরণী পেরতে এই গাজরটি ঝুলিয়ে দেওয়া গেরুয়া শিবিরের পুরনো অভ্যাস, কৌশলও। গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও হয়েছিল। যাতে মতুয়া সম্প্রদায় ভোট বাক্স থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। এবারও টার্গেট মতুয়া, রাজবংশী, ওবিসি, আদিবাসী ভোট। চেনা ছবি। ক্ষমতায় এলেই নাকি প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।  শরণার্থীদের জন্য প্যাকেজ না দিয়ে, উদ্বাস্তু কলোনির স্বীকৃতি ঝুলিয়ে রেখে শুধু প্রতিশ্রুতি ভ্রষ্টাচার নয় কি? ইস্তাহারে ঠাঁই পেয়েছে অনেকগুলি পুরনো বিষয়। মোদি জমানায় এখনও এই রাজ্য পুরোদমে একটি এইমস পায়নি, জিতলে হবে নাকি তিনটি এইমস!
প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে কোনও দায় নেই। পূরণেই দায়। ক্ষমতায় এলে তো দায়িত্ব পালন। তাই ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিতে ক্ষতি নেই। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের রেকর্ড ইতিমধ্যেই গড়ে ফেলেছে মোদি জমানা। তাই ইস্তাহারে প্রকাশিত প্রতিশ্রুতিগুলি মানুষ কতটা বিশ্বাস করল তা বোঝা যাবে ভোটের ফলে।