সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
বিজেপির তরফে প্রকাশিত ‘সোনার বাংলা সংকল্পপত্র ২০২১’-এর বক্তব্যও যেন তাই—শুধু ভোট দেওয়াটাই নাগরিকের ডিউটি! ভোটটা বিজেপিতে পড়ে গেল মানে ‘আমার সোনার বাংলা’র দশ কোটি মানুষের নো চিন্তা, স্রেফ ডু ফুর্তি! আর পরিবারটির গায়ে ‘শরণার্থী’ তকমা থাকলে তো সোনায় সোহাগা। মোদিরা দাবি করেছেন, ভারতের থেকেও এগিয়ে ভাবতে পারত যে বাংলা, সে আজ সবদিক থেকে পিছিয়ে গিয়েছে। তার জন্য বিজেপি বাদে পৃথিবীর (ভাবখানা সেরকমই) সব দলই দায়ী। অতএব বিজেপি এবার সবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মতো সুকঠিন কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হবে। মোদি-শাহ জুটিই ফিরিয়ে দেবেন বাংলার ও বাঙালির হৃতগৌরব। বাংলার মাটিতে ফিরে আসবে আইনের শাসন, যথার্থ সাম্য। প্রতিষ্ঠিত হবে সমস্ত ন্যায়, গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার পরিবেশ। ‘আমরা এমন একটি সোনার বাংলা গড়তে চাই, যা সারা পৃথিবীর কাছে তার সংস্কৃতি এবং গৌরবময় ইতিহাসের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ‘আমাদের বিশ্বাস শুধুমাত্র সোনার বাংলার পূর্বোদয় পারে ভারতের ভাগ্যোদয় নিশ্চিত করতে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে ভারতকে কি প্রকৃতরূপে আত্মনির্ভর করে তোলা যাবে?’ ‘এবার সোনার বাংলা এবার বিজেপি’ শিরোনামে মহিলা, যুব, কৃষক থেকে সমাজের সব শ্রেণির জন্য আর্থ-সামাজিক বিকাশের যে অপূর্ব ছবি তুলে ধরা হয়েছে তা রূপকথার গল্পেও দুর্লভ! রকমসকম বলছে, এই ইস্তাহার হল ভাগ্যের সেই চাকা যা শুধু সামনের দিকেই ঘুরতে জানে। কিন্তু বাঙালি অসহায়ের মতো দেখল—এত বড় বড় কথা উচ্চারণের জন্য মঞ্চে কোনও বঙ্গসন্তানকে পাওয়া গেল না, যা করার তা করলেন এক গুজরাতি ‘বেনিয়া’!
মানছি আইডিয়াই হল আসল। ভালো আইডিয়া না থাকলে ভালো কাজ করা যায় না। কিন্তু এই প্রসঙ্গে অনেক প্রশ্ন যে উঠে আসে। প্রথম প্রশ্ন, ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যের ‘মালিক’ তো মোদির দল। তাহলে ডবল ইঞ্জিনের সাহায্যে এই আইডিয়াগুলি ওই জায়গাগুলিতে রূপায়ণ করা হল না কেন? তাহলে তো এতদিনে ‘সোনার ভারত’ গড়ার কাজটা প্রায় সারা হয়ে যেত। বাংলা, কেরল, তামিলনাড়ু প্রভৃতি দু’-চারটি হতভাগা নাহয় বাদ থাকত। তারা নাহয় দেখে শিখত পরে। তাতে মোদিবাবুদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত। গোঁয়ার বাঙালিকে ভজাতে এত যাজন করতে হতো না, কিংবা দিনরাত এক করে ঘাম ঝরাতে হতো না, একবার এবাংলা আর একবার ওবাংলা দৌড়োদৌড়ি করতে হতো না। বাঙালির দুঃখে এতই যদি কাতর তাহলে অসমে বিজেপি সরকারের হাতে বাঙালি হিন্দুর যে হেনস্তা চলছে কয়েক বছর ধরে, তার জবাব কি দেবেন মোদি? কেন সেখানে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ বাঙালির জীবনে নিজভূমে পরবাসীর যন্ত্রণা নামিয়ে আনা হয়েছে? কেন এনআরসি, সিএএ হাতিয়ার করে সেখানকার নাগরিকদের বেনাগরিক করে তোলার চক্রান্তে লিপ্ত বিজেপি? অসমে সরকার গঠনের আগে বাঙালিদের কি এই ষড়যন্ত্রের কথা জানানো হয়েছিল যে অচিরে তাদের নরকযন্ত্রণা ভোগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে? পশ্চিমবঙ্গীয়দের জন্য এই সতর্কবার্তা কি যথেষ্ট নয়?
এই ইস্তাহারে (শব্দটি বোধকরি সজ্ঞানেই পরিহার করা হয়েছে, কারণ এটি অসংস্কৃত এবং আরবি) থুড়ি, সংকল্পপত্রে এত অজস্র স্বপ্ন বোনা হয়েছে যে মানুষ একজন্মে ভাবতেও পারে না, মনে রাখবে কী করে? এসবের ৯৯ শতাংশ অল্পদিনেই ভুলে যাবে মানুষ। বিজেপি সেটাই চায়। তাহলে পিঠ বাঁচাতে সুবিধে হয় বৈকি! কিন্তু মানুষ যে এখনও ভোলেনি মোদির দু’-একটি লম্বা-চওড়া ভাষণের সারাংশ: কেন্দ্রে ক্ষমতা পেলে বিদেশ থেকে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার করে আনব। প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করব। বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি দেব। কালো টাকা কত উদ্ধার করে আনা হয়েছে? অরুণ জেটলি জবাব দিয়ে যাননি। নির্মলা সীতারামনও দেননি। শুধুই দেখলাম, কয়েকজন কুখ্যাত কালো টাকার কারবারি মসৃণ পথে বিদেশে চলে গেল। তাদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ মোদি সরকার। ফিরিয়ে আনা নিয়ে যা এখনও অবধি হয়েছে তা নিম্নমানের নাটক মাত্র। অতএব সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ক্রেডিট করার সংকল্প যে জবরদস্ত ধাপ্পা ছিল তা অনেক আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বছরে ২ কোটি নতুন চাকরির বদলে মোদি জমানায় কত কোটি পুরনো চাকরি খোওয়া গিয়েছে, বিশেষত কোভিডকালে, তার হিসেব চাওয়ার সময় এখন। বাংলায় স্বচ্ছতার পাঠ চালু করার আগে পিএম কেয়ার্স ঘিরে ওঠা গুরুতর প্রশ্নগুলিরও জবাব দিন মোদি। জবাব যতদিন না মিলবে ততদিন রাজনৈতিক প্রতারণায় নবতম সংযোজন হিসেবেই গণ্য হবে ৬৮ পাতার এই গাঁজাখুরি সংকল্পপত্রটি।
বছর খানেক আগের ঘটনা। উত্তর শহরতলিতে এক গৃহকর্ত্রী রাস্তা থেকে জঞ্জাল কুঁড়িয়ে এনে
নিজের বাড়ির ভিতরে জমা করতেন। বিকট গন্ধে
ভরে উঠেছিল এলাকা। কিন্তু উৎস কী? প্রতিবেশীরা ধরতে পারছিলেন না। একদিন কেউ একজন
আবিষ্কার করলেন। কিন্তু মহিলা কিছুতেই আবর্জনা ফেলবেন না। তাঁর বক্তব্য, আমার বাড়িতে আমি কী রাখব তা আমার ব্যাপার। তখন প্রতিবেশীরা বলেন, ‘‘গন্ধটাও তাহলে আপনার বাড়িতে আটকে রাখুন।’’ শেষমেশ ওই জঞ্জাল তাঁকে ত্যাগ করতেই হয়।
পরে জানা যায়, মহিলা ভালো চাকরিজীবী হলেও
এটা তাঁর একটা মানসিক ব্যাধি।
বাংলায় মজবুত সংগঠন তৈরির ব্যর্থতা ঢাকতেই ভোটের মুখে বিজেপিকে একাধিক দলের আবর্জনায় ঘর ভরাতে হয়েছে। দিকে দিকে দুর্গন্ধ এত ছড়িয়েছে যে ঘরের লোকদেরই ত্রাহি মধুসূদন দশা! বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বুঝে গিয়েছে, এই দৈন্য থেকে নিষ্কৃতি এখনই সম্ভব নয়। দুর্গন্ধ ঢাকার বিকল্প কৌশল নিতে চেয়েছিল কেউ কেউ, যে-কোনওভাবে শোর মাচানো। তাই অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়দের ছবি মুছে দেওয়ার হিড়িক তুলেছিল বিজেপি। কিন্তু এই সামান্য জিনিসে এত দুর্গন্ধ আড়াল করা যায়নি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাই দম বন্ধ করা দুর্গন্ধ ঢাকতেই এই আকাশকুসুম ‘সংকল্পপত্র’ রচনা, পাতাগুলি বাংলার আনাচে-কানাচে উড়িয়ে দেওয়া। এছাড়া করার কিছুই ছিল না মোদি-শাহ জুটির।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এবং হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্সের প্রশ্নে ভারতের মান সম্প্রতি অনেকটাই নেমে গিয়েছে। ইউএস থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ফ্রিডম হাউস’-এর মতে, ভারতের মান নেমে গিয়েছে ‘ফ্রি’ ক্যাটিগরি থেকে ‘পার্টলি ফ্রি’ ক্যাটিগরিতে। আশঙ্কামতো এসবরেই প্রতিফলন মিলল সদ্য প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে। ২০ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। ওইদিন প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ১৪৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৯তম। প্রতিবেশী বাংলাদেশ (১০১) এবং পাকিস্তান (১০৫) এই প্রশ্নে আমাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে। আরও এগিয়ে রয়েছে একনায়কের দেশ চীন (৮৪)। তালিকায় সবার উপরে ফিনল্যান্ড। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মানুষকেই সবচেয়ে দুঃখী বলে চিহ্নিত করেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই রিপোর্ট। আমরা তার থেকে মাত্র দশ ধাপ উপরে রয়েছি! ভারতবাসীকে আজ সান্ত্বনা পেতে হবে আফগানিস্তানকে সামনে রেখে—না, আমরা ওদের থেকে তো ভালো আছি! হায় মোদির সুশাসন!
বাঙালির সত্যিই দুর্ভাগ্য, এমন ট্র্যাক রেকর্ড যে নেতার তাঁর মেলে ধরা কল্পতরুপত্র দেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা তাঁর পছন্দের কিছু লোকের হাতে আমাদের ভাগ্য আগামী পাঁচবছরের জন্য বন্ধক রাখব কি না।
দীক্ষাপ্রসঙ্গে ‘স্বামি-শিষ্য-সংবাদ’-এ বর্ণিত স্বামী বিবেকানন্দের কয়েকটি কথায় চোখ রাখা যায়: ১৩০৩ সালের ১৯ বৈশাখ। শিষ্যকে দীক্ষা দিতে রাজি হয়ে স্বামীজি ‘রহস্য’ করে বললেন, ‘‘আজ তোকে ‘বলি’ দিতে হবে—না?’’ এরপর স্বামীজি আমেরিকার নানা প্রসঙ্গ শোনালেন। তারপর জানালের ধর্মজীবন গঠনে কীরকম একনিষ্ঠ হতে হয়। গুরুতে কীরূপ অবিচল বিশ্বাস ও দৃঢ় ভক্তিভাব রাখতে হয়। গুরুবাক্যে কীরূপ আস্থা স্থাপন করতে হয়। এবং, গুরুর জন্যে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জনের জন্য কীভাবে প্রস্তুত হতে হয়। নানা প্রশ্ন করে স্বামীজি তাঁর হবু শিষ্যের মন পরীক্ষা করতে লাগলেন। একসময় বললেন, ‘‘যদি গঙ্গায় ঝাঁপ দিলে বা ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়লে তোর মঙ্গল হবে বুঝে তাই করতে বলি, তাহলে তাও অবিচারে করতে পারবি তো? এখনো ভেবে দেখ; নইলে সহসা গুরু বলে গ্রহণ করতে এগুসনি।’’
ভীষ্মের শরশয্যাপাশে উপস্থিত হলেন শ্রীকৃষ্ণ, জ্ঞাতিশোকে কাতর যুধিষ্ঠির প্রমুখ। শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধে ভীষ্ম অবশেষে যুধিষ্ঠিরকে রাজার পালনীয় কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ছিল—‘‘লোকসংগ্রহ অপেক্ষা রাজাদিগের পরম ধন আর কিছু নাই।’’ মোদিরা তাই কৌশলে বাংলার মানুষকে গেরুয়ামন্ত্রে দীক্ষিত করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। দীক্ষা নিতে বললেন, কিন্তু খোলসা করলেন না তাঁদের একান্ত প্রয়োজনে কখন বাংলার মানুষকে চোখ বুজে গঙ্গায় কিংবা ছাদ থেকে মরণঝাঁপ দেওয়ার নিদান ঘোষণা করবেন!