সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিত্বদের মূল্য লক্ষ্য ছিল—‘সরকারে শিক্ষিত ভারতবাসীদের জন্য একটা বড় জায়গা দখল করা এবং একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি
করে নেওয়া, যেটাকে ভিত্তি করে তাঁরা ইংরেজের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পেতে পারেন।’ স্বাধীনতালাভের কোনও ভাবনাচিন্তা তখনও পর্যন্ত ছিল না। ব্যাপারটা এসেছে অনেক পরে—১৯১৯ থেকে ১৯২৯ সালের ভিতরে।
আর একটা দৃষ্টান্ত হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), যদিও তাদের তরফে প্রতিবাদ করে বলা হয়েছে যে আরএসএস কোনও রাজনৈতিক দল নয়। হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। গোড়ার দিকে যাই বোঝানো হোক না কেন, আজ
এটা অ্যাটাভিসটিক (পূর্বপুরুষদের লক্ষণ ফিরে আসায় বিশ্বাস) এবং জেনোফোবিক ইডিওলজি (বিদেশিদের সম্পর্কে আতঙ্কের মতাদর্শ) মাত্র,
যার লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত, অভিবাসী এবং সূক্ষ্মভাবে মহিলা, অহিন্দিভাষী জনগণ এবং অন্যসকল পিছিয়ে পড়া মানুষ—এদের সবাইকে হেয় করা।
রাজ্যস্তরে অনেক উদাহরণ রয়েছে। আঞ্চলিক অহঙ্কার, তামিল-প্রীতি, আত্মসম্মান, কুসংস্কার ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে অবস্থান থেকে তৈরি হয়েছিল ডিএমকে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, ডিএমকে ভেঙে বেরিয়ে এসে, কিছু নেতা মিলে তৈরি করেছিলেন এআইএডিএমকে।
মতাদর্শের বিকাশ
কোনও মতাদর্শই অপরিবর্তিত থাকে না। বছরের পর বছর গিয়েছে, কংগ্রেস দেশকে স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছে, রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল উভয়পক্ষকেই শামিল করেছে, বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে সমর্থন করেছে বাজার অর্থনীতিকে, সাদরে বরণ করেছে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণাকে।
সেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি আজকের বিজেপির থেকে কংগ্রেসকে পৃথক হিসেবে চিনিয়ে দিচ্ছে। বিজেপি কুণ্ঠাহীনভাবে আরও হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং আরও ধনতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বহুদলীয় গণতন্ত্রকে
স্বীকার করে নিয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোও তাদের নীতি ও অবস্থান মধ্যপন্থায় পাল্টে নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ডিএমকে ভেঙে তৈরি হওয়া এআইএডিএমকে শুরু থেকেই ছিল ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং সম্প্রতি ডিএমকে নির্দিষ্টভাবে তাদের নাস্তিক্য-নীতি ত্যাগ করেছে।
এইসব রাজনৈতিক দল এবং পরিবর্তনশীল মতাদর্শগুলোর উপর আমার মতামত আমি নানা সময়ে দিয়েছি। প্রত্যেকটা মতাদর্শ মনে হয় যে ঈশ্বরবিশ্বাসীদের যুক্ত করে এবং নাস্তিকদের বাদ দিয়ে, যদিও তাদের ভোট ও সমর্থন ঈশ্বরবিশ্বাসীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। নিরন্তর বদল এবং শামিল করার গুরুত্বটা এখানেই। অবিশ্বাসীরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভেবে আলাদা দল তৈরি করেছিল, যার ভিতরে ছিল তাদের প্রতি সহানভূতি অথবা প্রতিবাদের প্রকাশ। এরকম বিশেষ ধরনের প্রতিবাদের ভিতর দিয়েই তৈরি হয়েছিল কংগ্রেস (ও) এবং কংগ্রেস (আর), জনতা দল, এসপি, এনসিপি, বিজেডি, তেলুগু দেশম প্রভৃতি। একটা পৃথক রাজ্য কিংবা আরও বেশি স্বশাসনের চাহিদা ছিল টিআরএস এবং অগপ দল গঠনের প্রেরণা।
বর্জনের রাজনীতি
তবু, ভারতের বহু রাজনৈতিক দলের তরফে, জনগণের ভিতরে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু শ্রেণিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল অথবা তারা বাদ পড়ে গিয়েছে বলে ভেবেছিল—এবং এখনও তারা সেইরকমই ভাবে। তাদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম এবং দলিতরা। এই শ্রেণিগুলোকে সাম্প্রদায়িক বা জাতিবাদী বলে দোষ দেওয়া যাবে না। মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে যতদিন তাদের বাইরে রাখা হবে, এই শ্রেণিগুলো ততদিন নিজ নিজ স্বার্থবাহী রাজনৈতিক দল গঠনে প্রবৃত্ত হবে, যা ন্যায্যও বটে। আমার মতে, ভারতীয় রাজনীতি এবং কোয়ালিশন গঠনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টার গুরুত্ব, বিধিসম্মত অথবা কার্যত, ওই বর্জন থেকেই বুঝে নিতে হবে।
আমি স্মরণ করতে পারি যে, ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি গুজরাত এবং উত্তরপ্রদেশে কোনও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। অথচ, গুজরাতের জনসংখ্যার ৯.৬৫ শতাংশ মুসলিম এবং সেখানে বিধানসভার আসন সংখ্যা ছিল ১৮২। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশে মোট জনসংখ্যার ১৯.৩ শতাংশ মুসলিম এবং সেখানে বিধানসভায় মোট আসন ছিল ৪০২টি। তাহলে ওই দুই রাজ্যের মুসলিমদের করণীয় কী ছিল? অন্য দলগুলো অবশ্যই অন্যভাবে এগিয়েছিল, তারা মুসলিম প্রার্থী দিয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা প্রতীকী ব্যাপারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। দলিতদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, সব দলই তাদের প্রার্থী করেছে কেবলমাত্র ‘সংরক্ষিত’ আসনগুলোতে। তার
ফলে মোদ্দা এই দাঁড়াল যে, রাজনৈতিকভাবে অন্তর্ভুক্তিকরণের বদলে আরও বর্জনের
রাজনীতি করা হল। এই অবসরে মুসলিম, দলিত এবং বর্জনের রাজনীতির শিকার অন্য শ্রেণিগুলো পৃথক দল গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। আত্মরক্ষা এবং নিজ নিজ স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনেই তাদের এই উপলব্ধিটা হল।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা ১৯০৬ সালে। স্বাধীন ভারতে মুসলিমদের তরফে অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে: আইইউএমএল, এআইইউডিএফ, এআইএমআইএম এবং এগুলোর থেকে ছোট আরও কিছু দল। এমনিভাবে দলিতদের তরফে তৈরি করা হয়েছে বিএসপি, এলজেপি (বিহারে) এবং ভিসিকে (তামিলনাড়ুতে)। আরএসএস এবং বিজেপি মুসলিমদের তৈরি দলগুলোকে তফাতে রাখলেও, দলিতদের তৈরি দলগুলোর সঙ্গে জোট গড়ে—এর থেকে বেশি বিদ্বেষ আর কী হবে! (অবশ্য শোনা যায় যে, অসমের একটা জেলা পরিষদের ভোটে এআইইউডিএফের সঙ্গে বিজেপি জোট করেছিল।)
প্রশাসনের জন্য আরও ভালো
এই ধরনের ‘এক্সক্লুসিভ’ (বিশেষ ধরনের) পার্টিগুলো আছে বলেই কোয়ালিশন তত ‘ইনক্লুসিভ’ (অন্তর্ভুক্তির) রাজনীতির পথ দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মুসলিম এবং দলিতদের হাতে গড়া রাজনৈতিক দলগুলো অসম, কেরল, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে কোয়ালিশন বা জোটের ভিতরে তাদের জন্য বিশেষ জায়গা করে নিতে তারা সক্ষম হয়েছে। আমি মনে করি, এটা উত্তম ব্যাপার। এই দলগুলো একা লড়তে গেলে তাদের পক্ষে বিধানসভায় প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ত এবং জিতলেও তারা বাধ্য হতো কক্ষে গিয়ে নীরব নিষ্ক্রিয় দর্শক অথবা নিছক প্রতিবাদী থেকে যেতে। তার থেকে ভালো হবে যে তারা সংসদে ও বিধানসভায় প্রবেশাধিকার পাবে এবং রাজ্যে ও দেশের প্রশাসনে অংশ নিতে পারবে।
প্রত্যেকটা দলই একটা কোয়ালিশন বা জোট করার চেষ্টা করে। একটা দল নিজের জোরে কিছু নির্বাচনে কিছু রাজ্যে গরিষ্ঠা পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলোতেও ওই দলটা আরও কিছু দলের ভোট একত্র করতে চায়, যাতে তার গরিষ্ঠতা আরও সুদৃঢ় হতে পারে। এখন বেশিরভাগ নির্বাচন কোয়ালিশনগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বিধানসভার ভোটে অসম, কেরল, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং পুদুচেরি কেন্দ্রাশাসিত অঞ্চলে দু’টো বড় কোয়ালিশন গড়ে উঠেছে। সমান শক্তিশালী না-হলেও, পশ্চিমবঙ্গে তিনটে কোয়ালিশন তৎপর রয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, একটা কোয়ালিশন সরকার একদলীয় সরকারের তুলনায় অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং কর্মতৎপর হয়ে থাকে।
বাজপেয়ি এবং মনমোহন সিংয়ের সরকার ছিল কোয়ালিশন। সুতরাং নির্বচনী জোট কিংবা কোয়ালিশন সরকারগুলোকে তাচ্ছিল্য করা আমাদের উচিত
হবে না। একদলের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার চেয়ে এই ধরনের কোয়ালিশন সরকার অনেক ভালো এবং কোয়ালিশন সরকারই দেশের জন্য আরও বেশি কাজ করতে পারে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী।
মতামত ব্যক্তিগত