সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
বিজেপি নেতারা দফায় দফায় বলেছেন, স্বাস্থ্যসাথী হল একটি প্রতারণা। আদতে কেউ চিকিৎসা পাবে না। এটা হল চমক। এর থেকে অনেক ভালো হল কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প। সুতরাং, আমাদের কাছে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, বিজেপি সরকার গঠন করলে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। চালু হবে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প। অর্থাৎ যে প্রকল্পটি শুধুই দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থানকারী মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। সকলের জন্য নয়। বিজেপির এক মুখপাত্র তৃণমূলের ইস্তাহার প্রকাশের পর সমালোচনা করে বলেছেন, পরবর্তী প্রজন্ম কি ২ টাকার চাল প্রকল্পের দিকেই তাকিয়ে থাকবে? অর্থাৎ ২ টাকার চাল প্রকল্প চলুক এটা বিজেপি পছন্দ করছে না। তাহলে কি তারা ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্প বন্ধ করে দেবে? দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা বলেছেন, ৫ টাকায় মা ক্যান্টিন চালু করার অর্থ প্রমাণ দেওয়া যে, আজও বাংলায় কত গরিব মানুষ আছেন যাদের এভাবে ৫ টাকায় খাবার দিতে হচ্ছে সরকারকে। অর্থাৎ বাংলা থেকে গরিবি হটাতে ব্যর্থ তৃণমূল সরকার। এই অভিযোগের অর্থ হল, বিজেপি বাংলায় সরকারে এসে এই ক্যান্টিন নিশ্চয়ই বন্ধ করে দেবে? সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্পের তীব্র সমালোচনায় যখন বিজেপি মুখর, তখন বাংলার মানুষ নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে যে, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই তাবৎ রাজ্য সরকারের চালু করা প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেবে। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই পাল্টা যুক্তি হিসেবে বিজেপি বলবে, না না প্রকল্পটা খারাপ নয়। এই সরকার ঠিকভাবে চালাতে পারছে না। আমরা সেটাই বলছি। সেক্ষেত্রেও বক্তব্য হল, তাহলে এখনও এপর্যন্ত একবারও বলেননি কেন যে, প্রকল্পগুলি ভালো? বিজেপি তো সভা সমাবেশে বারংবার বলেছে, সব প্রকল্পই অর্থহীন ও চটকদারি!
বাংলায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ নেই? সেই ক্ষোভ ভোটযন্ত্রে প্রতিফলিত করতে মানুষ চায় না? অবশ্যই চায়। ১০ বছর একটি সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিক্ষোভ থাকাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই মানুষগুলিকে জানতে হবে তো যে তৃণমূল না হয় খারাপ, কিন্তু যারা বিকল্প তারা ক্ষমতায় এলে কী কী করবে? এখনও পর্যন্ত সেরকম একটিও বিকল্প কর্মসূচির কথা জানা গেল না। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম সকলেই বলছে তৃণমূল সরকারের কী কী খারাপ। কিন্তু একবারও এটা শোনা যাচ্ছে না যে, তারা ক্ষমতায় এলে কী কী করবে এসবের পরিবর্তে। তৃণমূল বিরোধী ভোটার জানতে চাইছে বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী কী হবে। সবথেকে বেশি কার বলার কথা ছিল এই বিকল্প উন্নয়নের কথা? প্রধানমন্ত্রীর। ব্রিগেডে তিনি সেরকম কিছু বললেন? সাড়ে ৭ কোটি ভোটারের কাছে ‘ভাইপো তাড়াও’ কোনও বুদ্ধিমান ইস্যু হতে পারে? দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী মঞ্চে অন্যতম এক স্টার বক্তা পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বলছেন ‘আমি জাত গোখরো, এক ছোবলেই ছবি’— এটা কোনও তৃণমূলের বিকল্প স্লোগান হতে পারে? বিজেপি অভিযোগ করছে তৃণমূল নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলার সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে এবং বিজেপি আবার বাংলার সংস্কৃতি ফিরিয়ে দেবে। এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিজেপির সর্ববৃহৎ নেতার উপস্থিতিতে সেই স্টার বক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাম উল্লেখ করার কিছুক্ষণ পরই বলেন, ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’। এটা কি আরএসএস এবং বিজেপির কট্টরপন্থী বিশুদ্ধবাদীদের কাছে সোনার বাংলার পদধ্বনি?
সোনার বাংলা ব্যাপারটা ঠিক কী? আমরা তো ‘সোনার উত্তরপ্রদেশ’, ‘সোনার ত্রিপুরা’, ‘সোনার অসম’, ‘সোনার হরিয়ানা’, ‘সোনার মধ্যপ্রদেশ’ বলিও না। শুনিও না। বিজেপি ক্ষমতায় এলে একটি রাজ্য যদি সোনার হয়ে যায়, তাহলে ২০১৮ সালে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও কেন মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মানুষ বিজেপিকে হারিয়ে দিয়েছিল? কেন রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডের মানুষ বিজেপিকে পুনরায় সরকারে ফিরিয়ে আনল না? কেন বিগত বছরগুলিতে একের পর এক রাজ্যে বিজেপি বিধানসভায় পরাস্ত হচ্ছে?
সবথেকে বড় যে রহস্য সেটি হল, বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের চরম ব্যর্থতা। স্বয়ং ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজ্যে ১৯৫৩ সালে তাঁর জীবনাবসানের পর বিগত ৬৭ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে শক্তিশালী কিছু নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হল কেন তারা? তার শোচনীয় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এবার নির্বাচনে প্রার্থী তালিকায়। আরএসএসের বিভিন্ন রাজ্যের পারফরম্যান্স অতুলনীয়। সেখানে সংঘের শিক্ষা নিয়ে আসা নেতার অভাব নেই। একটি মন্ত্রী পদের জন্য ১০ জন যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়। রীতি হল, রাজ্যে রাজ্যে আরএসএস নেতা তৈরি করে এবং সঠিক সময়ে বিজেপিকে সাপ্লাই করে। সেই সংঘশিষ্যরা ক্রমেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে নেতা হয়ে যান প্রথম সারির। বাংলায় দেখা যাচ্ছে উল্টো নিয়ম। এখানে এত বছরেও কোনও উচ্চমানের সর্বজনগ্রাহ্য একঝাঁক নেতা গড়ে তুলতে পারল না আরএসএস। করলে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে এত সঙ্কট হতো না। প্রার্থী নিয়ে এত নাজেহাল হতে হয় না। বরং দেখা যাচ্ছে, আরএস নয়, বিজেপিকে সবথেকে বেশি নেতা সাপ্লাই দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থাৎ বাংলায় বিজেপির কাছে আসল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ হিসেবে উঠে এসেছে তৃণমূল! পার্থক্য হল, এই নেতারা তৃণমূলের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের ফেভারিট স্টেটমেন্ট হল, ‘দলে সম্মান পাইনি, তাই দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না।’ সুতরাং এর অর্থ হল, যেসব নেতাকে তৃণমূল গুরুত্ব দেয়নি, তাঁরাই বিজেপির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পর্যবসিত। কতটা নেতৃত্বের অভাব হলে এরকম হতে পারে! মাত্র ২৩ বছরের একটি আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের দল সামলে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, ভারতীয় জনসংঘের ঐতিহ্য বহন করে আসা ৪১ বছরের পুরনো ভারতীয় জনতা পার্টিকেও নেতা সাপ্লাই করে চলেছে, এটা কী প্রমাণ করে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধুই ভালো রাজনীতিবিদ নয়, তিনি ভালো সংগঠক ও প্রশিক্ষকও।
শুধু তাই নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে জেতার ফর্মুলাও সাপ্লাই করেছেন। এতদিন দেখা গিয়েছে, তৃণমূলই একমাত্র রাজনীতির সংযোগহীন টালিগঞ্জের তারকাদের প্রার্থী করছে। এবং তাঁরা জয়ী হচ্ছে। যেহেতু ঘরে ঘরে তাঁরা জনপ্রিয় মুখ। এই মডেলও বিজেপি গ্রহণ করেছে বিনা দ্বিধায়। তারাও একই পথে হাঁটছে। তৃণমূলে তৈরি হওয়া নেতারাই আজ বিজেপি নেতা। তৃণমূল নাকি পাগলু ডান্সের পার্টি, এরকমই ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হতো। এখন সিপিএম যেমন টুম্পা ওয়ান, টুম্পা টু গানের পার্টি, তেমনই বিজেপিকেও গ্রাস করেছে এমএলএ ফাটাকেষ্টর সংলাপ! সুতরাং, বাংলার জয়পরাজয় নয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বরং উদ্বেগের বিষয় হল, মোদির দলে দিদির প্রভাবই তো বেশি দেখা যাচ্ছে?