সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
এমনিতেই বঙ্গ বিজেপির প্রার্থী তালিকা এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রে। বহু অপ্রত্যাশিত নাম, আদি-নব্য দ্বন্দ্ব, টিকিট না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভের পাহাড়... অমিত শাহরা চাইলেও সব আসনে প্রার্থীর নাম একসঙ্গে ঘোষণা করতে পারছেন না। তাঁরা জানেন, যত বেশি সংখ্যক প্রার্থী ঘোষণা, ততই বিদ্রোহের আগুন। প্রার্থী কারা? দলবদলু বেশ কিছু নেতা-নেত্রী, তৃণমূলের ফর্মুলা মেনে টেলি তারকা এবং গত লোকসভা ভোটে জিতে আসা এমপিরা। এ এক ভয়ানক জাঁতাকল বটে। তৃণমূলের ‘সেলিব্রিটি’ নেতা-মন্ত্রীরা দল বদলে বিজেপিতে গিয়েছেন। তাঁদের আব্দার তো মানতেই হবে! আগে যতই ঘোষণা হোক না কেন, ‘তৃণমূলের থেকে আসা সব নেতা টিকিট পাবেন না। পেলেও কঠিন কেন্দ্রে।’... সেই তত্ত্ব ফাইনাল কাউন্টডাউনে এসে আর খাটল না। আর প্রার্থী তালিকা ঘোষণা মাত্র শুরু হল বিক্ষোভ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজারে তো বিজেপি কর্মীদের এমন স্লোগানও দিতে শোনা গেল, ‘ক্যারেকটারলেস প্রার্থী মানছি না, মানব না।’ লালমোহন গাঙ্গুলি থাকলে নিশ্চিত বলতেন, ‘বোঝো ঠ্যালা’। খড়্গপুরের চৌরঙ্গি মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল এক বিজেপি কর্মীর সঙ্গে। সাফ বললেন, ‘এই প্রার্থী চলবে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কি ছবি দেখাব? বলব, এই যে হিরণ... আমাদের প্রার্থী? এঁকে ভোট দিন?’ তিনি আদি কর্মী। বিজেপিটা ধান্দায় নয়, ভালোবেসে করেন। তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রে রোড-শো করে ফের অমিত শাহ দাবি করে গেলেন, ‘২০০ আসন নিয়ে মোদিজির নেতৃত্বে আমরা সরকার গড়ব।’ সত্যিই কি তাই? সেই আদি কর্মী একটু থামলেন। তারপর বললেন, ‘এবার আমাদের সরকার হবে বলে মনে হয় না জানেন...। খুব বেশি হলে ১০০ সিট। এর বেশি হওয়া মুশকিল।’
হয়তো বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও সেটা জানে। তাই ‘সেফ সিটে’ জোর পড়ছে। আর পরিচিত কিছু নামে। স্বপন দাশগুপ্ত, নিশীথ প্রামাণিক, লকেট চট্টোপাধ্যায়...। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও রয়েছেন তালিকায়। ভাঁড়ার কি এতই খালি? মনে পড়ছে সেই কুমিরছানার গল্পটা। একই কুমিরছানাকে সাতবার বের করে দেখানো... এই তো আমাদের কাছে সাত রাজার ধন আছে। যে চার এমপিকে বিজেপি আসন্ন বিধানসভা ভোটে প্রার্থী করেছে, তাঁরা অবশ্যই পরীক্ষিত। ধরা যাক এই সাংসদ প্রার্থীরা জিতেও গেলেন। তারপরই কিন্তু তাহলে চারটি লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন করাতে হবে। মানে, বাংলার মানুষের করের টাকায় আবার নির্বাচনী শ্রাদ্ধ। যার প্রয়োজন আছে বলে বাংলার মানুষ অন্তত মনে করে না। অর্থাৎ, আবার দাঁড়িপাল্লা।
একুশের যুদ্ধে প্রতিপক্ষ তিন। এবং তিন পক্ষেরই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য শুধু ভোট জয়ের লক্ষ্যে সীমাবদ্ধ নয়! যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়... গত ১০ বছর তিনি বাংলা শাসন করছেন। উন্নয়নমূলক বহু কাজ। কিন্তু এরপরও নিচুতলায় দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ১০ বছর সরকার চালানোর পর প্রতিষ্ঠান বিরোধী একটা হাওয়া তৈরি হয়। এই ধরনের অভিযোগ তারই বহিঃপ্রকাশ। এখানেও ভোটাররা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ওজন করতে বসেন, কোন দিকটা বেশি ভারী... মানুষের স্বার্থে সরকারি কাজ, সমাজের নিরাপত্তা, নাকি দলীয় কর্মীদের একাংশের দুর্নীতি? এই প্রাক-ভোট পর্বে বহু জেলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে আপাতত একটা সারাংশ খাড়া করা যাচ্ছে। তা হল, সরকারটা খারাপ নয়, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ভালো... সব সময় ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে দলের সেই ‘একাংশ’কে নিয়ে। তাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কনফিডেন্ট। এই ভাঙা পা নিয়েও। তিনি জানেন, এটা তাঁর প্রেস্টিজ ফাইট। ভোটের মুখে দশ দিক থেকে দশ রকম বিপত্তি আঘাত করেছে তাঁকে। সবই ধীরে ধীরে সামাল দিয়েছেন। তারপর এগিয়েছেন ভোটের নিশানায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, এই ম্যাচ তাঁর হারলে চলবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিপক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট। গত সাত বছরে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস মোটেও খুব সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। মাঝে কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও সামগ্রিক চালচিত্রে খুব একটা বদল আসেনি। শতাব্দীপ্রাচীন এই দল বাংলায় প্রায় সাইনবোর্ডের পর্যায়ে। ফলে বামেদের সঙ্গে জোট গঠন ছাড়া উপায় ছিল না অধীর চৌধুরীদের। সিপিএমকে দেখে কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, আসন্ন ভোটটা তারা সিরিয়াসলি লড়বে। অন্তত প্রার্থী বাছাইতে তারই ইঙ্গিত। কেন্দ্র অনুযায়ী ঠিকঠাক প্রার্থী, বার্ধক্যের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা এবং নবীন প্রজন্মে গুরুত্ব। কারণ সিপিএম জানে, এবারের নির্বাচন বড় কঠিন ঠাঁই। জিতে ক্ষমতায় আসাটা কিন্তু মূল লক্ষ্য নয়! উদ্দেশ্য একটাই, বাংলার রাজনীতিতে বামেদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনা... অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
আর থাকল বিজেপি। চেনা ফর্মুলা... আগেই ভোটব্যাঙ্কটাকে ধর্মের নিরিখে দু’ভাগ করে দাও। তারপর শুরু হোক প্রচার। সংখ্যালঘুরা কিন্তু বিজেপির টার্গেট ভোটার নন! সেটা গেরুয়া শিবিরের কর্তাব্যক্তিরা বারবার আসছেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটাই বোঝাচ্ছেন। মেরুকরণ কর্মসূচি চলছে... পুরোদমে। কারণ, বাংলা এবার বিজেপির কাছে মরিয়া লড়াই। নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার আধার যে শূন্য হয়ে যায়নি, তা প্রমাণ করতেই হবে। বিরুদ্ধ ইস্যু কিন্তু কম নেই! নোট বাতিল, বেকারত্ব, প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়া, নাগরিকত্ব এবং কৃষি আইন... তারপরও বিজেপি চাইছে এ রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে। চাইছে বলাটা ভুল হল... চলছে মরিয়া চেষ্টা। এ যুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতে গেলে গোটা দেশে আরও অনেকটা পিছনের সারিতে চলে যাবেন মোদি। সংঘবদ্ধ হয়ে ভেসে উঠবে বিরোধী মহাজোট। যার মুখ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ডেবরা বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে বালিচক স্টেশন। তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল বছর ষাটেকের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কর্মসূত্রে তাঁকে দুই মেদিনীপুরই চষে বেড়াতে হয়। একটা অদ্ভুত অঙ্ক শোনালেন তিনি... ‘আমাদের রাজ্যে মুসলিম ভোটার কত বলুন তো? মেরেকেটে ২৭ শতাংশ। ধরা যাক, বাম-কংগ্রেস-আব্বাসের জোট তার পাঁচ-সাত শতাংশ পাবে। মেরুকরণের জন্য বিজেপিকে এখান থেকে ভাগ দেওয়া যাচ্ছে না। তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাবেন ২০ শতাংশ! মানেটা বুঝলেন? মমতা কিন্তু একশোয় ২০ নম্বর হাতে নিয়ে পরীক্ষায় বসছেন। বাকি অঙ্কটা এবার বুঝে নিন।’
হয়তো সাধারণ পাটিগণিতের হিসেব। হয়তো ভোটের সমীকরণ এত সহজ নয়। তারপরও কিন্তু ওই বৃদ্ধের কথা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামটার সত্যিই একটা ওজন আছে... এই ভাঙা পায়ে ওজনটা আরও বেড়েছে। বাড়ছে। মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে মহাজোটের প্রার্থী। তাঁর হয়ে ভোট চাইতে গিয়েছেন কর্মীরা... এক বাম সমর্থকের ঘরেই। বয়স্কা ভোটার বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবা, ভোটটা এবার তোমাদের দিতে পারব না। এখানে যে মমতা দাঁড়িয়েছে! অনেক করেছে মেয়েটা আমাদের জন্য। যদি ও না দাঁড়াত... অন্যরকম ছিল। তা তো নয়! নন্দীগ্রামের প্রার্থী মমতা... আর ওকে ভোট দেব না!’
এ যে বিজেপির কাছে বড্ড অসম ফাইট। ঝাড়গ্রামের সার্কাস ময়দানের সামনে দাঁড়িয়ে ওই আদিবাসী ভদ্রলোকও কিন্তু বলছিলেন... ‘বিজেপি তিন নম্বর হয়ে গেলেও আশ্চয্যি হবো না গো’।