সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
প্রথম প্রশ্ন, কেন সরকার বেসরকারিকরণ করবে? ২০১৯-২০ আর্থিক বছরেও সকল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কার্যকরী মুনাফা বেড়েছে ১৬.৪ শতাংশ। ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা প্রায় লাভ হয়েছে। তাহলে কেন আরও কর্মী ও প্রযুক্তির জন্য বরাদ্দ করে আরও উন্নত পরিষেবা দেওয়ার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোয়? আসলে ব্যাঙ্কের এই লাভ আর বিপুল সঞ্চয় সরকার কাজে লাগাতে চাইছে শিল্পপুঁজির তহবিল হিসেবে। গত দশ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লাভ হয়েছে ১৪ লক্ষ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর শিল্পপতিদের ঋণ দিতে গিয়ে ১৮ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে মোদি সরকার। কিন্তু তার অর্ধেক টাকাও ফিরে আসেনি। যদি শিল্পপতি সেই অর্থ আর ফেরত না দেন, বা দিতে না পারেন, তখন সাধারণ মানুষ সর্বস্ব হারায়। ব্যাঙ্ক দুর্বল হয়ে যায়। উঠে যায়। এই কারণে এখন মোদির আমলে এত ব্যাঙ্ক দুর্বল হচ্ছে।
অথচ নেহরুর আমলে ব্যাঙ্কের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ চালু করা হয়েছিল। তাতে ক্রমশ উন্নতি হয় দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায়। আজ দেশের কোনায় কোনায় প্রায় এক লাখ ব্যাঙ্ক, প্রত্যন্ত এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন জীবিকায় উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে কৃষি এবং ক্ষুদ্রশিল্প। তাতে কিন্তু সরকারি ব্যাঙ্ক ফেল করেনি আজও। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্ক ফেল করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বাঁচাতে, দুর্বল ব্যাঙ্ককে সবলের সঙ্গে মিলিয়ে এবং সংখ্যায় কমিয়ে এনে, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গোটাতে চাইছে মোদি সরকার। এইভাবে তো দুর্বল ব্যাঙ্কের দায় আর কর্মী বোঝা নিতে গিয়ে সবল ব্যাঙ্কই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আসল দরকার গুটিয়ে যাওয়া নয়, ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ নয়, দরকার মোদি সরকারের ঋণ দেওয়ার নীতি সঠিক করা। তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের আর আদৌ দরকার হয় না।
উদারনীতিতে সংস্কার চালু হওয়ার পর ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজি আহ্বান করা হয়েছিল নতুন ব্যাঙ্ক গঠনের জন্য। সেটাও একপ্রকার বিপজ্জনকই ছিল। সেটা কতটা তা দেখা গিয়েছে গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক উঠে যাওয়ার পর। তবুও সরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রেখেছিল ইউপিএ সরকার। এখন মোদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর শেয়ার বিক্রি করে দেবে বলছে। তার মানে, সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলা ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভয়ংকর সিদ্ধান্ত এটি। কারণ এতে দেশের মানুষের সঞ্চয় বিপন্ন হবে। এই মুহূর্তে দেশের মানুষের ১৪৬ লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে জমা আছে। সরকার এই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের মাধ্যমে ওই সঞ্চয়কে ঋণ দেওয়ার নামে বেসরকারি উদ্যোগের শিল্প বিকাশে ঢালবে। আশঙ্কা এখানেই। জনগণের সঞ্চয় নিয়ে শিল্পপতিরা নিজেদের প্রকল্পে খাটাবেন। তাঁদের ব্যবসা কোনওভাবে মার খেলে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় বিপন্ন হবে। ব্যাঙ্ক নিজেও উঠে যাবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে ইয়েস ব্যাঙ্ক এবং লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র অনাদায়ী ঋণের বোঝা বইতে না পেরে। কিন্তু এমন ঘটনা কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে কখনও ঘটেনি। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরকার সেটা শিথিল করলেই বোঝা যাবে বেসরকারিকরণ কতটা ব্যুমেরাং হতে পারে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের এই উদ্যোগের পাশাপাশি, সরকার ব্যাঙ্কিং আইন সংক্রান্ত আরও একটি বিল এনেছে আইন তৈরি করবে বলে। সেটি চরম জনবিরোধী। তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে ব্যাঙ্ক উঠে গেলে আমানতকারী পুরো টাকা আর আগের মতো ফেরত পাবেন না। সর্বোচ্চ ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাবেন। তার বেশি যত টাকাই থাক আর ফেরত পাবেন না। সরকারি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ করে সেই ব্যাঙ্কের পুঁজি লোপাট হলে যাতে কোনও দায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের আর না থাকে তার জন্য এই আইন চালুর কথা ভাবা হল।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ইতিপূর্বে শিল্পপতিদের নেওয়া ঋণ আর ফিরে আসছে না দেখে নতুন করে তাদের জন্য ঋণ দিতে ব্যাঙ্কে পুঁজি হিসেবে টাকা ঢালছে সরকার। কিন্তু সেই পুঁজি আসছে তো জনগণের করের টাকা থেকে। গত তিনবছরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা সরকার দিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির খাতে, অথচ দেশের সাধারণ মানুষকে (যাদের করের টাকা) ঋণ দেওয়া কমছে। তাদের উন্নয়নের কাজ হচ্ছে না সেই টাকায়। সেই রাজস্ব চলে যাচ্ছে শিল্পপতির কাছে। তাঁদের জন্য পুঁজি বিনিয়োগের ঋণ হিসেবে। বলা হচ্ছে তাতে দেশের উন্নতি হবে। অনেক কারখানা হবে। অনেক কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু সত্যি কি তাই হয়েছে?
মোদি ক্ষমতায় সরকার আসবার পর ২০১৪ -১৫ থেকে ২০১৯-২০ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের থেকে শিল্পপতিদের দেওয়া হয়েছে ১৮ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ লাখ কোটির বেশি আর কোনও দিন ফিরবে না । ব্যাঙ্কের হিসেবের খাতা থেকে মুছে দিতে বলা হয়েছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু অর্থনীতিতে কোনও লাভ হয়েছে? না, হয়নি। উল্টে বৃদ্ধির হার কমে গিয়েছে ৪ শতাংশ! বেকারত্ব বেড়েছে রেকর্ড হারে। গত ৪৫ বছরে যা কখনও হয়নি। আরও আশ্চর্যের কথা, ঋণ খেলাপি বৃহৎ শিল্পপতিদের একটা বড় অংশই গুজরাতি। তাঁদেরকে কত টাকা কোন কোন ব্যাঙ্ক দিয়ে ফেরত পেল না, সেই তথ্য জানাতে পারছে না খোদ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক! রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন রিপোর্টে রঘুরাম রাজন লিখেছিলেন: এ-দেশের ব্যাঙ্কের সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন শিল্পপতিরা। এটা বন্ধ করবার জন্য ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি এবং ঋণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট আইন করা দরকার। সেটা না করে সরকার ব্যাঙ্কগুলিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আগামী দিনে দেশের অর্থনীতিতে এর পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়ংকর।
আসলে নয়া উদারনীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য ছিল, মানুষের মধ্যে কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত করে বেসরকারি পুঁজির বিকাশের জায়গা তৈরি করা। কিন্তু মোদির অর্থনীতি হল, সেই অষ্টাদশ শতকের সওদাগরি অর্থনীতি। যেখানে দেশের সঞ্চয় শোষণ করে সওদাগর চান রাষ্ট্রের সহায়তায় নিজে পুষ্ট হওয়ার জন্য চালু থাকুক অর্থনীতির কাঠামো। এইভাবেই বেসরকারি পুঁজি সরকারি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে, ক্ষমতায় থাকাকালীন দল বা গোষ্ঠী এই কাজে সমর্থন করে কেবলমাত্র ব্যক্তি বা দলগত গোষ্ঠীগত স্বার্থ থেকে। উন্নয়ন, বিকাশ, আত্মনির্ভরতার যে কথাগুলো বলা হয় তা সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সওদাগরি অর্থনীতি যেখানে চালু হয়েছে সেই দেশেই দুই দশকের মধ্যে সমস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দুর্ভিক্ষে বা প্রবল সঙ্কটে প্রচুর মানুষ খাবারের অভাবে মারা গিয়েছে।
এদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ হলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোটি কোটি ছোট কৃষক, ছোট ব্যবসাদার, ছোট দোকানদার, অল্প পুঁজির কারখানার মালিক, যাদের জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক শাখা চালু রয়েছে, ঋণ দিচ্ছে গ্রামে ছোট শহরে। এই শ্রেণি হারিয়ে যাবে আর্থিক উন্নয়নের মানচিত্র থেকে। একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা কোম্পানির বেসরকারিকরণ হলে সঙ্কটে কতজন বিমার টাকা পাবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। বিমা ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোর এই নিয়ে পরিসংখ্যান আশানুরূপ নয়। তাই এই বেসরকারিকরণ হলে সাধারণ মানুষ আরও বিপন্ন হবেন। মুনাফা লুটবে কর্পোরেট। দুর্বল হবে দেশের অর্থনীতি।