সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
জঙ্গলমহলের মুখে হাসি ফোটাতে আদিবাসীদের দুয়ারে বারবার ছুটে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। স্বীকার করেছেন, কিছু ভুল হয়েছিল ‘লোকালি’। তৃণমূলের প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, দলের একাংশের ঔদ্ধত্য, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি ও গোষ্ঠী রাজনীতিই নিচুতলার জনসমর্থনে ধাক্কা দিয়েছে। তাই পোক্ত সংগঠন না থাকা সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে পদ্ম ফুটিয়েছে গেরুয়া শিবির। সময় নষ্ট করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে, অনেক তাবড় নেতা-নেত্রীকে সংগঠনের পদ খোয়াতে হয়েছিল। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষের কাছে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়াই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। যারা বঞ্চিত, তাদের ক্ষোভ সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে জঙ্গলমহলেও চালু হয়েছিল ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। প্রশাসনিক কর্তাদের মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমজনতার নালিশ তিনি শুধু শুনছেন না, বিহিতও চান।
সমীক্ষা চালিয়েই মুখ্যমন্ত্রী জানতে পেরেছিলেন, আদিবাসীদের প্রধান দুই সমস্যা মাতৃভাষা সাঁওতালিতে শিক্ষা ও পরিবহণ। জঙ্গলমহলে সাঁওতালি ভাষায় অলচিকি লিপিতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকার অভিযোগে বারে বারেই সরব হয়েছে ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল সহ বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। দ্রুত সেই সমাধান মেটাতে, ঝাড়গ্রামের প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলা বিভাগে সাঁওতালি ভাষাশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উদ্বোধন করেন নতুন ২৪টি এসবিএসটিসি বাসও। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দেন, এখানকার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য আর বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। জানান, ঝাড়গ্রাম জেলায় আরও দু’টি সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল চালু হবে। সেই সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার খাতড়ায় দু’টি এবং পুরুলিয়ায় দু’টি সাঁওতালি মাধ্যম স্কুল চালুর আশ্বাস। সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলগুলিতে আরও দু’শো অলিচিকি শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা। আর সাঁওতালি ভাষায় অলচিকিতে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পাঠ্যক্রম চালুর প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রীর।
প্রতিটি ঘরে ফি সপ্তাহে ঢুকছে দু’টাকা কেজির চাল। বহু মোরাম রাস্তা পিচের হয়েছে আর কাঁচা রাস্তা মোরামের। লম্বা-চওড়া নতুন নতুন সেতু কম সময়ে জুড়ছে দু’প্রান্তকে। এ সবের সঙ্গে স্কুল-কলেজ-হস্টেলের সাদা-নীল রঙের চার-পাঁচতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে হাস্যমুখর জঙ্গলমহলের ঝলমলে বিজ্ঞাপন হিসেবে। বছর দশেক আগেও ধড়সা মোড় থেকে বেলপাহাড়ির রাস্তা ধরলে মোটরগাড়ি আর গরুর গাড়ির তফাত মালুম হতো না। এখন বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে দিঘলপাহাড়ি বা কুলডিহার জঙ্গল ধরে যত ভিতরেই যাওয়া হোক না কেন, রাস্তা পাকা। দু’ধারে বিদ্যুতের খুঁটি। সাইকেল বা গরুর গাড়ির বদলে হুস হুস করে পেরিয়ে যায় বাইক। মেঘরাজপুর বা বরামশোল, ভালকাচুয়া বা এড়গোদা, ভুলাভেদা বা কেঁউদিশোল, সর্বত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের দেখা মেলে। মানুষের কাছে পেনশন, জল, বার্ধক্যভাতা সবই। উন্নয়ন সত্যিই এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষের জন্য উন্নয়ন এখানেই থেমে থাকে না। জঙ্গলমহলের জন্য নতুন নতুন চমক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছেন, ‘জঙ্গলমহল ব্যাটালিয়ন’ তৈরি করবে রাজ্য পুলিস। জঙ্গলমহলের মাটিকে সম্মান জানিয়েই এই ব্যাটালিয়ন তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি ব্যাটেলিয়নে ১ হাজার জন করে নিয়োগ করা হবে। রাজনীতির বাইরে এ এক অন্য আলো। যে আলো অনুন্নয়নকে পিছনে ফেলে মানুষের মধ্যে আলোর স্পর্শ এনে তাকে নতুন বোধে জাগিয়ে তোলে।
ইতিহাস বলে, জঙ্গলমহল নামটি একদিনে তৈরি হয়নি। পিছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস। অনেকে জঙ্গলমহল বলতে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরকে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই এই নামের তথ্যভিত্তিক পরিচয় পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলার টুকরো অংশ নিয়ে এই জঙ্গলমহলের সৃষ্টি হয়েছে। শান্তি রক্ষা ও সুশাসনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক সময় জঙ্গলমহল নামে একটি পৃথক জেলা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গবেষক জেসি ঝা-র ‘দ্য ভূমিজ রিভোল্ট’ বইয়ে এই তথ্যের উল্লেখ মেলে। এই অরণ্যবেষ্টিত, পাহাড়-পর্বত ঘেরা জঙ্গলমহলের জনসমাজের প্রতিচ্ছবি ও মানসিক বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের সৃষ্ট শিল্প ও সাহিত্যচর্চায়। এখানকার মানুষ একাধারে স্রষ্টা ও ক্লাসিক সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ। সারাদিন কঠিন পরিশ্রমের পরে সন্ধ্যাবেলায় তাঁদের সাহিত্য–শিল্পের আসর আয়োজন হয়। কোথাও গানের সুর, কোথাও গল্প-কথায়, প্রবাদ-প্রবচনে অরণ্য-জনতা সান্ধ্য অবসরটুকুকে উপভোগ্য করে তোলেন। এই সচলতা প্রাণাবেগে বিভিন্ন মানুষের স্মৃতিপথ বেয়ে লোকমুখে দেশ, কাল, পাত্র ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। সেই ভবিষ্যতকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ লড়াই করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাওবাদের আতঙ্ক মুছে লালগড়-সহ জঙ্গলমহল এখন শীতকালের কংসাবতীর মতোই তরঙ্গহীন। বাতাসে বারুদের গন্ধ পরের কথা, গত দশ বছরে এ তল্লাটে কোনও মাইন বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়নি! একদা গামছায় মুখ ঢেকে এলাকায় ত্রাসের পরিবেশ কায়েম করে রাখত যারা, তাদেরও কবে খেদিয়ে ছেড়েছে আধা সামরিক বাহিনী। জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরিয়ে উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সফল, তা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করে নেন।
বাম আমলের অনাহারের গ্রামেও এখন কংক্রিটের রাস্তা, বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ, সকলেরই ইটের ঘর, টিনের ছাউনি। সচল প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এমনকী, সে সময় খেতে না পেয়ে মারা যাওয়া এক পরিবারের ছাদেও ডিশ টিভির ছাতা। সেখানকার জনজাতি পরিবারের মাটির দোতলা বাড়িতে এখন চলে ‘হোম-স্টে’। সেখানে শহুরে আরাম ছেড়ে স্বেচ্ছায় দু’-চার দিনের গরিব হয়ে থাকার কারবারও নাকি চলছে ভরপুর। একদিকে মমতার উন্নয়নের ইতিবাচক দিক, অন্যদিকে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতিবাচক দিক—এই দুইয়ের লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জঙ্গলমহলজুড়ে এখন ঘরে ঘরে ভাতের গন্ধ। নতুন প্রজন্মের চোখে শিক্ষার স্বপ্ন, বড় হওয়ার স্বপ্ন। মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
তবে অন্য এক আতঙ্ক তো রয়েছে গোটা জঙ্গলমহল জুড়েই। এনআরসি’র আতঙ্ক। ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো এখানকার আদিবাসী সমাজেও আতঙ্কের ঢেউ তুলেছে মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ। এইসব দরিদ্র, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, আজীবন বঞ্চিত মানুষ তাঁদের ‘ডকুমেন্ট’ পাবেন কোথা থেকে? তাহলে কি তাঁদের আশ্রয় নিতে হবে কোনও এক ডিটেনশন ক্যাম্পে? ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে জঙ্গলমহল। অসমের নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। আর তার জেরেই পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের মধ্যে আশঙ্কা ছড়িয়েছে। আবার হয়তো একটা বীরসা মুণ্ডা বা সিদো কানহোর ইতিহাস তৈরি হবে। লেখা হবে নতুন কোনও গল্প!
আদিবাসী সমাজের এই মনোভাব বুঝেছে বিজেপি। বুঝেছে আদিবাসী সমাজের ক্রমে দূরে সরে যাওয়ার কারণও। তাই কিছুটা নরম হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা বলেছিল, রামমন্দিরের ভূমিপূজনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মাটি ও জল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অযোধ্যায়। সাঁওতালদের পবিত্র ক্ষেত্র সারনা ও জাহের থানের মাটিও নিয়ে যাওয়া হবে রামজন্মভূমিতে। কিন্তু রামচন্দ্রের মন্দির নির্মাণের জন্য তাঁদের ধর্মস্থানের মাটি দিতে অস্বীকার করে সাঁওতাল সমাজ। সারা ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের সুপ্রিমো রামচন্দ্র মুর্মু বলেন, আদিবাসী সমাজকে হিন্দু ধর্মে শামিল করার এটা একটা চক্রান্ত। আরএসএসের এই ফাঁদে পা দিতে রাজি নয় আদিবাসী সমাজ। এই ফাঁদে পা দিলে সাঁওতাল-আদিবাসীদের জাতি, ধর্ম, সমাজ সংস্কৃতি সব শেষ হয়ে যাবে। তারা তাদের সারনা ধর্মের স্বীকৃতি চায়। আদিবাসী সমাজ বলছে, আগে জনগণনার সময়ে তারা নিজেদের ধর্ম উল্লেখ করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে শুধুই হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ইত্যাদি প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হন তারা। এই প্রথা বদলের দাবি দীর্ঘদিনের।
‘ভগবান ধর্মেশ, সিংবোঙ্গা, হিল্লা মারাংবুরুর উপাসনা যারা করে, তারাই সারনা ধর্মাবলম্বী। সারনার আরেক নাম সৃষ্টি। জল, বায়ু, অগ্নি, ভূমি এবং আকাশ— এই পাঁচটি মূল উপাদানের মাধ্যমে যে সৃষ্টি, তারই উপাসক আমরা,’ এমনই ব্যাখ্যা আদিবাসীদের ধর্মগুরু বন্ধন টিগ্গার। আদিবাসীদের সেই দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুরুলিয়ার হুটমুড়ার জনসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে এসেছেন, সারি ও সারনা ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আদিবাসীরা চিঠি দিয়ে আবেদন করেছিলেন। রাজ্যের মুখ্যসচিব এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়েছেন। রাজ্য সরকারও চায়, সারনা ও সারি ধর্মকে জনগণনায় মর্যাদা দেওয়া হোক। ফলে ক্রমে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এই দূরত্ব যত বাড়বে, জঙ্গলমহল থেকে বিজেপি ততই তার মাটি হারাবে। ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী সমাজ বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বিজেপিকে চায় না। সেখানে বিজেপি ক্ষমতা-বিচ্যুত। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী সমাজের মানুষও তৈরি হয়েই আছে। শুধু ভোটের অপেক্ষা।