সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
ঝাড়গ্রাম, দুই মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার বহু কেন্দ্রের প্রচুর মানুষের সঙ্গে ভোট নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁদের মতামত জানার চেষ্টা করেছি। তবে, তারপরেও এটাকে ‘জনমত সমীক্ষা’ বলে দাবি করব না। কারণ অধিকাংশ সমীক্ষাই মেলে না। তাই সঞ্চালক জানিয়ে দেন, জনমত সমীক্ষার ফল মিলতেও পারে, নাও পারে। এমনকী, ১০০ শতাংশ ভুলও হতে পারে। তবুও ‘জনমত সমীক্ষা’ করা হয়। অনেকে বলে থাকেন, ভোটারদের প্রভাবিত করতেই নাকি এই ধরনের সমীক্ষার আয়োজন। কিন্তু, কথাটা ভুল। জনমত সমীক্ষার রিপোর্টে জল মিশিয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অক্সিজেন দেওয়া যায়, ভোটারদের প্রভাবিত করা যায় না। ইভিএমের বোতাম টেপার আগে ভোটার রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্য, কাজকর্ম, ভালো-মন্দ বিচার করেন। তার প্রমাণও রয়েছে বিস্তর।
লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির দলকে বিপুল ভোটে জিতিয়েছিলেন দেশবাসী। দেশের সুরক্ষার স্বার্থে সাধারণ মানুষ রাহুল গান্ধীর চেয়ে মোদিকেই যোগ্য মনে করেছিলেন। তাই তাঁর দলকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন। তার কয়েক মাস পর বিধানসভা ভোটে একেবারে উল্টো ছবি। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা সহ একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ বিজেপিকে গোহারা হারিয়ে দিলেন। লোকসভার তুলনায় বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ৯ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত কমেছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, ভোটাররা কতটা সচেতন। তাই ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা বৃথা।
একটা কথা বলতেই হবে, ভোটের হাওয়া কোন দিকে জিজ্ঞাসা করলেই অধিকাংশের উত্তর, ‘লোকে বলছে, এবার বিজেপির হাওয়া।’ পরের প্রশ্ন, আপনি কী বলছেন? তখনই শুরু হয়েছে দোলাচাল। একথা সেকথার পর জানিয়েছেন, ‘দিদিই ভালো। তবে সংশোধন দরকার।’ কেউ কেউ অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিজেপিতেই অটল থেকেছেন। পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দামবৃদ্ধি কি কোনও ইস্যু নয়? উত্তর এসেছে, ‘একবার বদলানো দরকার। দেখা যাক না কী হয়!’ বোঝা গিয়েছে, তাঁদের ভোট যাবে বিজেপিতে। আর চায়ের দোকানের আড্ডায় যাঁরা বিনাপয়সায় রেশন, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী নিয়ে গলা ফাটিয়েছেন, তাঁরা যে তৃণমূলের, সেটা বুঝতেও অসুবিধে হয় না।
এই দু’ধরনের ‘কমিটেড ভোটার’ এর মাথা গুনে কোন দল জিতবে, তা বলা অসম্ভব। সেটা পারে একমাত্র ইভিএম। তাই লক্ষ্য ছিল, দোলাচলে ভোগা ভোটারদের মন বোঝার। নির্বাচনী পরিভাষায় যাঁরা ‘ফ্লোটিং ভোটার’। জয়-পরাজয় নির্ধারণে এঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। খড়্গপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন গোপীবল্লভপুরের রোহিনী গ্রামের বিশ্বজিৎ জানা। ভোটের হাওয়া কী বুঝছেন? উত্তর এল, ‘রাজনীতি করি না। বলতে পারব না।’ এলাকায় উন্নয়ন কেমন হয়েছে? বিশ্বজিৎবাবুর জবাব, ‘প্রচুর কাজ হয়েছে। আমাদের এলাকায় একটি রাস্তা আর মাটির নেই। সব ঢালাই। এমনকী, শ্মশানে যাওয়ার রাস্তাটাও। পাশে বসা ধাংড়ি গ্রামের জোসেফিন সোরেন বলেন, ‘আমাদের গ্রামেও প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ খুশি। তবে, কে জিতবে বলতে পারব না।’
পশ্চিম মেদিনীপুরের কেরানিতলায় নন্দলাল দাসের চা আর চপ-মুড়ির দোকান। দুপুরে দোকানে কয়েকজন চা খাচ্ছিলেন। সেই সময় সাইকেল নিয়ে হাজির খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকার ইন্দ্রজিৎ পাল। ভোটের হাওয়া কী বুঝছেন? ইন্দ্রজিৎবাবুর জবাব, ‘হাওয়া তো একদিকেই বইছে।’ কোন দিকে? উত্তর আসে, ‘লোকে তো বলছে, বিজেপির দিকে।’ জানতে চাই, কারণটা কী? কোনও উত্তর নেই। দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে চপের পুর তৈরি করছিলেন ননা দাস। স্টিলের গ্লাসের পিছন দিয়ে আলু মাখতে মাখতে বলেন, ‘হাওয়া যেদিকে ভোট তার উল্টো দিকে। মানুষ মুখে বলছে এক, করবে তার উল্টোটা। বাক্স খুললে খেলাটা বুঝতে পারবেন।’ মানে? ননাবাবু বিজ্ঞের মতো উত্তর দেন, ‘মানুষ ভালোবাসে বলেই সমালোচনা করছে। মানুষ চাইছে সংশোধন, পরিবর্তন নয়।’
বিষ্ণুপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন চকদহ গ্রামের যুবক সুবোধ লোহার। হাওয়া কোন দিকে জানতে চাইতেই সুবোধবাবুর জবাব, ‘এবার হাওয়া বিজেপির দিকে। হাওয়া জোরদার।’ তাহলে বিষ্ণুপুরে বিজেপিই জিতছে? কিছুটা থমকে যান সুবোধবাবু। তারপর বলেন, ‘সেটা বলা কঠিন। কারণ প্রার্থী নিয়ে বিজেপিতে ভীষণ গোলমাল। তাছাড়া উন্নয়ন হয়েছে প্রচুর। কিন্তু এসএসসি নিয়ে ক্ষোভও আছে বিস্তর। তাই শেষপর্যন্ত কী হবে বলা যাচ্ছে না।’
সুবোধবাবুর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন রাধানগর গ্রামের দুই মহিলা। সম্পর্কে মা- মেয়ে। মেয়ে চাকরির প্রসঙ্গটা লুফে নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। শিক্ষক নিয়োগে এই সরকার ডাহা ফেল। সেই জন্যই একবার বদলানো দরকার।’ বিজেপি এলে চাকরি হবে? রেলে, ব্যাঙ্কে চাকরি হচ্ছে? উত্তর আসে, ‘সেটা বলতে পারব না।’ বোঝা যায়, স্কুলে নিয়োগ নিয়ে শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে ভালোই।
চন্দ্রকোণা রোডে প্রণব ঘোষের দোকানে চাল কিনতে এসেছিলেন নয়াবসক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ হাজরা। প্রণববাবু বলেন, ‘আমি ব্যবসা নিয়েই থাকি। বলতে পারব না। ইনি আমাদের মাস্টারমশাই। ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন।’ ইন্দ্রজিৎবাবু বলেন, ‘হাওয়া বিজেপির দিকে। তবে, এই হাওয়া দিয়ে ভোট মাপতে যাবেন না। রাজ্যের অর্ধেক ভোটার মহিলা। ঘরের হেঁশেলটা তাঁরাই সামলান। আমার মনে হয়, মহিলা ভোট এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই ঢলবে। বিশেষ করে গ্রামে। এবারের ভোটে মহিলা ভোটের অঙ্কটাই আসল।’ বঙ্গের মহিলা ভোট যে মমতামুখী, সে খবর পৌঁছেছে গেরুয়া শিবিরের অন্দরেও। সেই কারণে বিজেপি অকাতরে মহিলাদের জন্য প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছে। সবচেয়ে বড় চমক, ক্ষমতায় এলে সমস্ত সরকারি বাসে মহিলাদের বিনা খরচে যাতায়াতের সুযোগ। তবে, এনিয়ে শুরু হয়েছে তৃণমূল শিবিরের কটাক্ষ, এতই যদি মহিলাদের জন্য দরদ, তাহলে বিজেপি শাসিত রাজ্যে এটা চালু করেনি কেন? রেলে মহিলাদের টিকিট কেটে যাতায়াত করতে হয় কেন? সব ধাপ্পাবাজি।
কথায় আছে, অভিজ্ঞতা হচ্ছে বড় শিক্ষক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বুঝেছে, সুইস ব্যাঙ্কের কালোটাকা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি ধাপ্পা ছিল। প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল ভাঁওতা। দেশের ব্যাঙ্ক ফাঁকা করে দিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের ফিরিয়ে আনতে পারেনি। মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে, নির্বাচনী ইস্তাহার আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকটা অনেক। চায়ের কাপ আর ঠোঁটের গ্যাপটা কখনওই ঘোচে না।
‘বাংলার বাঘিনী’কে খাঁচাবন্দি করতে বিজেপি নেতৃত্ব সিবিআই, ইডি, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। কমিশনের কাজকর্ম নিয়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। বিজেপির নামীদামি নেতা, মন্ত্রীরা বঙ্গে ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করেছেন। তবে তাঁদের ‘মান্থলি’র মেয়াদ ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। ওইদিনই এরাজ্যে শেষ প্রচার। তাঁদের কাণ্ডকারখানা দেখে অনেকে বলছেন, বিজেপি এখানে বড়লোকের ‘মাথামোটা’ ছেলেকে ফার্স্ট করানোর লড়াইয়ে নেমেছে। তারজন্য ডজন ডজন টিউটর দিনরাত খাটছেনও। কিন্তু ‘ইউনিট টেস্টে’র রেজাল্ট দেখে শিক্ষক শিবিরেও নামছে হতাশা। জনসভাগুলিতে ভিড় দিন দিন কমছে। এখন এমন অবস্থা, ফার্স্ট হওয়া তো দূরের কথা, ছাত্র টেনেটুনে পাসমার্ক পেলেই বর্তে যান ‘মাস্টারমশাই’রা।