সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
হতেই বিজেপি কর্মীদের ক্ষোভ এভাবে আছড়ে পড়ল কেন? ভাঙচুর, আগুন, আত্মহত্যার চেষ্টা, কিছুই বাদ নেই। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উঠছে মারাত্মক অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে দলবদলুদের নির্বাচনের টিকিট। এসব দেখে লোকজন বলছেন, ‘রামচন্দ্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই লঙ্কাকাণ্ড শুরু।’ নজিরবিহীন। এ সব দেখে কেউ কেউ টিপ্পনি কেটে বলছেন, দেখ কেমন লাগে?
‘যোগদান মেলায়’ বিজেপির অনেক নেতা মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘এই তো সবে শুরু, ছবি অনেক বাকি।’ কেউ কেউ সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচন ঘোষণা হলে সব বিজেপিতে চলে আসবে। তৃণমূল দলটাই থাকবে না।’ তৃণমূলের তালিকা প্রকাশের পর গেরুয়া শিবিরে যোগদানের হিড়িক কিঞ্চিৎ বেড়েছিল। আর তাতে বিজেপি নেতাদের মুখের হাসি চওড়াও হয়েছিল। কিন্তু নেতারা তখন বাংলার বহুল প্রচলিত প্রবাদটা ভুলে গিয়েছিলেন, ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে।’
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটাই লক্ষ্য, বাংলা দখল। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে তাঁরা তৃণমূলের ঝড়তি পড়তিদের জন্যও দরজা হাট করে খুলে রেখেছিলেন। নিচুতলার কর্মীরা বুঝেছিলেন, খাল কেটে কুমির আনা হচ্ছে। ঠেকাতে না পারলে একদিন এই কুমিরের পেটেই তাঁদের যেতে হবে। সেই কারণে দিকে দিকে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। তাঁদের আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, সেটা প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হতেই টের পাচ্ছেন। তাই যাঁরা তৃণমূলের অত্যাচার সহ্য করে বিজেপির ঝান্ডা আঁকড়ে ধরেছিলেন, তাঁরা দলকে ‘সংশোধনে’র জন্য রাস্তায় নেমেছেন। তাঁরাও বুঝতে পারছেন, দলবদলুদের ভিড়ে বিজেপি দিন দিন তৃণমূলের ‘বি’ টিম হয়ে যাচ্ছে।
বিজেপির আদি কর্মীদের ক্ষোভটা ঠিক এখানেই। মহাত্মা গান্ধীর চশমার ছবি ছাপিয়ে ‘স্বচ্ছ ভারতে’র স্বপ্ন দেখিয়েছিল বিজেপি। গান্ধীজি এখনও প্রতিটি ভারতবাসীর চোখে ত্যাগের প্রতীক। নরেন্দ্র মোদির দল সর্বক্ষেত্রে সেই স্বচ্ছতার কথা বলে নোট বাতিল থেকে জিএসটির মতো একের পর এক ‘ভয়ঙ্কর’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সমস্যায় জর্জরিত দেশবাসী একটা ভালো কিছুর প্রত্যাশায় সব সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফল হয়েছে উল্টো। সুরাহার বদলে দেশের মানুষের ঘাড়ে চেপেছে বোঝা। যত দিন যাচ্ছে বিজেপির কথা আর কাজের ফারাকটা মানুষ বুঝতে পারছেন। নির্বাচনের মুখে দলের কর্মীরাও উপলব্ধি করছেন, নেতারা মুখে যা বলেন, করেন ঠিক তার উল্টোটা। তাই এবার দলের ভিতর থেকে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ।
বিজেপির এই অবস্থা দেখে সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে যাচ্ছেন দলবদলুরা। তাঁরা ‘সোনার বাংলা’র কারিগর হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিজেপিতে গিয়েছিলেন। প্রায় সকলের মুখেই শোনা গিয়েছিল তৃণমূলে তাঁদের দমবন্ধ হওয়ার কথা। তাঁরা নাকি সম্মান পাচ্ছিলেন না। তাই বুকভরে প্রশ্বাস নেওয়ার ও সম্মানিত হওয়ার আশায় বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু, মাস দু’য়েক যেতে না যেতেই রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
বিজেপিতে যোগদানের পর থেকেই তিনি দফায় দফায় ‘সম্মানিত’ হয়েছেন। তবে, সবচেয়ে বেশি ‘সম্মানিত’ হয়েছিলেন বিজেপির পরিবর্তন যাত্রার সময়। বিজেপি কর্মীরা তাঁকে জঙ্গলের মধ্যেই রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর এই ‘পরিবর্তন’ তাঁদের নাপসন্দ। তাও শ্যামাপ্রসাদবাবু সব হজম করেছিলেন। কিন্তু বিষ্ণুপুরের টিকিট হাতছাড়া হতেই ফের তাঁর ‘শ্বাসকষ্ট’ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে ছটফটানি। তাই ‘অক্সিজেনে’র আশায় দুর্গাপুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ছুটেছিলেন। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রী ফিরেও তাকাননি। শ্যামাপ্রসাদবাবুর এই অবস্থা দেখে অনেকে বলছেন, ‘শ্যামাপ্রসাদের এখন শ্যামও গেল, কূলও গেল।’ বেচারা!
২৯৪টি আসনের জন্য আট দফায় ভোট। নির্বিঘ্নে ভোট সুসম্পন্ন করার জন্য ইতিমধ্যেই ৪৯৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এসে গিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে বলে খবর। একি ভোটের প্রস্তুতি, নাকি যুদ্ধ? বলা বেশ কঠিন।
তবে যাঁদের জন্য এই এলাহি আয়োজন, সেই ভোটারদের দিন দিন কেমন যেন ‘বেসুরো’ ঠেকছে। এতদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভায় তবুও লোকজন হচ্ছিল। কিন্তু ঝাড়গ্রামের সভায় তাল কেটে গেল। উপস্থিতির যা বহর, তাতে জনসভা করলে শোরগোল পড়ে যেত। তাই সভার রূপান্তর ঘটল। হল ভার্চুয়াল সভা। আর মানুষেরই বা কী দোষ? রোজ যদি কেন্দ্রের, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা মিটিং, পদযাত্রা করেন, তাঁদের সভা ভরানোর দায় জনগণ নেবে কেন? নেতা, মন্ত্রীদের কাজ না থাকতেই পারে। খেটে খাওয়া মানুষজনের কাজ আছে তো নাকি?
দিন কয়েক হল রাজ্যবাসী একটা ঘটনা খুব মিস করছেন। বাউল শিল্পী, দলিত, খেতমজুরদের বাড়িতে নেতাদের মধ্যাহ্নভোজ পর্বটা আর দেখা যাচ্ছে না। উঠে গেল নাকি! ব্যাপারটার মধ্যে বেশ অভিনবত্ব ছিল। দিল্লি, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ থেকে হাওয়াই জাহাজে চেপে এসে দলিতের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ। হাতে সময় থাকলে বাউল শিল্পীর গান শোনা, আর ভাষা না বুঝলেও বোদ্ধার স্টাইলে তাল ঠোকা। চিত্রনাট্য মাফিক সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ঘেঁটে দিল এই প্রার্থী তালিকা। ‘কঠোর অনুশাসনে’ বাঁধা পার্টির প্রার্থী তালিকা নিয়ে যে এমন কাদা ছোড়াছুড়ি হবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। এটাও বঙ্গে অভিনব বটে।
এত কাণ্ডকারখানার পরেও শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা চলছে। বিজেপি নেতাদের কথায়, ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার। দল বড় হচ্ছে। প্রার্থী হওয়ার দাবিদার অনেক। তাই একটু ক্ষোভ বিক্ষোভ হতেই পারে।’
বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড এই বিক্ষোভকে হালকা করে দেখানোর চেষ্টা করলেও দিল্লির কর্তারা বুঝতে পারছেন, গলদ রয়েছে গোড়াতেই। লোকে তো বলবেই, প্রার্থী নিয়েই যদি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি হয়, তাহলে জিতলে কী হবে? সেটা বুঝেই ‘বিজেপির চাণক্য’ গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করেছেন। তাতেও সূত্র না মেলায় বাংলার নেতাদের দিল্লিতে তলব করেছেন। যে কোনও মূল্যে বিক্ষোভ সামাল দিতে চাইছেন। কিন্তু এ তো জয়নগরের মোয়া নয়, যে চাইলেই পাবে।
প্রার্থী নিয়ে বিজেপির এখন শাঁখের করাতের অবস্থা। যেতেও কাটছে, আসতেও কাটছে। দলবদলুদের প্রার্থী করলে আদিদের বিদ্রোহ। আবার আদিদের গুরুত্ব দিলে দলবদলুরা চটবেন। বিজেপি নেতারা যতই দাবি করুন, প্রার্থী করার শর্ত মেনে কাউকে যোগদান করানো হয়নি, বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। বিজেপিতে যোগদান করেই টিকিট পাওয়ার নজির নেহাত কম নয়। বিজেপির আদিরা বুঝেছেন, দলবদলুদের ভোট দিয়ে জেতালে ক্ষমতা বদলানো যাবে, কিন্তু তাঁদের ভাগ্য বদলাবে না।
দলের কর্মীদের ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখে বিজেপির চাণক্য এমন ভাব দেখাচ্ছেন, যেন তিনি কিছুই জানতেন না। অথচ সবাই জানে এবং মানে, তাঁর দাপটে বঙ্গ বিজেপিতে বাঘে-গোরুতে একসঙ্গে জল খায়। হাজার হাজার মানুষকে সাক্ষী রেখে তিনিই হাসি মুখে তৃণমূলের একের পর এক নেতার হাতে বিজেপির পতাকা তুলে দিয়েছেন। তিনিই ২০০ আসনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু অঙ্ক কষতে গিয়ে দেখছেন, দলের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। তাই তৃণমূলের ‘রিজার্ভ বেঞ্চে’র প্লেয়ার তুলে এনে টিম তৈরি করতে নেমেছেন। আর এ সব যে তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত, সেটা একটা শিশুও বোঝে। তাই বিক্ষোভের সমস্ত দায় রাজ্য নেতৃত্বের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও মানুষ তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বহু বছর আগে লিখেছিলেন, ‘সবাই দেখছে যে রাজা উলঙ্গ, তবুও/ সবাই হাততালি দিচ্ছে/ সবাই চেঁচিয়ে বলছে, শাবাশ, শাবাশ/ কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়’। বিজেপির অবস্থা দেখে বারবার কবির ‘উলঙ্গ রাজা’র সেই শিশুটির কথা মনে পড়ছে, ‘সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে নির্ভয়ে দাঁড়াক/ সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করুক: রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’ বিজেপির বিক্ষোভকারী আদি নেতা কর্মীরা হলেন সেই ‘শিশুর দল’।