সন্তানের বিদ্যাশিক্ষায় নজর দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরে অবনতি। নানাভাবে অর্থ অপচয়। কর্মপরিবর্তনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি।প্রতিকার: ... বিশদ
গতবার করোনার জেরে আম বাঙালি পুজোয় একটু সুতোও কিনতে পারেনি। পুরনো জামাকাপড়েই বিবর্ণ উৎসব পালিত হয়েছে। কিন্তু নেতানেত্রীর বেচাকেনার হাট ছিল জমজমাট। কালীপুজো থেকেই শুরু হয়ে যায় যাকে বলে বাম্পার সেল! এ হাটে ক্রেতা বহিরাগত গেরুয়াধারী কিছু রাজনীতির কারবারি। টানা একবছর ধরে নেতা কিনেও এখন বহু কেন্দ্রে প্রার্থীই মিলছে না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে বুথে বসবে কে? জেলায় একটার পর একটা গেরুয়া অফিসে ভাঙচুর আগুন। সব দেখেশুনে ক্ষুব্ধ অমিত শাহদের ভাবটা এমন যে নেতাদের দিয়ে কিস্যুটি হবে না। পরিত্রাতা তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী। মুঠোফোনে বার্তা যাচ্ছে, ‘অউর দো শো কোম্পানি ভেজ দো’। পুলিসকে দূরে সরিয়ে শেষে কি বাহিনী দিয়েই রাজ্য দখল করতে হবে! বিরোধীদের অভিযোগ, সেই জন্যই ভোটের সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত করা হয়েছে। কমিশনে নালিশও হয়েছে তা নিয়ে। কাশ্মীরে অনেক ঢাক ঢোল পিঠিয়ে বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময়ও দু’দফায় বাহিনী পাঠানো হয়েছিল পঞ্চাশ হাজারের আশপাশে। ২০১৯’র আগস্টের সেই হিসেবটাই দেখছিলাম। দেশে সব মিলিয়ে কত কেন্দ্রীয় বাহিনী আছে জানেন, দশ লক্ষের কিছু বেশি। তার মধ্যে সোয়া এক লক্ষই যদি বাংলায় আসে, তাহলে বাকি ভারতে নিশ্চয়ই রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে। অপরাধ, খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ বলে কিছু নেই! বাহ, মোদিজি বাহ, লকডাউনের বর্ষপূর্তিতে আর বাসন নয় দু’হাতে তালি বাজান!
আমার এক উঠতি লেখক বন্ধু বলছিল, বিজেপির প্রার্থী তালিকা দেখে মনে হচ্ছে, কোনও জাল পাইরেটেড বইয়ের মেলা বসছে বুঝি! যেখানে শতকরা আশি শতাংশ বইই অন্য প্রকাশনার হুবহু নকল। কিংবা নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভাঙিয়ে আনা। স্রেফ কপি করা। এমন কোনও গাড়ির মেলায় কি কেউ কোনওদিন গিয়েছেন যেখানে অধিকাংশ বাহনের নকশাই প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে চুরি করা! অথচ গেরুয়া প্রার্থী তালিকাটাই লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়ে আনা বাতিল তৃণমূলীতে ভরা। চীনের প্রযুক্তি কপি করার খ্যাতি-অখ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। মুখে যতই আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলে বেজিংকে ব্রাত্য করার চেষ্টা হোক, সবাই জানে নরেন্দ্র মোদির নজরও কিন্তু সেই দিকেই। রামকৃষ্ণ কথামৃতে একটা সার কথা বলা আছে, শকুন যতই মাটির উপর দিয়ে উড়ুক, নজর আসলে তার ভাগাড়ের দিকেই নিবদ্ধ। বিজেপিরও যেন ঠিক সেই দশা। তারই প্রতিফলন দেখছে এবারের বাংলার নির্বাচন। এখনও পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তা তো বিক্ষুব্ধ দমবন্ধ তৃণমূলে ভরা। ওই তালিকা দেখিয়ে কোন বাংলার স্বপ্ন ফেরি করতে চান গুটখা খাওয়া অবাঙালি নেতারা? এও তো বাংলার অগ্নিকন্যারই সাফল্য। নেত্রীর হাতে গড়া সংগ্রামী দলটাকে ভাঙাতে সমগ্র কেন্দ্রীয় সরকার আজ মরিয়া। আর তিনি ভাঙা জখম পা নিয়েই জেলায় জেলায় শত্রুর মোকাবিলা করে চলেছেন, ব্যথাকে হার মানিয়ে হাসি মুখে কখনও গড়বেতা, কখনও লালগড়, কখনও পটাশপুর আবার কখনও নন্দীগ্রামে আওয়াজ তুলছেন, খেলা হবে। তবে খেলাটা তাঁর একার নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে যুক্ত।
দেখে শুনে মনে হয়, শিক্ষা, বিকাশ, স্বাস্থ্য আর মানুষের উন্নয়নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যটাকে বেইমান দলবদলু আর ফুরিয়ে যাওয়া অভিনেতা, অভিনেত্রীর আস্তাকুঁড়ে পরিণত করতেই মরিয়া অমিত শাহরা। সীমাহীন অনাচারের শুরু সেখানেই। সিন্ডিকেটের মাথাদের দলে এনে কোন মন্ত্রে মেদিনীপুর হলদিয়ায় তোলাবাজি খতম হবে তাঁর ব্যাখ্যা দিলীপ ঘোষদের হাতে নেই। এই বাংলায় বারে বারে ভোট এসেছে গিয়েছে। নীতির লড়াইয়ে কেউ জিতেছেন কেউ হেরেছেন। কিন্তু কোনও স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের এমন প্রার্থী তালিকা দেখেছেন যার সিংহভাগই অন্যদল থেকে ভাঙিয়ে আনা কিংবা ভাড়া করা। কারও অনেক পাওয়ার লোভ, আবার কারও জেল থেকে বাঁচার তাগিদ। ভোট মিটলে টিকিও দেখা যাবে না অনেকেরই। এতকিছুর পরও তালিকায় নাম থাকা অনেকে আবার বলছেন, আমি তো ও দলে নেই, কীভাবে আমার নাম তালিকায় ঢুকল জানি না তো! এসব দেখে আসল বিজেপি করা লোকজন তো মুখ লুকিয়ে ঘরে বসে কাঁদছেন আর গাইছেন, ‘কখন যে বসন্ত গেল এবার হল না গান!’ সোনার পার্টিতে বোধহয় এমনটাই ভবিতব্য। বলতেই হয়, এমন রং বদলানো পরজীবীদের হাতে রাজ্যের ভবিষ্যৎ মোটেই সুরক্ষিত থাকতে পারে না। এ তো প্রার্থী তালিকা নয়, বাছাই করা একঝাঁক মীরজাফর আর হাতে কাজ না থাকা ফিল্মি তারকার হট্টমেলা। এঁরা করবে দেশোদ্ধার? এমন প্রার্থী বাছলে সোনার বাংলা দূরে থাক, ঘুঁটের বাংলাও অধরা থেকে যাবে যে! তার চেয়ে বাংলা মায়ের স্নেহমাখা কষ্টের মোটা কাপড়ই তো ভালো!
ওই যে বলছিলাম, এই সর্বনাশের খেলাটা শুরুটা হয়েছে গতবছর কালীপুজোর পরপরই। বিজেপির বাংলা দখলের অভিযান, অপারেশন বেঙ্গল। টাকা ফেল আর দমবন্ধ হওয়া বিক্ষুব্ধ নেতা ঘরে তোলো। যেন মোহন বাগান ইস্ট বেঙ্গলের খেলোয়াড় কেনাবেচা চলছে। হাফলাইনের কিংবা ফরওয়ার্ডের একটা প্লেয়ার কিনে টিম বানানো এক জিনিস। আর ব্যাক, হাফলাইন, ফরওয়ার্ড লাইন, গোলকিপার কিছুই নেই, প্রতিপক্ষের থেকে ভাঙিয়ে এনে পুরো দলটা তৈরি করা তো সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ব্যাপার। চূড়ান্ত বেহায়াপনা। দেশে যেন আর কোনও সমস্যাই নেই। সবাই চাকরি পেয়ে গিয়েছে। সবার থালায় ভাত। মাটির উপর ছাদ। ঘরে ঘরে পরিস্রুত পানীয় জল। আর সেই সাফল্যের জোরেই বাংলার দু’বিঘা জমি দখলে সমগ্র গেরুয়া শিবির নেশায় বুঁদ। সঙ্গে ত্রিতালে তবলা বাজাচ্ছে সিবিআই, আর কত্তাল বাজাচ্ছে ইডি। এই লড়াইতেও বাংলার নিজের মেয়ের সঙ্গে আর সকলের সম্মিলিত লড়াই। ২ মে বাংলার সেই অন্তরাত্মারই জয় দেখতে সমগ্র জাতি উদগ্রীব।
দেশভাগ, মন্বন্তর, মহামারীর আঘাতে এমনিতেই বাংলা ও বাঙালির অবস্থা কাহিল। তার উপর একটা সামান্য তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে গেরুয়া শিবিরেই যেভাবে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে, তাতে আর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। অর্থ আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙানোর সীমাহীন অন্যায় এবার ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে বহিরাগত বর্গী, মেনন, দেওধরদের দিকেই। আকাশে বাতাসে একটাই আওয়াজ, একটাই সুরের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ আর যাই হোক ত্রিপুরা নয়। শোনা যায় এই পরিস্থিতিতে বাংলা দখলের স্বপ্নে মশগুল অমিত শাহও নাকি ভীষণ ক্ষুব্ধ। জলপাইগুড়ি, মালদহ, সিঙ্গুর, দমদম, চুচুঁড়া দুই চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে শুরু করে গোটা রাজ্যে এখন যেন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। যে দল দাঙ্গা লাগায়, মানুষে মানুষে বিভেদ আর বিভাজনের নোংরা রাজনীতি নিয়ে অশান্তি তৈরি করে তারাই এবার অজান্তে নিজেদের দলের ভিতরই ক্ষোভের বিষ বপন করেছে। যাকে বলে অতি লোভে তাঁতি নষ্ট! হিন্দু মুসলমানের বিভাজনের রাজনীতি করতে করতে আজ এ রাজ্যের গেরুয়া শিবিরও আদি আর নব্য এই দুভাগে আড়াআড়ি বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। একটার পর একটা কেন্দ্র আর এলাকায় দলের পুরনো মার খাওয়া কর্মী আর সুযোগসন্ধানী উড়ে এসে জুড়ে বসা দলবদলুরা আজ সম্মুখসমরে। এই বিদ্বেষ আর ঘৃণার রাজনীতি থেকে বাংলাকে বাঁচাতে হলে এই বিষাক্ত শক্তিকে পরাজিত করতেই হবে। অনাচার রুখতে হবে। নাহলে বিষ মাথায় চড়ে যাবে। একদিকে দলবদলু আর বেইমানদের নৃত্য চলছে আর অন্যদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনী, সিবিআই ও ইডি একযোগে অমিত শাহের অঙ্গুলি হেলনে রাজ্যটাকে অশান্ত করার যাবতীয় চেষ্টা চালাচ্ছে।
কিন্তু ভোট একদিন মিটে যাবে। বহিরাগতরাও কল্কে না পেয়ে পালিয়ে যাবে। সকাল বিকেল মিথ্যে সোনার বাংলা গড়ার ডাক আর শোনা যাবে না। কিন্তু মেনন, শর্মা, শাহ, বর্গীরা কেটে পড়লেও আমরা বাঙালিরা কিন্তু তখনও থাকব। একটা কথা সবার মনে রাখা উচিত যে এমন অবিশ্বাস আর শত্রুতার সম্পর্ক তৈরি না হয় যাতে চিরতরে হেসে কথা বলাই বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাসে বাইরের শক্তি যখনই বাংলাকে দখলের খোয়াব দেখেছে তখনই প্রথমে সমাজটাকে বহু ভাগে ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এবারও হবে না। বাংলাকে এবারও ঐক্যবদ্ধভাবে বাইরের গুন্ডাদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে। শেষ কথা বলবে ২ মে।