বিজেপিকে কেন জেতাতে হবে, ক্ষমতায় আনতে হবে? তার ব্যাখ্যা অটলবিহারী বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদবানি প্রমুখ অনেক আগেই দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল কংগ্রেস। বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ ছিল, স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেস শুধু ক্ষমতা ভোগ করেছে। দেশটাকে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। দেশটা দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে। দিকে দিকে লুটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। দেশের সম্পদ নির্বিচারে বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। সমান্তরাল প্রশাসন গড়ে তুলেছে কালো টাকার চক্র। দুর্বৃত্তায়নে দূষিত হয়ে গিয়েছে মহান ভারতের রাজনীতি। তাই দারিদ্র্য কমেনি। গরিব আরও গরিব হয়েছে। আয়, জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সবেতেই গরিব বঞ্চিত রয়ে গিয়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে। বেড়েছে ধনবৈষম্য। কংগ্রেস এবং তার দোসরদের তোষণের রাজনীতির পরিণামে নষ্ট হয়েছে সম্প্রীতির পরিবেশ। দেশের কোনও উন্নতি হয়নি। সব মিলিয়ে দেশ পিছিয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের হাতে পড়ে বস্তুত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে দেশ। বাজপেয়ি-আদবানিরা বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতা পেলে ভারতকে ওই পাঁক থেকে দ্রুত টেনে তুলবেন। ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে। মোদ্দা কথা, গেরুয়া শিবির সেদিন পুরাণের রামরাজ্যের শিহরন এনে দিয়েছিল ভারতবাসীর মনে। 
বাজপেয়ি-আদবানিরা সেকথা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাজপেয়ি একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন। কিন্তু তাঁর ‘ফিল গুড’ তত্ত্ব মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল দ্রুত। মানুষ ফের দু’টি টার্ম মঞ্জুর করল কংগ্রেসকে। মনমোহন সিং টানা দশবছর ইউপিএ-র প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির কথার জাদুর কাছে পরাস্ত হলেন বিশ্বের অগ্রগণ্য অর্থনীতিবিদ-প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বলা বাহুল্য, সেদিন জাতীয় রাজনীতিতে মোদি প্রায় অপরিচিত এক নাম। তাঁর পরিচয় বলতে তিনি প্রান্তিক রাজ্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, গোধরা-কাণ্ডের সুবাদে যিনি এক বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। নিজেকে ‘চা-ওয়ালা’ পরিচয়ে যেভাবে বেচলেন এবং ‘ভারতেশ্বর’-এর মুকুট মাথায় তুলে নিলেন, তাতে প্রমাণ হয়ে গেল তিনি কত বড় সেলসম্যান! কিন্তু মোদির উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব কী কী? একজন সাধারণ নাগরিকও এর সুদীর্ঘ তালিকা দিতে পারেন, যা কোনওভাবেই ইতিবাচক বা আশাব্যঞ্জক কিছু নয়: নোটবন্দি। ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি। পুলওয়ামার রক্তাক্ত ইতিহাস। তার নাটকীয় বদলা। চীন ও নেপালের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ বৃদ্ধি। কাশ্মীর সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলা। আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে চরম দুর্দশায় ফেলা। তেল ও গ্যাসের রেকর্ড দাম বৃদ্ধি। গরিব ও মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের উপর সুদের হার তলানিতে নিয়ে যাওয়া। সরকারি চাকরির দরজা ক্রমশ সঙ্কুচিত করে ফেলা। কিছু লাভজনক সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণ। দিকে দিকে কর্পোরেটদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি। বিতর্কিত কৃষি আইন তৈরি করে কৃষক সমাজসহ সাধারণ মানুষের স্বার্থ বিপন্ন করে তোলা। আর অবশ্যই বেড়েছে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস। উত্তরপ্রদেশসহ কয়েকটি রাজ্যে বিশেষভাবে বেড়েছে দলিত, মুসলিম ও মহিলাদের দুর্দশা। এনআরসি, সিএএ-র যন্ত্রণা। মোদি কত বড় সেলসম্যান সেটা সারা পৃথিবী আরও একবার দেখেছে, অভিযোগ আর বদনামের পাহাড় কাঁধে নিয়েও ২০১৯-এ তিনি পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে আসীন হয়েছেন দ্বিতীয়বার! 
কিন্তু তার পরেও কি কোনও সুরাহা হয়েছে মানুষের? অযোধ্যায় রামমন্দির (বিজেপির অ্যাজেন্ডার এক নম্বরে জ্বলজ্বল করছে যেটা বহু বছর ধরে) নির্মাণের পথ প্রশস্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারে না এই পোড়ার দেশের মানুষ। করোনার মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত দেশবাসীর হাল গত এক বছরে আরও খারাপ হয়েছে। এই ভারতবাসী নিজেকে কতটা সুখী ভাবতে পারবে? আমরা যা জানার তা জানি। কিল খেয়েই কিল হজম করছে মানুষ। কিন্তু এটা যে তথ্যের যুগ। ঘরের দৈন্যও লুকনোর সাধ্য কারও নেই। মোদির ভারতও পারেনি। শনিবার ছিল আন্তর্জাতিক সুখ দিবস। সেদিনই প্রকাশিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২১। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্কের সমীক্ষার ভিত্তিতে ওই রিপোর্ট প্রস্তুত হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুসারে, সমীক্ষায় গৃহীত ১৪৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৩৯তম। আমরা যাদের পিছিয়ে পড়া দেশ বলে মনে করি, দুই প্রান্তের সেই দুই ছোট প্রতিবেশী বাংলাদেশ (১০১) এবং পাকিস্তান (১০৫) এই প্রশ্নে আমাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে। একনায়কের দেশ বলে কথিত চীনও (৮৪) আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। তালিকায় সবার উপরে রয়েছে ফিনল্যান্ড। ইউরোপের এই দেশটি এই নিয়ে টানা চারবার সবচেয়ে সুখী দেশের শিরোপা ধরে রাখল। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের মানুষকেই সবচেয়ে দুঃখী বলে চিহ্নিত করেছে এই আন্তর্জাতিক রিপোর্ট।  আমরা তার থেকে মাত্র দশ ধাপ উপরে রয়েছি! ভারতবাসীকে আজ সান্ত্বনা পেতে হবে আফগানিস্তানকে সামনে রেখে—না, আমরা ওদের থেকে তো ভালো আছি! হায় মোদির সুশাসন!