উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ মেইজ রিসার্চ-এর বিজ্ঞানীরা মাঝেমধ্যেই কৃষকদের ভুট্টার জমি পরিদর্শন করে যাচ্ছেন। রাজ্য কৃষি দপ্তরের বীজ শংসিতকরণ বিভাগের আধিকারিকরাও সরেজমিনে পরিদর্শন করছেন। বীজের গুণমান খতিয়ে দেখে কৃষকদের শংসাপত্র দেবেন তাঁরা। তার পর সেই বীজ প্যাকেটজাত হবে বিক্রির জন্য। হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদন করে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটেছে বলে দাবি। ফলে ধান চাষ ছেড়ে নদীয়ার ওইসব অঞ্চলের নতুন নতুন কৃষক ভুট্টার বীজ উৎপাদনে উৎসাহিত হচ্ছেন। বাড়ছে ভুট্টা চাষের এলাকা। কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যে প্রতি বছর সাড়ে পাঁচ হাজার টন ভুট্টা বীজের প্রয়োজন। যার বেশিরভাগটাই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সরবরাহ করে। কৃষকরা যদি ভুট্টার উন্নতমানের বীজ উৎপাদন করেন, তা হলে বিক্রির যথেষ্টই সম্ভাবনা রয়েছে।
নদীয়ার কৃষ্ণনগর ১ ব্লকের কুলগাছি গ্রামের কৃষকদের ভুট্টার বীজ উৎপাদনে সাফল্য কেন্দ্র ও রাজ্য থেকে পুরস্কার এনে দিয়েছে। কৃষিকাজে তাঁদের সাফল্য প্রত্যক্ষ করতে কয়েকবছর আগে কুলগাছি ঘুরে গিয়েছেন সিকিমের কৃষিমন্ত্রী। এসেছেন ভুট্টা নিয়ে গবেষণা করা ভিনরাজ্যের বিজ্ঞানীরাও। কৃষি দপ্তরের নদীয়া জেলার বীজ শংসিতকরণ আধিকারিক বীরেশচন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, কুলগাছি সহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা খুব ভালোভাবে হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদন করছেন। এ ব্যাপারে তাঁরা যথেষ্টই অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। ফলে নতুন নতুন জাত তাঁদের দিয়ে চাষ করাতে ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কৃষি দপ্তরের পক্ষ থেকে বর্তমানে এখানকার কৃষকদের হাইব্রিড ভুট্টার পাঁচটি জাত দেওয়া হয়েছে। তাঁরা তা জমিতে লাগিয়েছেন। এবং এখনও পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে ফল ভালোই হবে।
হাইব্রিড ভুট্টার পাশাপাশি কুলগাছি গ্রামের কৃষকরা ধান, কলাই, মুসুর, খেসারি, সর্ষে ও সূর্যমুখীর বীজ উৎপাদন করছেন। একটি কৃষক সঙ্ঘও গড়ে তুলেছেন তাঁরা। ওই কৃষক সঙ্ঘের পক্ষে চাষি নৃপেন্দ্রনাথ রায়, গুরুদাস মণ্ডল জানিয়েছেন, আগে কুলগাছি এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমিতে ধান চাষ হতো। কিন্তু ধানচাষে একেবারেই লাভ মিলছিল না। সেচের সমস্যাও বাড়ছিল। তার পরই তাঁরা ভুট্টার বীজ উৎপাদনের দিকে ঝোঁকেন। শুরুটা করেন ২০০৫ সালে। প্রথমে এইচকিউপিএম-১ জাতটি চাষ করা হয়। পরবর্তীতে এইচকিউপিএম-৫, এইচকিউপিএম-৭, ভিকিউপিএম-৯, এইচএম-৪ জাতের ভুট্টা চাষ করে বীজ উৎপাদন করেন তাঁরা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একই জাতের চাষ করার ফলে ফলন কমতে থাকে। ফলে বীজ বিক্রিতে ভাটা পড়ে। এবছর থেকে আবার নতুন জাতের চাষ শুরু হয়েছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, এবার তাঁরা এইচকিউপিএম-১, ভিএমএইচ-৪৫, ডিএমএইচ-১১৭, ডিআরএমএইচ-১৩০১, ডিএমএইচ-১২১, পিজেএমএইচ-১, সিওএমএইচ-৮, সিওএইচএম-৬ জাতের হাইব্রিড ভুট্টা চাষ করেছেন বীজ উৎপাদনের জন্য। বেশ কয়েকটি জাতের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ মেইজ রিসার্চ থেকে ব্রিডার বীজ দেওয়া হয়েছে।
কীভাবে হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদন করছেন কৃষকরা?
কৃষকরা জানিয়েছেন, হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদনের জন্য মূলত রবি মরশুমেই চাষ করেন তাঁরা। অক্টোবর থেকে জানুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত বীজ বোনার কাজ করে থাকেন। কিন্তু, নভেম্বরের মধ্যেই বীজ বোনার শেষ করে ফেলতে পারলে ভালো। চাষ দিয়ে জমিতে মূল সার হিসেবে বিঘা প্রতি এক বস্তা ১০:২৬:২৬ প্রয়োগ করতে হবে। পুরুষ ভুট্টার একটি সারির পর তিন-চার সারি স্ত্রী ভুট্টার বীজ লাগাতে হবে। পুরুষ জাত দিয়ে সারি তৈরি শুরু করতে হবে। আবার পুরুষ বীজের সারি দিয়েই জমিতে বীজ বোনা শেষ করতে হবে। পূর্ব-পশ্চিম দিক বরাবর লাগাতে পারলে ভালো। সারি থেকে সারি ২৪ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছ ১০ ইঞ্চি দূরত্ব রাখতে হবে। একহাঁটু উচ্চতা হলে গাছের গোড়ায় মাটি ধরিয়ে দিতে হবে।
অনেক কৃষক ভুট্টা কাটার কিছুদিন আগে জমিতে পাটের বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে যখন ভুট্টা কাটা হচ্ছে, তখন পাট একহাঁটু হয়ে যাচ্ছে। ভুট্টার জমিতে যেহেতু বেশ ভালোই সার দেওয়া হয়ে থাকে, ফলে পাটের জন্য প্রাথমিক অবস্থায় আলাদা করে সার প্রয়োগ করতে হচ্ছে না। পাশাপাশি ভুট্টার জমিতে যে রস থাকে, তাতেই পাটবীজের অঙ্কুরোদগম হয়ে যায়। সেইসঙ্গে সময়ে পাটচাষ শুরু করা যাবে। কারণ, ভুট্টা কেটে পাট লাগাতে গেলে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। বৃষ্টি কম হলে ভুট্টায় ৬-৭টি সেচ দিতে হয়। বিঘায় ২ কেজির মতো স্ত্রী ভুট্টার বীজ লাগে। পুরুষ ভুট্টার বীজ লাগে ৮০০ গ্রাম। বিঘাপ্রতি ৪ কুইন্টাল হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদন হয়। হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদনের প্রায় ৬ মাস সময় লাগে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, স্ত্রী ভুট্টা গাছেও পুরুষ ফুল আসে। হাইব্রিড বীজ পেতে হলে ওই পুরুষ ফুল ভেঙে দিতে হবে। পুরুষ গাছেও ভুট্টা আসে। ওই ভুট্টা আগে কেটে নিতে হবে। বীজ উৎপাদনের পর প্রথমে গ্রেডিং করা দরকার। মেশিনের সাহায্যে দানা ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। হাইব্রিড ভুট্টার বীজ কতদিন সংরক্ষণ করা যাবে তা নির্ভর করে ভুট্টার দানায় কতটা জলীয় দ্রবণ আছে, তার উপর। এজন্য ময়েশ্চার মিটার দিয়ে মেপে নিতে হবে। বীজের জন্য সংরক্ষিত ভুট্টা দানায় জলীয় ভাগ ১০ শতাংশের বেশি থাকা চলবে না।
কৃষকরা জানিয়েছেন, এক বিঘা জমিতে ধানচাষ করে ১০-১২ হাজার টাকার ফসল পাওয়া যায়। কিন্তু, চাষ করতে প্রায় সমান টাকা খরচ হয়ে যায়। ফলে লাভের পরিমাণ প্রায় কিছুই থাকত না। কিন্তু হাইব্রিড ভুট্টার বীজ উৎপাদন করতে এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য ৮ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। বীজ বিক্রি করে প্রায় ১৮-২০ হাজার টাকা আয় হয়। তবে একই জমিতে বারবার ভুট্টা চাষ না করার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। একবার ভুট্টা চাষের পর ডাল চাষ করা উচিত। অথবা জমিতে বেশি করে জৈবসার দিতে হবে।