বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
ছোট্ট বন্ধুরা, ‘রথের মেলা’য় কখনও গেছ তোমরা? আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে হয় শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের এই রথযাত্রা। ওড়িশার পুরীর রথযাত্রা হল সবচেয়ে বিখ্যাত। সারা পৃথিবীর মানুষ এসে ভিড় করেন এই রথযাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য। ‘নন্দী ঘোষ’, ‘তালধ্বজ’ আর ‘দর্পদলন’ নামে যথাক্রমে ষোলো, চোদ্দো আর বারো ফুট উঁচু তিনটি রথে চেপে ভগবান শ্রীশ্রীজগন্নাথ তাঁর বড়ভাই বলরাম ও ছোটবোন সুভদ্রাকে নিয়ে এই রথযাত্রার শুভ সূচনা করেন। আবার ঠিক ন’দিনের মাথায় একাদশীর দিন তাঁরা উল্টোরথে ফিরে আসেন মূল মন্দিরে। প্রচুর ফল, মিষ্টি, শরবত, খিচুড়ি সহযোগে ছাপ্পান্ন ভোগ দিয়ে পুজোর পর হইহই করে ওঁরা তিনজন রথে চেপে যাত্রা করেন। তোমরা মনে মনে ঠিক ভাবছ, কিন্তু ওঁরা যান কোথায়? তোমরা যেমন গরমের, পুজোর কিংবা বড়দিনের ছুটিতে বাড়ি ছেড়ে ক’দিনের জন্য মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাও। ঠিক তেমনি শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব, বলরাম ওরফে বলভদ্র এবং সুভদ্রাও ছুটি কাটাতে এই ক’দিনের জন্য তাঁদের মাসির বাড়ি যান। সেখানে ক’দিন ধরে আনন্দ করে ভোগ খেয়ে আবার যখন নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন, তখন এই ফিরে আসাকে বলা হয় ‘ফিরতি রথ’ বা ‘উল্টোরথ’। রথ থেকে উল্টোরথ এই সবটা মিলিয়েই পূর্ণ হয় ভগবানের পুণ্য ‘রথযাত্রা’ উৎসব। ওড়িশার পুরী ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েক জায়গার রথ খুবই বিখ্যাত। তার মধ্যে শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের ও গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের রথ এবং কলকাতা ইসকনের রথ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই রথযাত্রা থেকে উল্টোরথ— ন’দিন ধরে বসে মেলা। পাঁপড় ভাজা, ফুটকড়াই, চিনির রঙিন মঠ, জিলিপি খাওয়ার রীতি আছে এই সময়। মেলায় পাওয়া যায় তালপাতার ভেঁপু, পাখি, মাটি বাঁশের খেলনা, বাসনপত্র, কাচের চুড়ি ইত্যাদি নানারকম জিনিস। আবার বাজিকররা বিচিত্র খেলাও দেখান এই মেলায়। সেই সঙ্গে থাকে নাগরদোলা, পুতুল নাচ ইত্যাদিও। এককথায় ভরপুর আনন্দ পাবে তোমরা, যদি কখনও এই মেলায় যাও! আচ্ছা, জগন্নাথদেবের মাসির নাম কী বল তো? ওঁর নাম গুণ্ডিচাদেবী। কে ছিলেন এই গুণ্ডিচাদেবী? সেটা জানতে গেলে যে মন দিয়ে একটা গল্প শুনতে হবে তোমাদের। তাহলে শোনো বলি— মালবদেশের অবন্তীনগরে এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, নাম ইন্দ্রদ্যুম্ন। তাঁর স্ত্রী হলেন গুণ্ডিচাদেবী। একবার এক সন্ন্যাসীর মুখে তিনি শুনলেন যে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের নীল পর্বতে ভগবান বিষ্ণু ‘নীলমাধব’ রূপে শবরদের দ্বারা গুপ্তভাবে পূজিত হচ্ছেন। রাজা সে স্থান কোথায় তা জানতে তাঁর পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে পাঠালেন। শবররাজ বিশ্বাবসুর মেয়ে ললিতাকে বিয়ে করে বিদ্যাপতি কৌশলে নীলমাধবের খোঁজ আবিষ্কার করে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জানালেন। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্ন এসে দেখলেন ভগবান অন্তর্ধান করেছেন। হতাশ ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রাণ ত্যাগ করতে যখন মনস্থ করেছেন, তখন তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে ভগবান বিষ্ণু জানালেন এই স্থানেই তাঁর মন্দির তৈরি হবে আর তিনি ‘দারুব্রহ্ম’ রূপে সেখানে পুজো নেবেন। স্বপ্নাদেশ মতো কাঠও ভেসে এল সমুদ্রে। কিন্তু সেই কাঠ এত শক্ত যে কোনও কারিগর তার থেকে মূর্তি বানাতে পারল না। তখন শ্রীবিষ্ণুর আদেশে বিশ্বকর্মা ‘অনন্ত মহারাণা’র ছদ্ম পরিচয়ে এসে বললেন যে একুশ দিন বন্ধ ঘরের ভেতর বসে তিনি মূর্তি বানাবেন। কিন্তু শর্ত হল কেউ দরজা খুলবেন না যতক্ষণ না তিনি নিজে খুলবেন। কিন্তু চোদ্দো দিনের মাথায় রানি গুণ্ডিচাদেবী কৌতূহলের বশে দরজা খুলে ফেললেন। দেখলেন মূর্তি অর্ধসমাপ্ত, অনন্ত মহারাণা অন্তর্হিত! তখন আবার স্বপ্নাদেশ দিলেন শ্রীবিষ্ণু। বললেন সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিরই পুজো করতে। গুণ্ডিচাদেবী মূর্তিগুলি নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পুজো করতে চাইলেন, কিন্তু রাজা রাজি হলেন না। রানির কান্না শুনে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু এসে তখন বললেন যে তিনি প্রত্যেক বছর মাসির বাড়ি যাবেন ন’দিনের জন্য। সেই কথা রাখতেই প্রতিবার রথ ও উল্টোরথ পালিত হয়। উল্টোরথে মাসির বাড়ি এসে ওঁরা কী ভোগ খান জান? পোড়া পিঠে! আশ্চর্য হচ্ছ তো? এর পেছনেও কিন্তু একটা ছোট্ট গল্প আছে। রামায়ণের কাহিনী তো তোমরা সবাই জান, রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠিয়ে ছিলেন তাঁর সৎ মা কৈকেয়ী। কিন্তু এ জন্য তাঁর নিজের ছেলে ভরত তাঁকে খুব তিরস্কার করেছিলেন। কৈকেয়ী যখন অনুশোচনা আর অপরাধ বোধে খুব কাঁদছেন, তখন রামচন্দ্র এসে তাঁকে কথা দিলেন যে পরের জন্মে তিনি সৎ মা কৈকেয়ীর বাড়ি এসে থাকবেন এবং তখন পোড়া পিঠে খাবেন। তাই যেন তিনি আর কান্নাকাটি না করেন। ত্রেতাযুগের সেই সৎ মা কৈকেয়ী হলেন শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মাসিমা গুণ্ডিচাদেবী। তাই সৎ মাকে দেওয়া কথা রাখতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ রথযাত্রা করে মাসির বাড়ি যান, ন’দিন সেখানে থেকে পোড়া পিঠের ভোগ খেয়ে উল্টোরথে ফিরে আসেন। উল্টোরথের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল, তিন ঠাকুরের ‘সুবর্ণ বেশ’— যা রথের ওপরেই তাঁদের পরানো হয়। কথিত আছে, এই বেশ দেখলে সাত জন্মের পাপের ক্ষয় হয় তাই লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন প্রত্যেক বছর। অসমাপ্ত মূর্তির জন্য দুঃখিত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে শ্রীবিষ্ণু বলেছিলেন, ‘তুমি ইচ্ছে করলে তোমার ঐশ্বর্য দিয়ে মূর্তির সোনারুপোর হাত পা তৈরি করিয়ে আমার সেবা করতে পার।’ সেই থেকেই তিন ঠাকুরের এই ‘সুবর্ণ বেশ’ বা ‘সোনার সাজ’-এর প্রচলন। উল্টোরথের আরেকটি বিশেষ উৎসব হল ‘অধরপনা’ উৎসব। প্রভু জগন্নাথের পা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত লম্বা, উঁচু মাটির পাত্রে উৎসর্গ করা হয় এই বিশেষ শরবত প্রসাদ। তারপর মাটির পাত্র ভেঙে দিয়ে পার্শ্বদেবতাদের তৃপ্ত করার জন্য নিবেদন করা হয়। এই ‘অধরপনা’র সঙ্গে সঙ্গেই সমাপ্ত হয় উল্টোরথের উৎসব।
শ্রীশ্রীজগন্নাথের রথ থেকে উল্টোরথ এই ন’দিনের উৎসবে শামিল হতে আসেন সব ধর্মের, সব জাতের, সব দেশের মানুষ। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব যে সত্যিই জগতের নাথ, সবার মিলিত প্রাণস্পন্দনে তা যেন আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানেই এই উৎসবের সার্থকতা!
শ্রীজগন্নাথ ও রথের ছবি এঁকেছে দেবাঞ্জলি দে
তৃতীয় শ্রেণী, শ্রীশিক্ষায়তন স্কুল