বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন ১৮৯৫ সালের ১ আগষ্ট, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার লোনসিংহ গ্রামে। ছোটবেলায় তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যখন তার বয়স ছিল পাঁচ তখন তাঁর বাবা মারা যান। প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাঁকে চলতে হতো। ১৯১৩ সালে গ্রামের লোনসিংহ স্কুল থেকে জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯১৪ সালে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। শহরে পড়াশুনার খরচ জোগানো সংসারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে বিশ্বযুদ্ধের ঝাপটা এসে পড়ল। ফলে পাকাপাকিভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে গ্রামে যেতে হল। এখানে পণ্ডিতসার স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পদে মাত্র ১৬ টাকায় শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন। যখন তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন স্কুলে যাবার পথে, রাস্তার পাশে ছোট ছোট পোকামাকড়, তাদের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি এই সব অভিজ্ঞতা, তার বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে তা লিপিবদ্ধ করতেন এবং প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সহ অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতেন।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা, প্রকৃতির সংস্পর্শে এনে প্রকৃতির প্রতি তাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন হাতেকলমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার জন্য। ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন ‘শতদল’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা যা প্রতিমাসেই প্রকাশ হতো। ‘সনাতন’ পত্রিকা’র সম্পাদনার দায়িত্বও এই সময়ে পালন করেন।
বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার প্রতি তাঁর যেমন আগ্রহ ছিল তেমনি তিনি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি করতেন। কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্নের সহজ ও সরল উত্তর দিতেন।
তাঁর গবেষণার নানাবিধ বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কীটপতঙ্গের গবেষণা। ছোট লাল পিঁপড়ে, নালসে পিঁপড়ে, মাকড়সা, শিকারি মাকড়সা, সাপ, ব্যাং, টিকটিকি, প্রজাপতি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে অনেকে দেশে বিদেশে গবেষণা করে প্রতিষ্ঠিত হন, নোবেল পুরস্কার পান কিন্তু তিনি পাননি। ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ তার অন্যতম সেরা গ্রন্থ। ১৯৩০ সালে বাংলার মাছ খেকো মাকড়সা সম্বন্ধে তাঁর পর্যবেক্ষণ জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে পড়ে।
পিঁপড়ে অনুসারী মাকড়সা, টিকটিকি, শিকারি মাকড়সা সম্পর্কে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি, সোসাইটি জার্নাল, আমেরিকার সায়েন্টিফিক মান্থলি, কলকাতার সায়েন্স অ্যান্ড কালচার-এ প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ২২টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
গোপালচন্দ্র যখন একা একা তাঁর গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, তখন বিজ্ঞানের এই শাখার মূলধারাটি ছিল জার্মানিতে। যদি তিনি এই মূলধারার সঙ্গে মিলে যেতে পারতেন তাহলে তিনি হয়তো সারা বিশ্বে সুপরিচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ত্রয়ী লরেঞ্জ, টিন বার্গেন ও ফন প্রিন-এর সমগোত্রীয় হয়ে যেতেন। তিনি চার্লস ডারউইন, জ্যাঁ অ্যারি ফ্যাবার, ওজিন মারেদের সঙ্গে এক সারিতে অবস্থান করতেন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সারা জীবনে আটশোর অধিক প্রবন্ধ লেখেন। বেশিরভাগ বাংলা পত্র পত্রিকায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবাসী, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর নতুনপত্র, মন্দিরা, সাধনা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, বঙ্গশ্রী, শিশুসাথী, সন্দেশ, নবারুণ, প্রকৃতি, নতুনপত্র, অন্বেষা, দেশ প্রভৃতি। গোপালচন্দ্র এই উপমহাদেশের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনন্য পথিক।
গোপালচন্দ্র প্রথমে জগদীশচন্দ্র বসু’র সহকারী হিসাবে পরে ‘স্যার জগদীশচন্দ্র বোস স্কলারশিপ’ নিয়ে ১৯২৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ৪৮ বছর বসু বিজ্ঞান মন্দিরেই গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
তাঁর ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙের রুপান্তরে পেনিসিলিনের ভূমিকা নিয়ে এই গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁকে অবসরের পরেও গবেষণা চালিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামাজিক পতঙ্গ বিষয়ে আলোচনাচক্রে ভারতীয় শাখা পরিচালনার জন্য আমন্ত্রিত হন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর জীবনব্যাপী যে সমস্ত বিজ্ঞানের বই লিখেছেন তার মধ্যে অনেকগুলি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল—আধুনিক আবিষ্কার, মহাশূন্যের রহস্য, বাংলার কীটপতঙ্গ, মনে পড়ে, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, করে দেখ, রোমাঞ্চকর জীবজগৎ, জীবন নিয়ে যে বিজ্ঞান, জীববিদ্যা, বিষয় উদ্ভিদ, আরও অনেক বই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত উৎস, তাদের মধ্যেই এই শক্তিকে জাগরিত করার মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের উৎসাহ দিতে হবে, যা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর ছোটবেলা থেকেই। আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার ছাড়াও তিনি বহু সম্মানে সম্মানিত হন তার সঙ্গে তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি এস সি সম্মানে ভূষিত হন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল, ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন। এবছরই ছিল তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। আগামী ১ আগষ্ট তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী’। তাঁর অসমাপ্ত কাজ, অপ্রকাশিত লেখা এবং তাঁর বাংলার কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা আজও দেশে বিদেশে বিভিন্ন গবেষক কাজ করে চলেছেন, আগামী দিনে এই সমস্ত গবেষক, প্রকৃতি বিজ্ঞানের গবেষণা কোনও নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারবে বলে আমরা আশা করে থাকব।
নিতাই শ
লেখক : গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে