উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
বছর কয়েক আগে নাইসেডে থাকাকালীন আমাদের নামকরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডাঃ সুজিত ভট্টাচার্য, ডাঃ দীপিকা শূর, ডাঃ সুমন কানুনগো-রা মিলে কত অপরিসীম পরিশ্রমে, প্রায় লক্ষাধিক জনসংখ্যায় প্রয়োগের পর কলেরা ভ্যাকসিন এনেছিলেন। তারও কয়েক বছর বাদে শান্তা বায়োটেক সেটিকে বাজারে আনল। বাণিজ্যিকভাবে। বাংলা তথা সারা দেশে ভ্যাকসিন নিয়ে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল সেটি। ডাঃ ভানের রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিনের কথাও মনে পড়ছে। এসব কি এক-দু’মাসে হয়? করোনার ক্ষেত্রেও বিষয়টা আলাদা হবে না। এমন একটা গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হুড়োহুড়িটা মোটেই কাজের কথা নয়। এই গবেষণায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে অক্সফোর্ড। গুছিয়ে সমীক্ষা করছেন ওঁরা। অথচ একবারও বলছেন না, কালই ভ্যাকসিন বের করে দেব! এত অল্প সময়ে তিনটি পর্যায়ের ট্রায়ালের ফলাফল বিচার করে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তৃতীয় পর্বের ট্রায়ালে প্রচুর মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কয়েক কোটি দেশবাসীকে যা দেওয়া হবে, তা নিয়ে এইসব অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা ও প্রচার অবিলম্বে বন্ধ হওয়ার দরকার। আমার ব্যক্তিগত মত হল, ২০২১-এর আগে করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসা কঠিন।
অনেকে বলছেন, আমাদের গবেষকরা তো প্রাণীদের মধ্যে বা ‘অ্যানিম্যাল মডেল’-এ পরীক্ষাপর্ব শেষ করে তারপরই মানুষের শরীরে ট্রায়াল করছেন। কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তাহলে? জেনে রাখা উচিত, প্রাণীদের মধ্যে গবেষণা সেই অর্থে কোনও ট্রায়ালই নয়। সেখানে মূলত দু’টি বিষয় দেখা হয়। একটি ‘টক্সিকোলজি স্টাডি’—কতগুলি সূচক রয়েছে, সেগুলি দেখা। দ্বিতীয় বিষয় হল, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হল কি না, তা নিশ্চিত করা। এছাড়া কিছু বোঝা যায় না। মানুষের উপর প্রয়োগই ভ্যাকসিন গবেষণার প্রধান অধ্যায়। সেক্ষেত্রেও এডওয়ার্ড জেনারের ভাইরাস গবেষণার দিন এখন আর নেই। কমপক্ষে দু’-তিন হাজার মানুষের উপর পরীক্ষা করতেই হবে। মানুষ সেই ভাইরাসে সংক্রামিত হবেন। কতটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠল, সেসব দেখতে হবে। কড়া সরকারি নিয়মকানুন মেনে স্বেচ্ছাসেবকদের যতটা সম্ভব সুরক্ষিত রাখতে হবে। এতকিছু অল্প সময়ে করা সম্ভব? সত্যি বলতে কী, আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এরকম অদ্ভুতভাবে আগাম দিন ঘোষণা করে ভ্যাকসিন বের করার কথা বিজ্ঞানীরা স্বপ্নেও ভাবেননি। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী, যে কোনও জীবাণুর প্রাদুর্ভাবের পর তার টিকা বের হতে অনেক সময় লেগেছে। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এসেছিল হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন। তাও বেরিয়েছিল ১৪ বছর বাদে! কলেরা ভ্যাকসিন আসে রোগের দাপাদাপির ১০০ বছর বাদে। আর এঁরা নাকি বলছিলেন, এক মাস এক সপ্তাহে হিউম্যান ট্রায়াল শেষ করে করোনা ভ্যাকসিন এনে দেশকে কোভিড থেকে স্বাধীনতা দেবেন! যত্ত সব!
আসলে ভাইরাসবিদ্যাই সারা দেশে অত্যন্ত অবহেলার বিষয়। তাই এই ধরনের অশিক্ষিত কথাবার্তা শুনে আমরা উৎসাহিত হয়ে পড়ি। আশার ছলনায় ভুলি। আশপাশে দেখছি, এমন অনেকেই ভাইরোলজি নিয়ে কথা বলছেন, যাঁদের কয়েজনের এ বিষয়ে একটিও আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র আছে কি না সন্দেহ।
সারা দেশে এখন লক্ষ লক্ষ করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। তার গুণগত মান কেউ পরখ করেছেন কি? পরীক্ষার রিপোর্টগুলি ঠিক না ভুল, সেই কোয়ালিটি কন্ট্রোলে জোর না দিলে মহামারীও নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। আপাতভাবে কারও মনে হবে, তিনি সুস্থ। বাস্তবে হয়তো তিনি আক্রান্ত। আবার রিপোর্ট দেখে যাঁকে আক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে, দেখা যাবে তিনি সুস্থ। আরটিপিসিআর-এর মাধ্যমে করোনা পরীক্ষায় এই কোয়ালিটি কন্ট্রোল অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
তবে হ্যাঁ, যত্ন করে তৈরি করতে পারলে ভ্যাকসিন অবশ্যই করোনার দিশা হতে পারে। ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নিয়েও প্রচুর কথা চলছে। বিষয়টি বাস্তবোচিত কি না, সন্দেহ আছে! আর ৭০ শতাংশ জনসংখ্যাকে সংক্রামিত করার পর সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা এলে পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হবে, ভাবতেই শিউরে উঠছি। বিদেশে ইমিউনোথেরাপি, অ্যান্টিবডি থেরাপি নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিছু কিছু সাফল্যও আসছে। কোনওটাতেই কিছু না হলে ভাইরাসঘটিত মহামারীর স্বাভাবিক নিয়মেই এই সংক্রমণের রেখচিত্র নীচের দিকে নামবে বলে মনে হয়। স্প্যানিশ ফ্লু যখন হয়, কোথায় ছিল এত আধুনিক চিকিৎসা? আধুনিকই বা বলি কী করে! ১০০ বছর পর, জ্ঞানবিজ্ঞানের এত শিখরে উঠেও করোনা মোকাবিলায় বিরাট কী করতে পারলাম আমরা?
তবে এইটুকু স্বস্তিকর, কোনও ভাইরাস অত্যন্ত বিপজ্জনক হলে তার আয়ুষ্কাল সাধারণত বেশি হয় না। নিজেরা মারা যায়। যেমন সার্স, মার্স-এর মতো প্রচুর মারণক্ষমতার ভাইরাস বেশিদিন টেকেনি। অন্যদিকে করোনার মতো যেসব ভাইরাসের মারণক্ষমতা কম, কম ভিরুলেন্ট, তারা সবসময় প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনকার ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এইচ৩এন২, সে তো রয়েই গিয়েছে আমাদের সঙ্গে। কই, তাতে কি কাতারে কাতারে মানুষ মারা যাচ্ছেন ইনফ্লুয়েঞ্জায়? আসলে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
করোনা বায়ুবাহিত বলেও নানা বিতর্ক হচ্ছে। দুশোর বেশি বিজ্ঞানী নাকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বলেছেন, নোভেল করোনা ‘এয়ারবোর্ন’ ভাইরাস। আমি মানতে নারাজ। যদি বায়ুবাহিতই হতো, পৃথিবীর আরও কোটি কোটি মানুষ এতে সংক্রামিত হতেন। মুম্বইয়ের ধারাভির সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। আফ্রিকা শেষ হয়ে যেত। বাতাসবাহিত ভাইরাসের অন্য দেশে যেতে তো আর ভিসা পাসপোর্ট লাগে না! হু’র প্রধান বিজ্ঞানী আমারই বন্ধু ডাঃ সৌম্যা স্বামীনাথনও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইট ইজ এ স্মলার ড্রপলেট’। করোনা ড্রপলেট সংক্রমণ। বাতাসবাহিত সংক্রমণ নয়।
আর একটু খোলসা করি। ভাইরাস একটি জীবন্ত পোষক বা হোস্ট ছাড়া বাঁচতে পারে না। হয় ব্যাকটেরিয়া, না হয় মানুষ, নয়তো জীবজন্তু—যে কোনও একটি পোষকের কোষের মধ্যে সে থাকবে, বাড়বে। এমনি এমনি ঘুরে বেড়াতে পারে না। আমাদের হাঁচি, কাশির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা ড্রপলেটও এমনই একটি কোষ। তার মধ্যে ভাইরাস থাকে। আর ড্রপলেট বেরলে সামনেই পড়ে যায় না। একটু দূরে গিয়ে পড়ে। তাই আপাতদৃষ্টিতে আচরণ দেখে বায়ুবাহিত মনে হচ্ছে।
কোভিড সংক্রমণের ‘পিক’ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। কেউ বলছেন, সবচেয়ে বেশি রোগ সংক্রমণের ‘পিক’ নাকি এই জুলাইতেই হবে। কেউ বলছেন, ‘পিক’ আসতে এখনও দেরি। সত্যি বলতে, ১০ লক্ষ ভাইরাস আছে। কেউ জানে না, কখন কাকে আক্রমণ করবে।
একটাই সমাধান। মাস্ক পড়ুন। এর চেয়ে বড় সতর্কতা দ্বিতীয় নেই। ধারাভির মতো বস্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ঠিকঠিক নিয়ম মেনেছেন চলেছেন ওঁরা। সংক্রমণের গ্রাফও নেমেছে চড়চড় করে। ওখানকার বস্তিবাসীদের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে, আমার- আপনার মতো শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে তা হয়েছে কি?
অনেক বলছেন করোনা ম্যান মেড ভাইরাস। অনেকে বলছেন বাদুড়, পেঙ্গুইন থেকে এসেছে। এছাড়াও জুনোটিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে আর একটি জন্তুর কথা না বললেই নয়। সেটি হল শূকর। আমরা ভাইরোলজিতে একে বলি ‘মিক্সিং ভেসেল’। নভেল এইচ১এন১-এর ক্ষেত্রেও শূকরই ছিল ‘মিক্সিং ভেসেল’। শূকরের মধ্যেই তিনটে ভাইরাস থেকে একটি নতুন ভাইরাস বেরিয়ে এসেছিল। ওদের কিছু হয়নি। সেই ভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত করে গিয়েছে। কত রহস্য যে আছে ভাইরোলজিতে! মানুষ সেই বিজ্ঞান জানুক। আগ্রহ বাড়ুক। আর অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা যত কম হয়, ততই ভাইরোলজির মঙ্গল। মঙ্গল দেশের, সমাজের।
............
লেখক: প্রাক্তন ডিরেক্টর ইন চার্জ, নাইসেড, আইসিএমআর। প্রায় দু’দশকের বেশি সময় এইচআইভি, কলেরা, পক্স, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া সহ অজস্র ভাইরাস গবেষণায় যুক্ত প্রাক্তন চিকিৎসাবিজ্ঞানী