উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
নীলাচলের সমুদ্রের ধারে মন খারাপ করে বসে রইলেন ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। তিন দিন ধরে দাঁতে কুটোটি কাটেননি। স্থির করেছেন অনাহারে প্রাণবিসর্জন দেবেন। কিন্তু কেন এই কঠিন সংকল্প ধ্রুবানন্দের। আসলে ধ্রুবানন্দ তীর্থ থেকে তীর্থান্তরে ভ্রমণ করতে করতে জগন্নাথক্ষেত্র নীলাচলে এসে পৌঁছেছেন। দারুব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করে শ্রীহরির পরমভক্ত ধ্রুবানন্দের মনে ইচ্ছা হয়েছে স্বহস্তে জগন্নাথকে রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু বাধ সাধল মন্দিরের পাণ্ডারা। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে না পেরেই ধ্রুবানন্দের এমন সিদ্ধান্ত। ভক্তের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ধ্রুবানন্দের স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন জগন্নাথদেব। বললেন, ‘ধ্রুবানন্দ ওঠো, তুমি অনশনে দেহত্যাগ করলে আমাকে রেঁধে খাওয়াবে কে? বঙ্গদেশে গঙ্গাতীরের মাহেশে যাও। সেখানে আমি দারুব্রহ্ম রূপে আবির্ভূত হয়ে তোমার সেবা গ্রহণ করব ।’
ধ্রুবানন্দ দ্রুত বেগে বঙ্গের দিকে চললেন। গঙ্গার পশ্চিম কূলের মাহেশে এসে তপস্যায় মগ্ন হলেন ধ্রুবানন্দ। কলির তপস্যা কী? ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর তারকব্রহ্ম বা মহামন্ত্র জপ। একদিন প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় একটি নিমকাঠ ভাসতে দেখলেন ধ্রবানন্দ। আনন্দে উদ্বেল হল তাঁর মন। গঙ্গায় তখন প্রবল স্রোত। সমস্ত বিপদ উপেক্ষা করে গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেন তিনি। বুকে ধরে তুলে আনলেন দারু। যথাসময়ে শিল্পীও এসে উপস্থিত। ওই নিমকাঠ থেকেই প্রকাশিত হলেন জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা। গঙ্গার ধারে (বর্তমানে লক্ষ্মীঘাটে) তৈরি হয় মন্দির। প্রতিষ্ঠিত হন তিন বিগ্রহ। ধ্রুবানন্দের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন জগন্নাথ।
নীলাচলে যাওয়ার পথে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য । তিনিই মাহেশের নামকরণ করেন ‘নবনীলাচল’। ধ্রুবানন্দ যখন বৃদ্ধ হলেন তখন তাঁর চিন্তা হল দেহান্তের পর জগন্নাথের সেবা করবে কে? আবার জগন্নাথই ভক্তের চিন্তা দূর করলেন। সুন্দরবনের খালিজুলির জমিদারের ছেলে কমলাকর পিপলাই মহাপ্রভুর পরম ভক্ত এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের দ্বাদশ গোপালের অন্যতম। তিনিই স্বহস্তে তুলে নিলেন জগন্নাথের সেবাভার। বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করে দেন কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক, ১৭৫৫ সাল নাগাদ।
ধ্রুবানন্দের মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে সঙ্গেই ঐতিহ্য বহন করছে জগন্নাথের রথযাত্রা। তাঁর আমলের রথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন এক মোদক। পরে ১৭৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি জেলার দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করে দেন। এই কৃষ্ণরাম বসুরই স্বনামধন্য নাতি হলেন পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য বলরাম বসু । কৃষ্ণরামের রথটি কালের প্রভাবে জীর্ণ হয়ে পড়লে তাঁর ছেলে গুরুপ্রসাদ বসু ১৭৯৮ সালে নয় চূড়া বিশিষ্ট নতুন রথ তৈরি করিয়ে দেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে রথটি ভস্মীভূত হওয়ায় বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্র বসু বর্তমান লোহার রথটি মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিকে দিয়ে তৈরি করান। তখনকার সময়ে এই রথ তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। মাহেশের এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা করোনার চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করতে পারল না। তাই এই বছর রথ চলবে না। মাহেশ মন্দিরের জগন্নাথদেবের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী জানিয়েছেন, এই প্রথম মাহেশের রথযাত্রা বন্ধ হল। মন্দিরের ভিতরের ধ্যানঘরে মাসির বাড়ি তৈরি করে প্রভুকে স্থানান্তরিত করা হবে। উল্টোরথ পর্যন্ত জগন্নাথ সহ সকল বিগ্রহ সেখানেই অবস্থান করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মাহেশের জগন্নাথ দর্শন করেছেন একাধিকবার। দেখেছেন রথযাত্রাও। জগন্নাথ দর্শনে ঘনঘন ভাবসমাধি এবং কীর্তনে মাতোয়ারা হয়েছেন তিনি। মা সারদা দেবীও মহিলা ভক্তদের সঙ্গে এখানে এসেছেন। মাহেশের রথের মেলা বিখ্যাত হলেও এবার এই মেলাও বসছে না।