উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ধনীর সন্তান। প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হচ্ছেন। পিতা বিশ্বনাথ তাকে সবরকমের স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। তিনি নিজে গতানুগতিকভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন এমন কথা বলা যায় না। তিনি এক জায়গায় নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন— আমি হেডোনিস্ট, অর্থাৎ জীবনের রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করতে চাই। সব ধর্মের তত্ত্বই তিনি জানতেন। তবে সমন্বয়ে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হাফিজ পড়তেন, সুফি সাধকদের লেখা পড়তেন, আবার শ্রীমদ্ভাগবতের রসও গ্রহণ করতেন। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ছোট একটি পুস্তিকাও লিখেছিলেন। যেমন লিখেছিলেন ‘সুলোচনা’ নামের একটি উপন্যাস। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতচর্চা করেছিলেন। সঙ্গীত পরিবেশনও করতেন। প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে মজলিস বসাতেন, আর শ্রোতাদের মোগলাই খানা খাওয়াতেন। রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পুত্র নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে চাঁদনি থেকে একটি রান্নার বই আনিয়েছিলেন। মাঝেমাঝে বাড়ির রান্নাঘরের দখল নিয়ে পিতা-পুত্রে মোগলাই পদ রান্না করতেন। তাঁর এক মক্কেল ছিলেন মোগল রমণী। তিনি সময়ে সময়ে এক একটি পদের রান্নার প্রণালী লিখে পাঠাতেন। পুত্র নরেন্দ্রনাথকে তিনি চেয়েছিলেন আদর্শ এক পুরুষ হিসেবে তৈরি করতে। স্বাস্থ্য হবে সুন্দর, চওড়া বুক, মনে দুর্জয় সাহস, সমস্ত বাধা অতিক্রম করার অতি মানবীয় শক্তি। নরেন্দ্রনাথ ব্যায়ামবীর হবেন, কুস্তিগীর হবেন, সাঁতার শিখবেন, শিখবেন রোয়িং, বন্দুক চালানো, ঘোড়ায় চড়া। পুত্রকে তিনি সর্বঅর্থে এক বীর তৈরি করতে চেয়েছিলেন। দিয়েছিলেন স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা।
স্বামীজি কিন্তু সঙ্গে এনেছিলেন অতি মানবীয় এক মন। উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন অতি-লৌকিক এক কৌতূহল। তিনি বিচরণ করতেন অনন্তে। ছাত্রজীবন থেকেই অভ্যাস করতেন ধ্যান। বুদ্ধদেবের দর্শন তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। জানতে চাইতেন একটি ক্ষুদ্র জীবনেই কি মহাজীবন শেষ হয়ে যায়! অনন্তের সঙ্গে সান্তের কি কোনও সম্পর্ক আছে! এই জগতের বাইরে পা ফেললে মানুষ যায় কোথায়! এটি কি একটি অলাতচক্র! এ কি কোনও কংসের কারাগার! সেই কারাগারেই কি ভগবান বিষ্ণু আসেন! বুদ্ধদেব যে নির্বাণের কথা বলে গিয়েছেন তা কি নির্বাপিত জীবন প্রদীপ! নাকি চিরপ্রজ্জ্বলিত একটি দীপশিখা! কী বলছেন হাফিজ, রুমি। কী বলছেন কান্ট, হেগেল, হিউম, ডেকার্ট, স্পেনসার। চিন্তার এই স্বাধীনতা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। এই পরিবারেরই একজন পূর্বে সন্ন্যাস নিয়ে সংসার ত্যাগী হয়েছেন। রক্তের ধারায় রয়েছে সেই বৈরাগ্যের বীজ। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ হবেন স্বতন্ত্র এক পথের পথিক। এই দুনিয়ার যাবতীয় যন্ত্রণার উত্তরাধিকারী নীরবে মোক্ষণ করবেন অন্তরের অশ্রুজল। সেই ক্রন্দনে কোনও হাহাকার থাকবে না, থাকবে একটা জ্বলন। গুমরে গুমরে বাজবে অদ্ভুত এক বিদ্রোহের বাঁশি। ব্রাহ্ম হীরালালকে বলবেন, এই বিশ্ব সৃষ্টির অতি উত্তম ব্লু-প্রিন্ট আমার কাছে আছে। যা আমি ঈশ্বরকে দিতে পারি। পরবর্তীকালে তিনি বলবেন, সন্ন্যাস হল মৃত্যুপণ, যে মরতে প্রস্তুত তারই সাজে গেরুয়া ধারণ।
দক্ষিণেশ্বরে সাধক, গুপ্ত যোগী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছে এলেন এক কলেজি যুবক। তিনি যা খুঁজছেন তা কোনও দর্শনে নেই, ব্রাহ্ম সমাজে নেই, রামমোহন বা দেবেন্দ্র ঠাকুরের কাছেও নেই। এই গোলাকার বৃহৎ শালগ্রাম- সম জগতের আড়ালে কে আছেন? মহাশয়! আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন? আমি আপনার ওই মন্দিরের মা কালী অথবা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর— এঁদের সম্পর্কে কিছুই জানতে চাই না। আমি অসীম, অনন্তের খবর চাই। আমি বেদ পাঠ করেছি। অতীত ঋষিদের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত। কঠোপনিষদ আমার প্রিয় গ্রন্থ। কিন্তু যমরাজ নচিকেতাকে বলতে পারেননি, মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়! আমি সেই বালক নচিকেতা। আমি নরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার পিতা একজন বিখ্যাত অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্ত, আমার মা ভুবনেশ্বরী। সেদিন এতকথা তাঁকে বলতে হয়নি। ঠাকুর জানতেন কে এসেছে! কেন এসেছে! তিনি জানতেন, একে আসতেই হবে! তিনি মৃদু হেসে অশান্ত যুবকটিকে গ্রহণ করেছিলেন। সেদিন তাঁর মধ্যে যে স্নেহের প্রকাশ ঘটেছিল তাতে দত্ত নরেন্দ্রনাথ এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন, যা তিনি আর ভুলতেই পারেননি। শটকা কলে ব্যাধেরা যেমন পাখি ধরে, শ্রীরামকৃষ্ণ এই গরুড় পক্ষীটিকে তাঁর বিশাল স্নেহের বিরাট খাঁচায় চিরকালের জন্য ধরে ফেললেন।
নচিকেতা মৃত্যুর রহস্য জানতে চেয়েছিলেন। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত হঠাৎ মারা গিয়ে এই নচিকেতাকে জানিয়ে গেলেন—তোমার জীবনে শোকের কোনও অবকাশ নেই। অশ্রু বিসর্জনের শৌখিনতাও থাকবে না। আমার উত্তরাধিকার হল অভাব আর এই পরিবারটির বিশাল বোঝা। তুমি আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র, কাঁধে তুলে নাও সংসারের এই স্থূল ভার। পিতার মৃত্যু যেন হাতুড়ির আঘাত। নরেন্দ্রনাথ যেন অগ্নিতে লাল করা একখণ্ড লোহা। প্রথম মৃত্যু তাঁকে যে শিক্ষা দিয়েছিল, সেই শিক্ষা পরবর্তীকালে কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা তাঁর জানা ছিল না।
নরেন্দ্রনাথের দুই পিতা। জাগতিক পিতা চলে গেলেন। দক্ষিণেশ্বরে দু’হাত বাড়িয়ে বসে আছেন তাঁর আধ্যাত্মিক পিতা। তিনি নরেন্দ্রনাথকে তৈরি করছেন ইন্দ্রের বজ্রের মতো করে। বেদান্তি নরেন্দ্রনাথ মৃত্যকে দেখতে শিখেছেন অন্য চোখে। জীবনের ক্ষয় নেই লয় আছে। জলের বিন্দু জলেতেই মিলায়, যা আজ আছে এখানে, কাল তা ফিরে যাবে সেখানে। প্রশ্ন ছিল ভগবান কোথায়? গুরু বুকে আঘাত করে শিখিয়ে গেলেন, ভগবান এখানে।
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যথেষ্ট সময় দিলেন তাঁর না থাকাটাকে সহনীয় করার জন্য। দিলেন সেবার সুযোগ। নরেন্দ্রনাথ এবং পরবর্তীকালে যে যুবকরা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ তৈরি করবেন, তাঁদের দলনেতা হয়ে কাশীপুর উদ্যান বাটীতে গুরুর সেবায় নিয়োজিত হলেন। মাঝেমাঝে সকলকে সচেতন করতে লাগলেন—এই দেহটি চলে যাবে, আয় যত পারি সেবা করি। সেবাই ধর্ম। আর যত পারি গ্রহণ করি গুরুর শিক্ষা, গুরুর দর্শন। জেনে রাখ শোকের কোনও অবকাশ নেই। গতি থমকে যাবে কিছুক্ষণের জন্যে, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের রথ চলতেই থাকবে। আমরা ধরে রাখব সেই রথের রশি। রথের চারটি চাকা— ধর্ম, অর্থ, কাম আর মোক্ষ।
ঠাকুর চলে গেলেন। নরেন্দ্রনাথের কাঁধে দিয়ে গেলেন একটি নতুন যুগের ভার। দিয়ে গেলেন একটি ধর্ম—যা সমস্ত ধর্মের সমন্বিত রূপ। একটি সংগঠন তৈরি করতে হবে, যে যুবকদল তাঁর বাঁশি শুনে গৃহত্যাগ করেছেন তাঁদের আশ্রয় দিতে হবে, তাঁদের পরিচালিত করতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শের পথে। দূর, দূর, বহু দূরে যেতে হবে। নরেন্দ্রনাথের দুঃখ কোথায়? পুরোটাই তো দায়িত্ব।
একটি চিত্র চোখের সামনে ভাসছে—নরেন্দ্রনাথ নীল আকাশে বিরাট একটা ঘুড়ি তুলেছেন, হাতে লাটাই আর সুতো। কলে বাঁধা সেই ঘুড়ি উড়ছে, আর দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতে গান হচ্ছে—শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি ভবসাগর বাজার মাঝে। নরেন্দ্রনাথের হাতে লাটাই, আর ওই নীল আকশের বুকে শ্রীরামকৃষ্ণ- ঘুড়ি বাতাসে সাঁতার কাটছে।