উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ধোনির কর্মজীবন কেটেছে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এই স্টেশনে। তাই ‘এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ ছবির পরিচালক নীরজ পাণ্ডে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছবির শ্যুটিং খড়্গপুরে গিয়ে করতে হবে। এই কথা শুনে ধোনি নিজেই এই শহরে তাঁর কয়েকজন পরিচিত মানুষের নাম বলে দেন নীরজকে। সেই তালিকায় ছিলেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের অভিন্নহৃদয় বন্ধু তথা খড়্গপুরের বর্তমান বিধায়ক প্রদীপ সরকার। প্রদীপবাবু তখন পুরসভার চেয়ারম্যান। এখন তিনিই খড়্গপুর সদরের বিধায়ক। আইআইটির গেস্ট হাউসে সপ্তাহ খানেক ছিলেন সুশান্ত। তার মধ্যেই তাঁর সঙ্গে বার তিনেক দেখা হয়েছিল প্রদীপবাবুর। ‘স্টেশনে কয়েকবার, আর একবার তো সিনেমার সেটেই...’, বলছিলেন প্রদীপবাবু।
খড়্গপুরে টেনিস বলে ম্যাচ খেলতেন ধোনি। সুভাষপল্লি বিএনআর মাঠে গ্রিন অ্যাকাডেমি ক্লাবের পরিচালনায় দিন-রাতের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো। সেই টুর্নামেন্টে একবার ধোনির টিম জিতেছিল। তখনও ভারতীয় দলের আশপাশেও পৌঁছনোর সুযোগ পাননি ‘ক্যাপ্টেন কুল’। টুর্নামেন্টের ট্রফি ধোনির হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রদীপবাবুই। সেই দৃশ্যও ছিল ‘আনটোল্ড স্টোরি’তে। স্মৃতি হাতড়ে বিধায়ক বললেন, ‘ছবিতে আমি একটা চরিত্রে ছিলাম। ওই দৃশ্যতে সুশান্তের সঙ্গেই আমার শ্যুটিং ছিল। টেনিস বলে হেলিকপ্টার শট মেরে টিমকে জিতিয়ে আমার কাছ থেকে ট্রফি নিল পর্দার ধোনি। তখনই আলাপ হয়েছিল। তারপর একসঙ্গে আড্ডা মেরেছি, চা খেয়েছি...’। খড়্গপুর নিয়ে কৌতূহল ছিল সুশান্তের। এই শহরের নানা কথা জিজ্ঞেস করতেন প্রদীপবাবুকে। কেন একে রেলনগরী বলা হয়? শহরের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন? আইআইটি... এমন অনেক কিছু। মেধাবী সত্ত্বাটা বারবার বেরিয়ে আসত সুশান্তের। ‘এত অল্প সময়েই আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। খবরটা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে যেন বন্ধুকে হারালাম’, খুব থেমে থেমে বলছিলেন প্রদীপবাবু।
ধোনির মতোই বাইক পছন্দ করতেন সুশান্ত। একবার খড়্গপুরের বিখ্যাত গোলগাপ্পার কথা শুনে বাইকে চেপেই ধোনির বন্ধুদের সঙ্গে খেতে চলে গিয়েছিলেন। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই সবার সঙ্গে জমিয়ে ফুচকা খেয়েছিলেন। ধোনির এক বন্ধু রেলকর্মী দীপককুমার সিং বলছিলেন, ‘উনি যে একজন সেলিব্রিটি, সেটা দেখে বোঝার উপায় ছিল না। সবাই মিলে যে গোলগাপ্পা খেতে গেলাম... সিকিউরিটির বালাই নেই!’ মাঝে মাঝে ধোনির বন্ধুরা নাকি সুশান্তকে ধোনি বলেই গুলিয়ে ফেলতেন... এতটাই নিখুঁত ছিলেন তিনি। শ্যুটিং শুরু হওয়ার আগে সুশান্ত একদিন দীপকদের কাছে হঠাৎ আব্দার করেন, ক্রিকেট খেলব। ‘টেনিস বলে আইআইটির মাঠে আমরা একসঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি। ছবির পরিচালক নীরজ পাণ্ডেও ছিলেন। ভালো ক্রিকেট খেলতে পারত সুশান্ত। খুব স্মার্ট, ঝকঝকে ছেলে। সারাদিন হাসি-ঠাট্টার মধ্যে থাকত। একসঙ্গে লাঞ্চ করেছি, ডিনারও’... দীপকের চোখের সামনে ভাসছে দিনগুলো। চরিত্রটা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে ধোনিকে নিয়ে বন্ধুদের কাছে নানা প্রশ্ন করতেন পর্দার এমএস। খড়্গপুর থেকে একবার ধোনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে চেপে দীঘা গিয়েছিলেন। সেইসব গল্প ডিটেলে মাঝে মধ্যেই শুনতে চাইতেন তিনি।
স্টেশনে শ্যুটিং থাকলে বিশ্রাম নিতেন ভিআইপি লাউঞ্জে। কিন্তু বিশ্রাম বলতে গেলে হতোই না, কারণ সেখানেই সই এবং ছবি শিকারিরা ভিড় করতেন। আর ছিল সেরসা স্টেডিয়াম... ক্রিকেটে ডুবে থাকতেন সুশান্ত। ধোনির মতো। শ্যুটিং শেষ হলে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে খানিক এগিয়ে চলে যেতেন থমাসের চায়ের দোকানে (ছোট্ট দোকানটা এখন অবশ্য অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে)। ধোনির মতোই লম্বা চুল, একই রকম হাঁটাচলা। এক লহমায় দেখে অন্যান্যদের মতো থমাসেরও মনে হয়েছিল, এখন মাহি এলো কোথা থেকে? পরে বুঝতে পারেন, তাঁর প্রিয় মাহির বায়োপিকের শ্যুটিং চলছে। ‘তখন আমার দোকানে খুব একটা লোক আসত না। শ্যুটিংয়ের শেষে উনি আমার দোকানে এসে চা-বিস্কুট খেয়ে যেতেন’। শুধু চা খেয়েই ফিরে যেতেন না সুশান্ত। থমাসের সঙ্গে রীতিমতো গল্প জুড়তেন। একজন সাধারণ মানুষের সামান্য জীবন নিয়েও আগ্রহ কম ছিল না তাঁর।
খড়্গপুর স্টেশনের কাছেই দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের খড়্গপুর ডিভিশনের ডিআরএম অফিস। সেখানেও শ্যুটিং করেছেন সুশান্ত। ডিআরএম বিল্ডিংয়ের করিডরে শ্যুটিং করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ডিআরএম-এর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট অরুণকুমার দাস খুব কাছ থেকে দেখেছেন অভিনেতাকে। বলছিলেন, ‘তখনও শ্যুটিং শুরু হয়নি। উনি একদিন এসে ভিজিটার রুমে বসেছিলেন। পিওন এসে জানালেন, সুশান্ত সিং রাজপুত এসেছেন। তখন আমি ওঁর ব্যোমকেশ বক্সি ছবিটা দেখে ফেলেছি। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে ব্যোমকেশ বক্সি বাঙালিবাবু বলে সুশান্তকে দু’হাত ধরে নিয়ে এলাম আমার টেবিলে। রেলকর্মীরা সবাই এসে আলাপ করলেন তাঁর সঙ্গে। ছবি তুললেন...। যতটুকু সময় ওঁকে কাছ থেকে দেখেছি, বেশ লাজুক প্রকৃতিরই মনে হয়েছিল। তবে, সারাক্ষণ হাসি-খুশি থাকতেন’। শ্যুটিং শুরু হওয়ার পরে বেশ কয়েকবার সুশান্তের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁর। দেখলেই হেসে এগিয়ে আসতেন। ভ্যানিটি ছিল না...। সব ছবি এখনও রাখা রয়েছে খড়্গপুরের ডিআরএম অফিসে।
১৪ জুন সকাল থেকেই বাংলার এই মফস্সল শহরের আকাশের মুখ ছিল ভার। সেদিন সকালের ধূসর আকাশই কি ছিল কোনও অজানা মন খারাপের আলতো ইঙ্গিত? বেলা গড়াতেই স্পষ্ট হতে থাকে এই প্রশ্নের উত্তর। লকডাউনের জেরে তৈরি হওয়া রেলনগরীর স্টেশনের নিস্তব্ধতা যেন অচিরেই নীরবতায় পরিণত হল। বিস্ময়ে হতবাক রেলনগরীর আকাশ তখন অঝোরধারায় কেঁদে চলেছে। দিনের শেষ ট্রেন প্রতিনিয়ত স্পর্শ করবে খড়্গপুর স্টেশন। শূন্য প্ল্যাটফর্মে ধোনির বেশে সাদা পোশাকে কালো কোট হাতে আর নামবেন না সুশান্ত।
ছবি: সৌজন্যে প্রদীপ সরকার