উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
তবে যেদিন আপনি চলে গিয়েছেন, হয়তো বা আপনার প্রিয় মহাশূন্যে... তারপর থেকে বহু মানুষ আপন করে ফেলেছে আপনাকে। তাঁদের অনেকে আমার মতো আপনাকে আগে তেমন জানতেন না। বা ধরুন, ওই বড় জোর গোটা দুই ছবি দেখেছেন আপনার। অভিনয় মন্দ লাগেনি। তবে তার বেশি কিছু নয়। ভক্ত হয়ে ওঠা একেবারেই হয়নি তাঁদের...। সেই আমরা রাতারাতি আপনার খুব কাছে চলে এসেছি।
আপনি অকালে চলে যাওয়ার পর যেটা হল, তাবড় মিডিয়া হামলে পড়ল হইহই করে। নাম-যশ-প্রতিপত্তিকে হেলায় ঠেলে দিয়ে আপনি কেন মৃত্যুকে এভাবে বেছে নিলেন, আপনি কেন অবসাদে ভুগছিলেন, আপনি কেন সুইসাইড নোট লিখলেন না, আপনি কেন ফলের রস খেয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবলেন, আপনার সর্বশেষ প্রেমিকা কেন আপনাকে ছেড়ে চলে গেলেন, আপনার বান্দ্রার ফ্ল্যাটে পোষ্য কুকুর ফাজ কতটা দুঃখ পেল... ইত্যাদি ইত্যাদি আরও নানা তথ্য-তত্ত্ব জনসমক্ষে হাজির করল তারা। তবে এই তথ্যের ভিড়ে যেটা হল, বাইরে চলে এল আরও এমন অনেক কিছু, যা এতদিন সাধারণ মানুষের গোচরে ছিল না। অল ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকায় সপ্তম স্থান, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড জেতা—এগুলো ছেড়েই দিলাম। এসব তো প্রথাগত পড়াশোনা। প্রতি বছর কেউ না কেউ এমন র্যাঙ্ক পান। তাঁদের এত খোঁজ আমরা রাখি না, কারণ তাঁরা কেউ বলিউডে ছবির হিরো হয়ে নাচ-গানে মাতিয়ে রাখতে আসেন না। আপনি এসেছিলেন। এবং এসেও শুধু নম্বরে জীবনটাকে আটকে ফেলতে চাননি। কারণটা কী? আপনি নিজেই বলে গিয়েছেন একের পর এক ইন্টারভিউয়ে।
নিজেকে নিয়ে আপনার বিড়ম্বনা এতটাই যে, নানা চরিত্রের পিছনে লুকোতে ভালবাসতেন আপনি। চরিত্রটা মানুষের সামনে এলে আর চিন্তা থাকত না আপনার। মনে মনে স্বস্তি পেতেন, ‘যাক বাবাঃ, আমায় তো এবার কেউ চিনে ফেলছে না!’ কিন্তু ওই একটাই তো ‘আপনি’ ছিলেন না! আপনি ছিলেন আরও ‘অনেকগুলো।’ আপনার সেই অনেকগুলো সত্ত্বা এখন মুকুটের পালক হিসেবে দেখিয়ে অনেকে বড়াই করছেন। বলছেন, আহা লাজুক, অন্তর্মুখী ছেলেটা এভাবে চলে গেল! হোয়াট আ মিস। ইশ ছেলেটা যে বলত, ‘ফিল্মে আর সুযোগ না পেলে কোনও দুঃখ নেই। থিয়েটার করব।’ বলেছিল, ‘কিছু না হলে ফাইভ-ডি ক্যামেরায় শ্যুট করে ছবি বানাব, নিজেই হিরো হব।’ এসব কেন বলত, তাই নিয়ে কাটাছেঁড়া করে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছেন বলিউডের স্বজনপোষণে। শুধু ‘নেপোটিজম’ নামক শব্দের পরোক্ষ শিকার হয়েই আপনি চলে গেলেন ভেবে অশ্রুমোচন করছেন তাঁরা। এখন আপনার মনের অন্তরমহলের গহীন অবসাদের কারণগুলোও গুছিয়ে বলে দিচ্ছেন কেউ কেউ। অবসাদ বলতে যদিও আমাদের অনেকেরই দৌড় এখনও ওই ‘মন খারাপ হলেই কুয়াশা হয়...’ পর্যন্ত।
আচ্ছা একবারও তো ভাবছি না... যে ছেলেটি পদার্থবিদ্যা গুলে খেয়েও আরও অগণিত বিষয় জানার আগ্রহ উত্তরোত্তর বাড়িয়ে গিয়েছে, মহাকাশবিজ্ঞান থেকে নাসা নিয়ে পাগল হয়েছে, সে কেন স্বজনপোষণের ক্ষুদ্র রাজনীতিতে থমকে যাবে? সে তো নিজেই বলে গিয়েছিল, ‘হ্যাঁ স্বজনপোষণ আছে। আলবাত আছে। কিন্তু তাতে কী? তাতে কিছু আটকায় না। প্রতিভা থাকলে নতুন মুখ ঠিক জায়গা করে নেয়। স্বজনপোষণ থাকলেও তার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল জায়গাটা যদি বেঁচেবর্তে থাকে, তাহলে দু’টোই চলতে পারে। সমান্তরালে।’ এ কথাগুলো আপনার ভক্তরা কি ভুলে গিয়েছেন? তবে কেন আপনার মৃত্যুর পরে শুধু সেই বিতর্কটাই মুখ্য হয়ে উঠল?
আপনার পড়াশোনা, আপনার মনন, আপনার জানার অদম্য কৌতূহল—এগুলো কেন চর্চার বিষয় হয়ে উঠল না? কৌতূহলের ততটুকুই কেন প্রচার পেল, যতটুকু আমাদের কাছে চমক? আমরা সবাই আপনার বহুমূল্য টেলিস্কোপ আর চাঁদে কেনা জমির কথা শুনেই অভিভূত। রিসাইকেল করা নানারকম জিনিস দিয়ে তৈরি সাধারণ আসবাবে সাজানো আপনার ঘর বিজ্ঞাপনী ভিডিওয় দেখে উল্লসিত। বলিউডের অনেক বিতর্কের কথাও উঠে এল। কিন্তু একবারও তো বলা হল না যে, আপনার পাণ্ডিত্যটা বলিউডের একটা বড় অংশের ঠিক হজম হয়নি? না হলে বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে আপনার কথা, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার মন্তব্য বা ক্যাপশন তাদের এত দুর্বোধ্য ঠেকত কেন!
আর শুধু বলিউডকেই বা দোষ দিই কেন? আমরা, সাধারণ দু’-চারটে পাশ দেওয়া পাবলিক কতটুকু আর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে চাই? কেউ বলতে এলেই তো নিজেদের অজ্ঞানতার ভয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিই। ঝাল মেটাই সংখ্যাগুরু হওয়ার। তাকে বুঝিয়ে দিই, সে বড় বেশি জ্ঞান দিতে আসে। বড় বেশি পণ্ডিতি ফলায়। তার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। আপনার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বলিউড আপনাকে ঠিক একই ছকে দেখেছে। আপনি নিজে যতই বলেছেন আপনি প্যারাডক্স, তারা ততই সেটা নিয়ে ঠাট্টা করেছে। আপনি কেন অন্যদের থেকে আলাদা, সেটাই হয়ে গিয়েছে আপনার অপরাধ।
শুধু বলিউড নয়, মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমও। কখনও তাদের মধ্যে কেউ বলেছে, আপনার মাথায় ভিন গ্রহের জীব বাস করে, কখনও বা বলেছে আপনার চিন্তাশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত। ফলে আপনার চারপাশের আম আদমি-র হাতে সেটা ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না। তারা হিরোদের ঠাঁটবাট, পার্টি-হুল্লোড়, আয়েশ আরাম, আভিজাত্য, দেখনদারি দেখেই অভ্যস্ত। হিরো সার্নে যান, নাসায় যান! হিরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরলেই হাতে বই থাকে। হিরো আবার ফিজিক্স, নক্ষত্র আর চাঁদেই আটকে নেই! নিটশে, সার্ত্রে, মাসলো, কুন্দেরা, মুরাকামি... আরও না জানি কত কী পড়েন। মানে দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য... এ-ত-স-ব একসঙ্গে! ধুস, এত ‘আঁতেল’ বলিউডি হিরো পোষায় নাকি।
ছোট থেকে কোনও বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করলে আমাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু নম্বর তুলতে শেখায়। আপনি যেমন র্যাঙ্ক করেছিলেন, ওইটুকুই শুধু আমাদের দরকার। তার বাইরেও যে পড়াশোনাটা আপনি চালিয়ে যেতেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আপনি বেঁচে থাকতে জানতে পারিনি। পাত্তাও দিইনি। কিন্তু এখন কি একটু ভাবতে পারি? আপনার থেকে এইটুকু অন্তত শেখা যায়... যদি নিজেদের জানার পরিধিটা আমরা একটু বাড়ানোর চেষ্টা করি... কোনও কৌতূহলী মনের সন্ধান পাওয়ার পর যদি তাকে নিয়ে তামাশা না করে তার আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করি... সেটাই হয়তো হবে আপনার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা।
তবে আপনাকে সেভাবে বুঝতে-জানতে আমাদের আরও অনেক আলোকবর্ষ পেরতে হবে। যে ছোটখাট গণ্ডির মধ্যে আপনার অন্য সত্ত্বাটি পরিচিত ছিল, তার মধ্যে আমরা কখনওই পড়ি না। তাই ফ্রান্সের ইন্টারন্যাশনাল স্পেস ইউনিভার্সিটি আপনার মৃত্যুতে শোকবার্তা দিলে আমরা চমকে উঠি। বলিউডি-কেচ্ছার বাইরেও কিছু ছিল তাহলে!
আমাদের এই চেনা ছকের শব্দজব্দে আপনাকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা তাই ব্যর্থ। আমাদের জ্ঞানের ক্ষুদ্র পরিসরে আপনাকে বর্ণনা বা বিশ্লেষণের ক্ষমতা আমাদের নেই। আপনি তো এভাবেই আমাদের তৈরি করা মধ্যমেধার উল্লাসকে উড়িয়ে চলে যেতে পারেন... ঠিক এভাবেই!
মনের কাছে রয়ে যান শুধু আপনার মা। টেলিস্কোপে চোখ রেখে চাঁদ-তারাদের দেখতে দেখতে খুঁজে বেড়াতেন যাঁকে। ট্যুইটার, ইনস্টাগ্রামে ঘুরে ফিরে আসত তাঁর কথাই। তাঁর মৃত্যুদিন ১৩ ডিসেম্বর। বছর দুই আগে ওই দিনে আপনি ট্যুইট করেছিলেন, ‘কত বছর আগে এই দিনটায় তোমায় হারিয়েছিলাম। তারপর থেকে এমন একটা দিনও মনে করতে পারি না, যেদিন তোমার কথা ভাবিনি। সবাই বলে, তুমি তারা হয়ে গিয়েছ। হয়তো উজ্জ্বল লাল রঙেরটা তুমি। অথবা হয়তো মিটমিট করে জ্বলতে থাকা ওই নীল তারাটাই তুমি, যাকে আমি আজ রাতে চোখ মেলে দেখব। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রায়ই তোমার কথা ভাবি। শুধু জানাতে চাই, থ্যাঙ্ক ইউ। তুমি হয়তো ঠিকই বলতে মা, মনে হয় আমি তারাদের মধ্যেই এসে পড়েছি... তোমায় মিস করি মা, খুউব।”
আপনিও যে এখন ‘ধূসর নীলাভ এক তারা’...আমাদের খুঁজে ফেরা তার রংটুকুই।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : চিন্ময় গড়গড়ি