সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
দায়িত্ব নিয়েই বুঝতে পারলেন, কত বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর সামনে। দেশভাগের সময় সুকুমার সেন ছিলেন বাংলার মুখ্যসচিব। স্বাধীন ভারতের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব দেন পণ্ডিত নেহরু। ২১ মার্চ, ১৯৫০। সঙ্গে শুভেচ্ছাবার্তা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তাড়া আসতেও সময় গেল না। কারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ চালানোর জন্য নির্বাচন প্রয়োজন। পণ্ডিত নেহরুকে জবাবে জানালেন, তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। অপেক্ষা করুন। কারণ সুকুমার সেন বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণে প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হওয়া উচিত। সেই সময় ভারতে ২১ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ। যাঁদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ মানুষ না পড়তে জানেন, না লিখতে পারেন। যাঁরা জীবনে কোনওদিন ভোট দেননি, ব্যালট পেপার বা ব্যালট বক্স চোখেই দেখেননি, তাঁদের ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত আনতে হবে। সিংহভাগ জনগণ নিরক্ষর হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলির জন্য প্রতীকের ব্যবস্থা করতে হবে। যা দেখে একটি দল বা তার প্রার্থীদের চিনতে পারবেন মানুষ। প্রতিটি ভোটারকে শনাক্ত করতে হবে। তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে হবে। ভোটার তালিকা তৈরি করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি রাজ্যগুলিতে বিধানসভার ভোটও করাতে হবে। এজন্য সৎ, পরিশ্রমী ও দক্ষ অফিসারদের বাছাই করে নিয়োগ করার কাজ করতে হবে। দেশের কোণায় কোণায় ভোটগ্রহণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভোটের সরঞ্জাম সেইসব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটগ্রহণ নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করাতে হবে। স্বাধীন ভারত এক অভিনব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চলেছে। কিন্তু এভাবে এত বিশাল দেশে কোটি কোটি মানুষের ভোটগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা বা পরিকাঠামো, অভাব ছিল সব ক্ষেত্রেই। ফলে সব চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চললেন এক বাঙালি আইসিএস অফিসার। সবকিছু গুছিয়ে আনতে সুকুমার সেনের সময় লেগেছিল প্রায় ছ’মাস। ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর শুরু হয়ে পরের বছর ২৭ মার্চ পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মোট ৪ হাজার ৫০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। যার মধ্যে ৪৮৯টি লোকসভা আসন ছিল। বাকি বিধানসভার আসন। ভোট প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে গোটা দেশে ২ লক্ষ ২৪ হাজার বুথে ৫৬ হাজার প্রিসাইডিং অফিসার, ১৬ হাজার ৫০০ ক্লার্ককে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ব্যালট পেপার রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ২ লক্ষ বাক্স। গণনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন ২ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ। ভোট পাহারায় মোতায়েন করা হয়েছিল ২ লক্ষ ২৪ হাজার পুলিসকর্মী। প্রতিটি প্রদেশে দু’জন করে আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনার ও একজন করে মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুকুমার সেনকে সাহায্য করেছিলেন ভোট পরিচালনার কাজে।
সুকুমার সেনকে ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান নেপথ্যের নায়ক বলে মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। যথার্থই তাঁর এই উক্তি। বরেণ্য এই বঙ্গসন্তানের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২ জানুয়ারি। বাবা সিভিল সার্ভেন্ট অক্ষয়কুমার সেন। তিন ভাই। সুকুমার সেন বড়। মেজভাই অশোক সেন পরবর্তীকালে ভারতের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। ছোটভাই অমিয়কুমার সেন চিকিৎসক। কবিগুরুর সর্বশেষ চিকিৎসা তাঁর হাতেই। সুকুমারের পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতবিদ্যায় স্বর্ণপদক প্রাপ্তি। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে বাংলার মুখ্যসচিব পদে নিযুক্ত হন তিনি। শুধু প্রথম সাধারণ নির্বাচন নয়, ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনও সুকুমার সেনের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল।
১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সুদানে নির্বাচন পরিচালনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। পাশাপাশি, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হন সুকুমার সেন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে ভোট ব্যবস্থার রূপকার সুকুমার সেন পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানীত হয়েছিলেন।