সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
একসময় নিজের ভাইপো ১৮ বছরের আবু উসমানকে এম-৪ কার্বাইন নিয়ে কাশ্মীরে স্নাইপার আক্রমণে পাঠিয়েছিল মাসুদ। উসমান অবশ্য তাঁর দাদা তালহা রাশিদের থেকে বয়সে ছোট। তালহাকে ২০১৭ সালের নভেম্বরে পুলওয়ামায় নিরাপত্তারক্ষীরা খতম করেছিল। এবার এম-৪ কার্বাইন হাতে জঙ্গি উসমানের ছবি পাওয়া মাত্রই চিরুনি তল্লাশি শুরু করে নিরাপত্তা রক্ষীরা। গত বছর অক্টোবরে দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রালে আবু উসমানকেও নিকেশ করেছিল নিরাপত্তা রক্ষীরা। এই হত্যার দু’দিনের মধ্যে মাসুদ আজহার একটি তিন মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করে। ওই ভিডিওতে স্পষ্ট, দুই ভাইপোর পরপর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিল মাসুদ। মরণ-কামড় দিতে এই ভিডিওতে নিজের ভাইপোর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার পাশাপাশি সাধারণ কাশ্মীরিদের তার আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানায়। এই প্রথমবার সন্ত্রাসবাদে যোগ দেওয়ার জন্য মাসুদকে কাশ্মীরিদের কাছে ভিক্ষে চাইতে দেখা যায়। মাসুদ যে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল তা বলাই বাহুল্য।
জয়েশ জঙ্গিরা উপত্যকার পুলওয়ামায় ঘাঁটি তৈরি করল। শুরু হল পরিকল্পনা। কীভাবে চালানো হবে হামলা, তার নিখুঁত নকশা। পুলওয়ামা জেলার অবন্তীপুরার জাতীয় সড়ককেই বেছে নিয়েছিল মাসুদের জঙ্গিরা। ২০১৩ সাল থেকে ধরলে এই সড়কেই জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৮ জন জওয়ান। আসলে জঙ্গল ঘেরা এই জাতীয় সড়কের ১৫ কিলোমিটারে জঙ্গিদের অস্তিত্ব ঠাউর করাটাই কঠিন। এই জাতীয় সড়কেই রয়েছে একটা ছোট্ট বাঁক। উমেররা ঠিক করেই ফেলল এখানেই হামলা করা হবে। এতদিন এই রাস্তা দিয়ে জওয়ানদের কনভয় গেলে অন্য গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হতো না। সম্প্রতি সেই নিয়ম শিথিল হয়েছে। সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নিরাপত্তাবাহিনী অন্য গাড়ি চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে মরিয়া উমের।
ঘরের ছেলেই যখন মানববোমা!
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, জয়েশের প্রায় জনা পঞ্চাশ জঙ্গি উপত্যকায় সক্রিয়। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ আবার ভারতীয়। কাশ্মীরি। কামরানের নেতৃত্বেই দক্ষিণ কাশ্মীরে জয়েশ-ই-মহম্মদের নেটওয়ার্ক আরও মজবুত হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে উপত্যকার কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই করত সে। নাশকতামূলক কাজকর্মে তাদের যুক্ত করত। এরাই জওয়ানদের কনভয় চলাচলের যাবতীয় খবর পৌঁছে দিয়েছিল উমেরের কাছে।
৯ ফেব্রুয়ারি, সংসদভবন হামলায় সাজাপ্রাপ্ত আফজল গুরুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু কোনও কারণে তা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত নামানো হয়েছিল ‘কাশ্মীরি যুবক’ আদিল আহমেদ দারকে। আদিলের জয়েশে যোগ দেওয়ার কিছু দিন আগেই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় জয়েশের কাশ্মীর প্রধান মুফতি ওয়াকাস। ২০ বছরের আদিল যে জঙ্গি হয়ে উঠবে, তা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি উপত্যকা। দ্বাদশ শ্রেণির পড়া শেষ না করেই করাতকলে কাজে লেগে পড়েছিল ওই তরুণ। তারপর? গত বছরের ১৮ মার্চ বেপাত্তা হয়ে যায় সে। পরিবার যখন জানতে পারল, তখন হাতে একে-৪৭ নিয়ে সোশ্যাল সাইটে আদিলের ছবি পোস্ট হয়ে গিয়েছে। পোস্টে লেখা ছিল ‘ওয়াকাস কমান্ডো।’ দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার গুন্ডিবাগ গ্রামের সেই তরুণই এখন খবরের শিরোনামে।
প্রায় তিন মাস ধরে গাড়ি নিয়ে কনভয়ে ঢুকে আত্মঘাতী হামলা চালানোর অনুশীলন করেছিল আদিল। কীভাবে বিস্ফোরণ করতে হয়। আরডিএক্সের ব্যবহার ভালোভাবেই শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আদিলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার মাসুদ দিয়েছিল রশিদ গাজি ওরফে কামরানের উপরই। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি আদিলকে কাশ্মীরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।পুলওয়ামায় আধাসেনার কনভয়ে হামলার আগে শীর্ষ জয়েশ জঙ্গি নেতা এবং পাকিস্তানি ‘হ্যান্ডলার’-রা আদিল এবং তার সঙ্গীদের যোগাযোগ রেখেছিল ‘ওয়াই এসএমএস’ প্রযুক্তিতে। গোয়েন্দাদের দাবি, ওই প্রযুক্তি ব্যবহার হওয়াতেই হামলার আগে কোনও নজরদারিতেই ধরা পড়েনি জঙ্গিদের কথোপকথন।
তদন্ত করতে গিয়ে সেনা গোয়েন্দাদের হাতে জঙ্গিদের পাঠানো দু’টি বার্তা আসে। তার মধ্যে একটি বার্তায় রয়েছে: ‘সাকসেসফুল ফিউনেরাল অব মুজাহিদিন জয়েশ মহম্মদ’। দ্বিতীয় বার্তা হল: ‘ইন্ডিয়ান সোলজারস কিলড অ্যান্ড ডজনস অব ভেহিকলস ডেসট্রয়েড অন ফ্রেঞ্জি অ্যাটাক।’ এই বার্তা হাতে পাওয়ার পরই সেনা গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন জয়েশ জঙ্গিরা ‘ওয়াই এসএমএস’ প্রযুক্তিতে বার্তা চালাচালি করছে।
আদিলকে বেছে নেওয়ার আরও একটা কারণ রয়েছে। লেথপোরায় জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কের উপর যে জায়গায় রাস্তার ভুল দিক দিয়ে এসে বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি নিয়ে কনভয়ে হামলা চালায় ফিদায়েঁ জঙ্গি আদিল, সেখান থেকে তাঁর নিজের গ্রাম গান্ধীবাগের দূরত্ব বড়জোর ১০ কিলোমিটার। এই জেলার প্রতিটি রাস্তা, অলি-গলি খুব ভালো চেনে আদিল। তাছাড়া সংগঠন চালাতে গিয়ে মাসুদ দেখেছে স্থানীয় কাশ্মীরি জঙ্গিদের মনে একটা ক্ষোভ রয়েছে। স্থানীয় জঙ্গিরা মনে করে পাকিস্তানের জঙ্গিদের বেশি কঠিন কাজ দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাজে লাগানো হয় ছোটখাটো হামলায়। অনেক জঙ্গিই তাই বিরক্ত হয়ে সংগঠন ছাড়ার কথা ভাবছে। তাই এবার মাসুদ একেবারে ঘরের ছেলে আদিলকেই ওই দায়িত্ব দিয়ে এক ঢিলে দু’পাখি মারার চেষ্টা করে। প্রথমত, স্থানীয় জয়েশ জঙ্গিদের ক্ষোভ দূর হবে। আর দ্বিতীয়ত কাশ্মীরি দিয়ে হামলা করাতে পারলে পাকিস্তানকে আড়াল করা যাবে। আইএসআইয়ের দিকেও আঙুল উঠবে না। যদিও পুলওয়ামা হামলার পর প্রাক্তন মার্কিন গোয়েন্দা কর্তা ব্রুস রিডলের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘যেভাবে তড়িঘড়ি জয়েশ এই হামলার দায় নিয়েছে, তাতে এই ঘটনার পিছনে আইএসআই-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।’
প্রেম দিবসে হামলা
১৪ ফেব্রুয়ারি। বিকেলে সাড়ে ৩টে নাগাদ প্রায় ৭০টি গাড়ির বিশাল কনভয় জম্মু থেকে শ্রীনগরের পথে ফিরছে। অবন্তীপোরার লাট্টুমোরের কাছে সেই অভিশপ্ত জায়গায় হঠাৎই একটি গাড়ি দেখা গেল। বেশ দ্রুত গতিতে সব কনভয়কে ওভারটেক করে গাড়িটা যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কনভয়ের পাঁচ নম্বর গাড়িটার কাছে এসে ওই ছোট্ট গাড়িটা দুম করে ধাক্কা দিতেই বিস্ফোরণ। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল সমগ্র এলাকা। অনেকটা সিরিয়া ও আফগানিস্তানের কায়দাতেই জঙ্গি হামলা। গাড়িতে থাকা সিআরপিএফ জওয়ানদের দেহগুলি ছিটকে পড়ল ১০০ মিটার দূরে। সব ছিন্নভিন্ন। মুহূর্তে শহিদ হয়ে গেল ৪৯টি তাজা প্রাণ। সেদিন সারাটা দিন সূর্যের মুখ দেখেনি অবন্তীপোরা। বিকেলে কনকনে ঠান্ডা আর টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে বীভৎস এক ছবি। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে সেনাদের ছুটোছুটি, অ্যাম্বুল্যান্সের হুটার। ভিজে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে রক্ত-মাংস, মানব দেহের নানা অঙ্গের টুকরো। তারই পাশে পড়ে উড়ে যাওয়া ট্রাকের যন্ত্রপাতির অংশ, নাটবল্টু। পোড়া ডিজেল-মোবিলের কালোর পাশেই কালচে লাল টাটকা রক্তের পোঁচ। বাতাসে পোড়া গন্ধ। পথ ভুলে এ যেন সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের কোনও যুদ্ধক্ষেত্র!
বিস্ফোরণের অভিঘাতে বহু বাড়ি কেঁপে ওঠে। ফাটল ধরে কোনও কোনওটির দেওয়ালে। কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দে অবন্তীপোরা বাজার খালি হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। রাস্তায় পড়ে নিহত জওয়ানদের ব্যাগ, রুকস্যাক। জওয়ানদের কেউ ঘুরে ঘুরে রাস্তা থেকে সেগুলি কুড়িয়ে বড় বস্তায় রাখছেন। চোখে জল। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন শক্ত চেহারার মানুষগুলি। অসহ্য সেই দৃশ্য!
ঘটনার পরেই আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করে নিয়ে ভিডিও প্রকাশ করে মাসুদ আজহারের সংগঠন। ভিডিওতে জয়েশের মুখপাত্র মহম্মদ হাসান দাবি করে, হামলা চালিয়েছে আদিল আহমেদ ওরফে ওয়াকাস নামে তাদের এক ফিদায়েঁ। হামলার কয়েক মিনিট আগে তোলা আদিলের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে জয়েশের কয়েকটি হামলার কথা ফলাও করে বলে আদিল জানিয়েছে, এই ভিডিও যখন সকলে দেখবেন, তখন সে বেহস্তে। কী ভয়ঙ্কর ভাবুন!
সাংবাদিক সেজে জঙ্গি
১৯৯৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। শ্রীনগরে একজন ২৬ বছরের সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করল নিরাপত্তা বাহিনী। তার কাছে রয়েছে ভুয়ো পর্তুগিজ পাসপোর্ট। ২৬ বছরের ওই যুবককে দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই কেন পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এত পছন্দ করে তাকে। যুবকের নাম মাসুদ আজহার। মাসুদ তুখোর বক্তা। এবং একজন দক্ষ সংগঠক। তাই আইএসআইয়ের প্রিয়পাত্র সে। গোপনে তাকে সেই সময়কার জঙ্গি সংগঠন হরকত উল মুজাহিদিনের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে পাঠিয়েছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা। কিন্তু ধরা পড়ে যায় সে। জম্মুর ভালওয়াল জেলে তাকে দিনের পর দিন জেরা করেছেন সিকিমের প্রাক্তন ডিজিপি অবিনাশ মহানানে। সেদিনের জেরার কথা স্মরণ করে তিনি বলেছেন, ওকে জেরা করার কাজটা মোটেও কঠিন ছিল না। আর্মি অফিসারের একটা থাপ্পড় খেয়েই সব তথ্য দিয়ে দিয়েছিল মাসুদ। জেরায় গড়গড় করে আইএসআই, তাদের জেহাদ নিয়ে কথা বলত সে। কিন্তু গর্বের সঙ্গে জানাতে ভোলেনি, হিথরো বিমানবন্দরে সে নামলে, তাকে দেখতে ভিড় জমে যাবে। এমনকী, একথাও তদন্তকারীদের জানিয়ে দিয়েছিল, বেশিদিন সে জেলে থাকবে না। আইএসআই ঠিকই তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সত্যিই চেষ্টা হয়েছিল। অক্টোবর মাসে ইলিয়াস কাশ্মীরি আর ওমর সইদ শেখ নামে দুই কট্টর জঙ্গি তিন ব্রিটিশ আর এক আমেরিকানকে অপহরণ করে মুক্তিপণ হিসেবে মাসুদকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ধরা পড়ে যায় ওমর সইদ শেখ। তবে পালাতে সক্ষম হয় ইলিয়াস। এর পাঁচ বছর পরে ঘটে কান্দাহার বিমান অপহরণ ঘটনা। ৩১ ডিসেম্বর আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণ করল জঙ্গিরা। মুক্তিপণ হিসেবে জেল থেকে মাসুদ আজহারকে মুক্ত করে দিল তৎকালীন বাজপেয়ি সরকার। মাসুদ ছাড়া পেয়ে সোজা চলে গেল পাকিস্তান। তারপর সেখানে বসেই তৈরি করল নিজের সংগঠন, জয়েশ-ই-মহম্মদ।
ভারতের মাটিতে জয়েশ হামলা
২০০১। ভারতীয় সংসদে হামলা চালাল জঙ্গিরা। গোয়েন্দা বিভাগ দেখল এই হামলার নেপথ্যে জয়েশ জঙ্গিরা। অর্থাৎ ভারতের বুকে প্রথম বড় হামলা চালিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল মাসুদ। উপত্যকায় জয়েশ যে খুব একটা সক্রিয় ভূমিকায় ছিল তা মোটেই নয়। বরং লস্কর-ই-তোইবা বা হিজবুল মুজাহিদিনের জনপ্রিয়তায় আড়ালেই চলে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে ফের পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছে জয়েশ। কারণটাও অবশ্য পরিষ্কার। সাম্প্রতিককালে বুরহান ওয়ানি সহ হিজবুলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কমান্ডারকে নিকেশ করে দিয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। লস্করের লোকজনও তেমন নেই। তাই আইএসআইয়ের সবেধন নীলমণি বলতে এখন জয়েশ। মাসুদও নিজের সংগঠনের ‘জোশ’ দেখাতে বদ্ধপরিকর। পাঠানকোট, উরি, নাগরোটা থেকে শুরু করে পুলওয়ামা। উপত্যকায় নিজেদের অস্তিত্ব ভালোই জানান দিয়েছে মাসুদ। উপত্যকায় স্নাইপার হামলা জয়েশের আমদানি। এখন সোশ্যাল মিডিয়া ও এনক্রিপটেড মেসেঞ্জার ব্যবহার করা শুরু করেছে জয়েশ।
বরাবরই ভালো বক্তা হিসেবে নামডাক রয়েছে মাসুদের। পুলওয়ামা হামলার দিন কয়েক আগেই জয়েশের এক কর্মিসভায় ভাষণ দিয়ে সে বলে, গুগলে পুলওয়ামা সার্চ কর। দেখবে জয়েশের পতাকা। আর প্রত্যেক বাড়িতে জয়েশ প্রধানের ছবি। আমাদের প্রিয় ফিদায়েঁদের আত্মত্যাগে আমরা এই জায়গায় পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের কাজ শেষ হয়নি। ভাইপো উসমান আর তিন ফুটিয়া তলহার আত্মত্যাগের কথাও সকলকে শোনায় সে। এই ভাষণের ঠিক ন’দিনের মাথায় পুলওয়ামার হামলা। গোয়েন্দারা বলছেন, মাসুদ বেশ অসুস্থ। পাকসেনা হাসপাতালে ভর্তি। সেখানকার বেডে শুয়েই পুলওয়ামা হামলার ছক কষেছিল সে। খুব বিশ্বস্ত ছাড়া কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সেই পরিকল্পনা।
ফাঁকা আওয়াজ ইমরানের
সবে ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরছিলেন কেউ। কেউ আবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছুটিতে যাওয়ার। সংসার পাতার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন কেউ। কেউ আবার অবসর জীবনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সবই অধরা থেকে গেল। মুহূর্তে ৪৯ ভারতীয় জওয়ানের শহিদ হয়ে যাওয়ার পরও পুলওয়ামা হামলার দায় অস্বীকার করে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কে না জানে, কাশ্মীরে জঙ্গিদের রমরমার মদতদার পাকিস্তান। অতীতের প্রতিটি ঘটনাতেই তা হয়েছে। ভবিষ্যতেও যদি আরও একটা পুলওয়ামা ঘটে, তাহলে তা–ও হবে পাকিস্তানি মদতেই। অথচ, ইমরান সাংবাদিক সম্মেলন করে বলে দিলেন, পুলওয়ামা হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার প্রমাণ দিক ভারত। ভারত আক্রমণ করলে প্রত্যাঘাত, ফাঁকা আওয়াজ দিতেও ভোলেননি ইমরান।
ভারতের তরফে পাল্টা জবাব: মাসুদ আজহার বাহাওয়ালপুরে বসে আইএসআই-এর সঙ্গে আলোচনা করে হামলা ঘটিয়েছে। যান, তাকে গ্রেফতার করুন। না পারলে বলুন, আমরা আপনার হয়ে করে দিচ্ছি। আসলে পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় পাকিস্তান যোগ স্পষ্ট। পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট জয়েশ জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে সেই তথ্যপ্রমাণও উঠে এসেছে। তাই পাকিস্তানের উপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। জয়েশ হামলার দায় নেওয়ার পরে আর কী প্রমাণ চাওয়ার থাকতে পারে। ভারতীয় সেনার হাতে কামরান আর হিলাল নামে যে দুই জয়েশ জঙ্গি খতম হয়েছে, তারাও পাক নাগরিক বলে জানা গিয়েছে।
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বিস্ফোরণে যে আরডিএক্স ব্যবহার করা হ য়েছিল, তা অত্যন্ত উন্নত মানের ‘মিলিটারি গ্রেড’ আরডিএক্স। মিলিটারি গ্রেড, অর্থাৎ এই মানের আরডিএক্স ব্যবহার করে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতীয় সেনা। প্রাথমিক তদন্তের পরে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা এই নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গেই আরও নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে পুলওয়ামা নাশকতায় পাক যোগসাজশের বিষয়টি। শুধু এই বিস্ফোরকই নয়, তদন্তকারীদের স্ক্যানারে রয়েছে কয়েকটি ফোনকলও। পুলওয়ামা হামলার আগে ও পরে পাকিস্তান থেকে কয়েকটি সন্দেহজনক ফোনকল এসেছিল। এখন গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন, ওই ফোনকলগুলি কারা করেছেন এবং কাদের করা হয়েছে। তদন্তকারীরা মনে করছেন, জ্যারিকেনের মধ্যে আরডিএক্সগুলি রাখা হয়েছিল। সেই জ্যারিকেনগুলি মজুত করা হয়েছিল একটি গাড়িতে। আরডিএক্সের গুণমান ও তার ব্যবহার কৌশল দেখে তদন্তকারীরা নিশ্চিত ওই বিস্ফোরক পাক সেনাবাহিনীর কাছ থেকেই পাওয়া। এবং সেই বিস্ফোরক ব্যবহারের জন্য খুবই দক্ষ ব্যক্তি সীমান্তের ওপার থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তদন্তে অনুমান, ওই আরডিএক্স ভারতেই অ্যাসেম্বল করা হয়েছিল। ট্রিগার সুইচ, ডিটোনেটর ও পাওয়ার ফিউজ বিস্ফোরণের দিনক্ষণ ও সময় চূড়ান্ত হওয়ার পরেই তাতে বিস্ফোরকে লাগানো হয়েছিল। এক বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সাধারণভাবে আল-কায়েদা বা আইএস জঙ্গিরা যেমন বিস্ফোরণ ঘটায়, পুলওয়ামায় তেমনই হয়েছিল। বিস্ফোরণের পর এলাকাটি কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় ও সবকিছুই গলে গিয়েছিল।
উদ্বেগ একটাই! কাশ্মীরি জঙ্গিদের হাতে কি তাহলে পৌঁছে গিয়েছে মিলিটারি গ্রেডের আরও কিছু বিস্ফোরক? আরডিএক্স ছাড়াও যার মধ্যে আছে পিইটিএন (পেন্টাএরিথ্রিটল টেট্রানাইট্রেট) এবং টিএনটি (ট্রাইনাইট্রোটলুইন)।
ইমরান খানের পরের দিনই পুলওয়ামা হামলা নিয়ে মুখ খুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পুলওয়ামায় জয়েশ জঙ্গিদের হানাকে ‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি’ বলে উল্লেখ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলায় ‘যেই দোষী হোক, কড়া শাস্তি দিক পাকিস্তান’, মন্তব্য মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের সহ-মুখপাত্র রবার্ট পালাডিনোর। ভারতকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন পালাডিনো।
এবার ভারত কী করবে?
১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধ জয়ের পরবর্তী ১৮ বছর ধরে দু’দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। জোর করে শক্তি প্রদর্শন করে ভারত তার প্রতিবেশীর মানসিকতার পরিবর্তন করতে পেরেছিল। তবে তা বেশিদিন টেকেনি। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেহাদিরা কাশ্মীরে প্রবেশ করতে শুরু করে দিল। এর এক দশক বাদে, ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে হারের পর পাকিস্তান এই অসম যুদ্ধনীতি থেকে সরে এল। ততদিনে চার চারটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান। দেশের অর্থনীতি আরও একটি যুদ্ধ হারের চাপ সামলাতে পারবে না। এর পরেই কাপুরুষোচিত প্রক্সি সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার করে ভারতকে রক্তাক্ত করা শুরু করে দিল পাকিস্তান। কার্গিল পরবর্তী সময়ে একের পর এক জঙ্গি হামলা দেখা গেল। সংসদ ভবনে, মুম্বইয়ের ২৬/১১, গুরদাসপুর, পাঠানকোট, উরি এবং এবার পুলওয়ামা।
উরির হামলার পরে ভারত সার্জিকাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল। কিন্তু পুলওয়ামার পর কী হবে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে ভাতে মারতে মোস্ট ফেভারড নেশন প্রত্যহার করা অথবা আমদানি করা পণ্যে ২০০ শতাংশ কর চাপানোর কাজটা ভারত করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসলামাবাদকে একঘরে করার কাজও চলছে। যেভাবে আমেরিকা সহ ৪৮টি দেশকে ভারত পাশে পেয়েছে, তাতে কূটনৈতিকভাবে এগিয়ে মোদি সরকার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পুলওয়ামার বদলা ঠিক কেমন হবে? প্রথমত, মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গির তকমা দেওয়া। এক্ষেত্রে প্রধান বাধা চীন। এর আগেও তারা এই প্রশ্নে আপত্তি তুলেছিল। ফলে রাষ্ট্রসঙ্ঘ মাসুদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি বলতে পারেনি। তাই কূটনৈতিকভাবে চীনকে ম্যানেজ করতে পারলে ফায়দা পেতে পারেন মোদি। কিন্তু সেই কাজটি কঠিন। দ্বিতীয় প্রশ্ন হল সামরিক অভিযান। আবার সার্জিকাল স্ট্রাইক। কিন্তু এবার এই কাজ সফল হওয়া কঠিন। কারণ ঠেকে শিখে গিয়েছে জঙ্গিরা। তারা সীমান্ত থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বায়ুসেনার হামলা। কিন্তু পাক রেডারে ধরা পড়ে গিয়ে দু’একটি বিমান ধ্বংস হলে বা কোনও পাইলট বন্দি হলে ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। তৃতীয়ত, সোজাসাপ্টা যুদ্ধে যাওয়া। কিন্তু এর পরিণাম কোনও পক্ষেরই ভালো হবে না। চতুর্থত, যেটা হতে পারে, সেটি হল অপরাধীকে সরাসরি ধরা। আমেরিকা যেমনভাবে ওসামাকে খতম করেছে, তেমনিভাবে মাসুদ কিংবা হাফিজ সইদের মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গিকে পাকিস্তানের মাটি থেকে উপড়ে দেওয়া।
আকাশ থেকে মাসুদের ডেরাতেই আঘাত হানতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘প্রিসিশন এয়ার স্ট্রাইক’ অর্থাৎ নিখুঁত বিমান হানা। বায়ুসেনার সেই ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তার জন্য একেবারে নিখুঁত, গোয়েন্দা তথ্য থাকতে হবে। এ সব করতে গিয়ে পুরো দমে যুদ্ধ লেগে গেলে কী হবে, তার হিসেবও নিখুঁত ভাবেই কষতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পাকিস্তানকে বড় মাপের মূল্য চোকাতে হবে। পাল্টা আঘাত চালাতে বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
গোটা দেশও বলছে, পুলওয়ামার শহিদদের জন্য বদলা চাই!
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়