সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
বসন্তের প্রকৃতিজুড়ে রংয়ের ঝরনাধারা। শিমুলে, পলাশে সে কী শিহরণ! হৃদয়জুড়ে জেগে ওঠে আকুলতা। রাধার হৃদয়েও জাগে তীব্র প্রত্যাশা। তাঁর মন যেন বলে ওঠে, মাধব, তুমি কোথায়! আমার এই শ্যামহীন বিবর্ণতা মুছে দাও তুমি তোমার স্পর্শে। তোমার স্পর্শেই আছে পৃথিবীর অনন্ত রং। সেসব ছড়িয়ে পড়ুক আমার শরীরে, অন্তরে।
নন্দগাঁও থেকে বরষনা- কতটুকুই বা পথ। রাধা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। নন্দগাঁও থেকে কৃষ্ণের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রাধার মন অভিমানে ভরে ওঠে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে। এই পথেই রংয়ের ঝর্নাধারা বইয়ে দিয়ে আসবেন শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর পুরুষোত্তম। ভাবতে ভাবতেই যেন বাতাসে কী এক অপূর্ব গন্ধ ভেসে আসে। চকিত চমকে অস্থির হয়ে ওঠেন রাধা। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন আবির গুলালের ওড়না যেন আকাশটাকে ঢেকে দিচ্ছে। বিহ্বল চঞ্চলতায় উন্মুখ শ্রীরাধিকা। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও তিনি কৃষ্ণের দেখা পেলেন না। একজন গোপিনী এসে খবর দিলেন, কৃষ্ণ নাকি কুঞ্জে অন্য গোপিনীদের সঙ্গে রং খেলছেন। মনোকষ্টে রাধা ছুটে গেলেন কুঞ্জে। দেখেন সত্যিই তো, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে রং খেলছেন। আবিরে তাঁদের অঙ্গ মাখামাখি। সকলে হাসছেন, নাচছেন, রঙ্গ করছেন। রাধার তখন আত্মবিস্মৃত অবস্থা। এ দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তাড়াতাড়ি গিয়ে কৃষ্ণকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে, তাঁকে অন্যদের সঙ্গে হোরিখেলা থেকে বিরত করলেন। রাধার চোখে তখন ঈর্ষা। কেন কৃষ্ণ অন্যদের রং দেবেন? রাধার চোখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ সব বুঝতে পারেন। রাধার অঙ্গে রং মাখিয়ে দিয়ে তাঁকে রাগাতে থাকেন। বলেন, অভিমান হয়েছে তো! রাধাও বুঝতে পারেন, কৃষ্ণের উদ্দেশ্য। তিনি তাঁকে একটু রাগাতে চেয়েছিলেন। রাধাও তখন কপট রাগে কুঞ্জবন থেকে একটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণকে মারতে থাকেন। কৃষ্ণও কপট আত্মরক্ষার ভান করেন। তাঁদের ঘিরে হাসতে থাকেন চন্দ্রাবলী, বিশাখা, ললিতা, চিত্রা সহ অষ্টসখী।
আজও দোলের দিন বরষনার মাটিতে সেই একই হোলিখেলা হয়। শতাব্দী কালের প্রবাহ পেরিয়ে একইরকম রঙিন ব্রজধাম। বরষনায় এখনও হয় লাঠমার হোলি। আজও নন্দগাঁও থেকে শতশত গোপ পুরুষ রাধার গ্রাম বরষনায় গিয়ে গোপিনীদের রং দেন। গোপিনীরা তাঁদের লাঠি দিয়ে মারেন। আর গোপরা আত্মরক্ষার ভান করেন। সাতদিন ধরে চলে লাঠমার হোলি। লাঠমার হোলির পর চলে রং খেলা। সঙ্গে রসিয়া নাচ ও গান। এরসঙ্গে ভাঙ সেবন তো আছেই। তাকে ওরা বলে ঠান্ডাই। চলে মিষ্টি বিলি। শরীরের রং, মনের রং আর প্রকৃতির বুকের ফুটে ওঠা সলজ্জ পলাশের রং মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
সেই কবে থেকে এখানে চলে আসছে দোল খেলা। এর সূচনা তো কৃষ্ণের হাত ধরেই। পুতনাকে কৃষ্ণ বধ করেন। পুতনার বিষদুধে কৃষ্ণের সারা অঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। আর কালাচাঁদ তখন রাধার গৌরবর্ণ দেখে ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠলেন। একদিন মা যশোদাকে গিয়ে তিনি অনুযোগের সুরে বললেন, ‘রাধা কিঁউ গোরি, ম্যায় কিঁউ কালা?’ দুষ্টু কানাইকে শান্ত করার জন্য যশোদা বললেন, যাও, তুমি গিয়ে রাধাকে রং মাখিয়ে দিয়ে এসো। দেখবে রাধা আর গোরি থাকবে না। সেকথা শুনে কৃষ্ণ রাধাকে গিয়ে রং মাখিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।
রাধা কখনও ভোলেনি সেই রং খেলার স্মৃতি। প্রতিবারই রং খেলার শেষে রাধা ভানোসর সরোবরে তাঁর অঙ্গরাগ ধুয়ে ফেলতেন। সেই সরোবর খনন করেছিলেন রাধার বাবা বৃষভানু। কত রং ছিল সেই জীবনে! তবুও একদিন সারা জীবনের জন্য বিবর্ণতার রংয়ে রাধাকে সঁপে দিয়ে কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেন। আর কখনও দেখা হয়নি রাধার সঙ্গে। সেই ভানোসরের পাড়ে বসে, কিংবা কুঞ্জের ভিতরে বসে রাধা মগ্ন থাকতেন কৃষ্ণের ধ্যানে। পরবর্তী দিনগুলিতে রাধা বেঁচেছিলেন সেই রংয়ের স্মৃতি নিয়েই। ‘সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে।’ আকাশের কৃষ্ণবর্ণ মেঘের দিকে তাকিয়ে রাধা খোঁজেন কৃষ্ণের অস্তিত্ব। সে ভাবসম্মিলনের রং ধুসর।
রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার সেই স্মৃতিকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রজধামের মানুষ। বৃন্দাবন, মথুরা, বরষনা, নন্দগাঁও সর্বত্রই হোলিখেলার উন্মাদনা নজরে পড়ে। এই সময় এখানে বাইরে থেকে বহু মানুষ আসেন হোলিখেলার সাক্ষী হতে। সকলে রংয়ের ধারায় স্নাত হয়ে ওঠেন। তবে লাঠমার হোলি খেলার অধিকার সকলের থাকে না। এ খেলা কেবল নন্দগাঁও এবং বরষনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাইরের কেউ এ খেলায় অংশ নিতে পারেন না। অবশ্য হরিয়ানাতেও লাঠমার হোলির মতো খেলা দোলের সময় হয়। তাকে স্থানীয় ভাষায় বলে, ধুলেন্ডি হোলি।
বরষনায় একমাস ধরে হোলি খেলা হয়। হোলিখেলার মাসখানেক আগে থেকে এখানকার মায়েরা তাদের মেয়েদের বলে, ভালো করে একটু খাওয়া দাওয়া কর। নাহলে লাঠমার হোলিতে লড়াই করবি কী করে! সেখানে জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে হোলিখেলা। ব্রজধামের শ্রীকৃষ্ণ জন্মস্থান মন্দির, বাঁকেবিহারী মন্দির, দ্বারকাধীশ মন্দির, যুগলকিশোর মন্দির, গোবিন্দদেব জির মন্দির সর্বত্র ভক্তদের ভিড় দেখা যায়। আবির যেন পাখা মেলে ওড়ে। রাঙিয়ে দেয় মানুষকে। ধর্মের বন্ধনের মধ্য দিয়ে আত্মিক মিলনের সুর বেজে ওঠে। যা ছড়িয়ে পড়ে মন্দিরের বাইরের সামাজিক জীবনেও।
তবে একটা কথা ঠিক। বৈষ্ণব পদকর্তাদের কথায় বা পুরাণে রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলার প্রসঙ্গ খুব একটা আসেনি। পরবর্তীকালে অবশ্য বহু কবি হোলিখেলাকে ছন্দোবন্ধনে ধরেছিলেন। এক বৈষ্ণব পদকর্তা লিখলেন, ‘আবির অরুণ-নব বৃন্দাবন উড়ি তা গগন ছায়। / বঁধুয়া আমার হিয়ার মাঝারে, কেহ না দেখিতে পায়।’ তবে শিল্পীরা তাঁদের ছবিতে এই রং খেলার দৃশ্যেকে নানা ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত করেছেন। কুলু কাংড়ার পাহাড়ী চিত্রকলা থেকে রাজস্থানী চিত্র বা দাক্ষিণাত্যের ছবি অথবা মুঘল মিনিয়েচার কিংবা বাংলার পটচিত্র, সর্বত্রই শিল্পীর বিষয় হয়ে উঠেছে রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলা। এই হোলিখেলা যেন তাঁদের অন্যতর প্রেমের প্রকাশ। হোলিখেলার মধ্য দিয়ে আমরা যেন জীবনের সেই প্রেমকেই প্রকাশ করি। ভক্তির সঙ্গে মিশে থাকে সামাজিকতার আনন্দ, পরম্পরা। আমাদের জীবনে এ যেন এক পূর্ণতার অনুসন্ধান।