ভগবতী ভারতী
সন্দীপন বিশ্বাস
এক অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের। মনের গভীরে তাঁর অনুরণন তুলেছে রামায়ণ মহাকাব্য। তাকে তিনি নবভাষ্যে উপস্থাপিত করতে চান। তা কি সম্ভব! কিন্তু তাঁকে সেই কাব্যকথা নব জাগরণের আলোকে ভাস্বর করে তুলতেই হবে। শুরু হল এক আধুনিক মহাকাব্যের কথন। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। মাইকেল জানতেন, দেবী সরস্বতীর বরে বাল্মীকি কবিত্বশক্তি লাভ করেছিলেন। মহামূর্খ কালিদাসও হয়ে উঠেছিলেন মহাকবি। তাই তিনি কাব্যের সূচনায় দেবীর কাছে কৃপাপ্রার্থনার মাধ্যমে শুরু করলেন তাঁর কাব্য। ‘আমি ডাকি আবার তোমায়, শ্বেতভূজে/ ভারতী! যেমতি মাতঃ বসিলা আসিয়া, / বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন) /...তেমতি দাসেরে, আসি, দয়া কর সতি।’
কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা দেবী সরস্বতীর বরপুত্র বা বরপুত্রী। তাই অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের যাত্রাপথে চলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা তাঁর আরাধনা করে আসছি। দেবী সরস্বতীর প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় বেদে। বৈদিক মুনিরা ধ্যানমন্ত্রে তাঁর আরাধনা করতেন। সেখানে তিনি কিন্তু বিদ্যার দেবী ছিলেন না। তিনি প্রকাশিত হয়েছিলেন শক্তির আর এক রূপে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেখা যায়, শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে দেবী যে রূপে বিনাশ করেছিলেন, সেই মূর্তিই মহাসরস্বতী। তিনি অষ্টভুজা। তবে সেই শক্তির মধ্যেও প্রকট ছিল জ্ঞানের ভাব। অসুরবধ করার সময় তিনি শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান প্রদান করেন। পরে কালে কালে তিনি হয়ে ওঠেন বিদ্যার দেবী।
আজ সেই বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পুজো। সেই পলাশপ্রিয়ার আরাধনায় মেতে উঠেছে সকলে। ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে..’। এই মন্ত্রে প্রদান করা হচ্ছে অঞ্জলি।
শক্তির দেবী সরস্বতীই কালক্রমে হয়ে উঠেছেন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের প্রতিমা। তাই কবি অনায়াসে তাঁর বন্দনাগানে কুচযুগের সৌন্দর্য প্রকাশ করে ফেলেন। আজ আমরা যে সরস্বতীর পুজো করি, তাঁর রূপ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি দেবী দুর্গা ও শিবের কন্যা। তাঁকে নিয়ে পুরাণ বা শাস্ত্রে অসংখ্য কাহিনী রয়েছে। সেগুলির মধ্যে তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সরস্বতীর উৎস সন্ধানে গেলে অনেক সৃষ্টি তত্ত্ব মেলে। কখনও তিনি ব্রহ্মার কন্যা, কখনও তিনি শিবের কন্যা, কখনও তিনি দক্ষরাজ কন্যা। আবার তাঁর স্বামী হিসেবেও অনেককে পাওয়া যায়। কখনও তিনি ব্রহ্মার ঘরণী, কখনও নারায়ণের জায়া, আবার কখনও তিনি কাশ্যপ মুনির পত্নী।
তাঁর উৎস সম্পর্কিত একটি কাহিনী থেকে জানা যায়, ব্রহ্মা পৃথিবীতে সৌন্দর্য ও জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে সৃষ্টি করেছিলেন সরস্বতীকে। একদিন তিনি সরস্বতীকে বললেন, ‘যাও তুমি জগৎকে আলো দেখাও। কাব্য, শাস্ত্র সৃষ্টি করে জগৎকে জ্ঞানগরিমায় ব্যাপৃত কর এবং জগতের পূজ্য দেবী রূপে নিজেকে অধিষ্ঠিত কর।’
কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব, তা সরস্বতী বুঝতে পারেন না। তখন ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, ‘তুমি কোনও একজন কবির জিহ্বায় অধিষ্ঠান করে তাঁকে দিয়ে কাব্য সৃষ্টি কর। সেই সৃষ্টিই হবে জগতের প্রথম কাব্য। তাঁর কবিত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে তোমারও মহিমা।’
একথা শুনে সরস্বতী সেই যোগ্য ব্যক্তির খোঁজ করতে লাগলেন, সত্যযুগ ধরে খুঁজলেন। অনুসন্ধান করলেন দেবলোক, সুরলোক। কিন্তু তেমন কাউকেই পেলেন না। অতঃপর তিনি ত্রেতাযুগে এলেন মর্ত্যধামে। একদিন তিনি বেড়াতে বেড়াতে চলে এলেন তমসা নদীর তীরে। দেখলেন সেখানে এক মুনিঋষি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎই এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল। দেখলেন মিথুনরত বকের একটিকে এক নিষাদ তীর ছুঁড়ে বধ করল। আর অপর বকটি বাক্রহিত। সে কাতর অভিব্যক্তিতে যন্ত্রণাবিদ্ধ বকটির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সম্মুখে দাঁড়ানো সেই ঋষিকেও স্পর্শ করল সেই বকের যন্ত্রণা। তিনি যেন অস্ফুটে প্রকাশ করতে চাইছেন সেই যন্ত্রণাকে। কিন্তু তাঁর বাক্য সরছে না। যে ভাষায় তাকে তিনি মূর্ত করতে চাইছেন, তা তাঁর আয়ত্তাধীন নয়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সরস্বতী বুঝতে পারলেন, এই সেই যোগ্য ব্যক্তি। এঁর অনুভূতি আছে, কিন্তু ভাষা নেই। এই মুহূর্তে এঁর মুখে ভাষা দেওয়া দরকার। এমনতর উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেই ঋষির জিহ্বায় অবস্থান করলেন। অমনি সেই ঋষি বলে উঠলেন, ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠান্ ত্বমগম শাশ্বতী সমা যৎ ক্রোঞ্চামিথুনাদেকমবধী কামমোহিতম।’
নিজের সেই মুখনিঃসৃত শ্লোক শুনে নিজেই চমকে গেলেন ঋষি। এ কী বললেন তিনি! এই কাব্যমূর্চ্ছনা তিনি কোথায় পেলেন! এমন বিদ্যাবুদ্ধি তো তাঁর নেই। তিনি তো ছিলেন একজন দস্যু। সাধনার বলে ঋষি হয়েছেন মাত্র। তাহলে কী করে তিনি এই প্রজ্ঞা অর্জন করলেন! এই প্রজ্ঞার উৎসই হলেন দেবী সরস্বতী। তাঁর ইচ্ছাতেই বাল্মীকি হয়ে উঠেছিলেন মহাপণ্ডিত। পৃথিবীর আদি শ্লোক তাঁরই মুখ থেকে নির্গত হয়েছিল দেবী সরস্বতীর কৃপায়।
এমনই কৃপাধন্য হয়েছিলেন আর এক মুর্খ কালিদাস। যিনি একই ডালে বসে সেই ডাল কাটতে উদ্যত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাজকুমারী বিদ্যোত্তমার। রূপে গুণে অনন্যা রাজকুমারী তাঁর স্বামীর মুর্খামির কথা জানতে পেরে তাঁকে বিতাড়িত করেন। মনের দুঃখে কালিদাস নদীতে আত্মহত্যা করতে গেলেন। তখন সেখানে দেবী সরস্বতী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে কবিত্বের বরদান করলেন।
বহু শাস্ত্র ও পুরাণজুড়ে ছড়িয়ে আছে সরস্বতীকে নিয়ে নানা কাহিনী। পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ড থেকে আমরা একটা কাহিনী পাই। ব্রহ্মা একবার সহ্যাদ্রি শিখরে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিষ্ণু সহ অন্য দেবতারাও। যজ্ঞচলাকালীন বিষ্ণু বললেন, ‘এখনই ব্রহ্মার জ্যেষ্ঠ স্ত্রী সরস্বতীকে ডেকে আনো। তিনি এসে ব্রহ্মার দক্ষিণ দিকের আসনে বসুন।’ সরস্বতী সময়মতো উপস্থিত হতে পারলেন না। কিন্তু যজ্ঞের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তখন বিষ্ণু ব্রহ্মার দ্বিতীয় স্ত্রী গায়ত্রীকে ব্রহ্মার দক্ষিণের আসন গ্রহণ করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর সরস্বতী এসে সপত্নী গায়ত্রীকে দক্ষিণ আসনে উপবিষ্ট দেখে রুষ্ট হলেন। কেননা ওই প্রধান আসনটি তাঁর জন্যই। উপেক্ষিত অনুভবে সরস্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে উপস্থিত সকল দেবতাকে অভিসম্পাত করতে লাগলেন। তাঁদের তিনি বললেন, ‘আপনারা আমার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, আপনারা নদীরূপ প্রাপ্ত হবেন। আর গায়ত্রী নদী হবে অদৃশ্য এবং নিম্নগামী।’
সরস্বতীর অভিশাপে ক্রুদ্ধ হলেন গায়ত্রীও। তিনি বললেন, ‘এই আসনে বসার পিছনে আমার কোনও অভিসন্ধি নেই। সকলের অনুরোধেই আমি এই আসনে বসেছি। তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে অভিশাপ দিলে। আমিও তোমাকে একই অভিশাপ দিচ্ছি। তুমিও নদীরূপে নিম্নপ্রবাহিনী হবে।’ সেই অভিশাপের পর ব্রহ্মা হলেন কুকুদ্মিনী নদী, বিষ্ণু হলেন কৃষ্ণা, শিব হলেন বেণী। তাঁরা সেই সহ্যাদ্রি পর্বত থেকে বিভিন্ন দিকে প্রবাহিত হলেন। সরস্বতী ও গায়ত্রী মর্ত্যে এসে নিম্নপ্রবাহিনী হলেন। এই কারণেই দেবী সরস্বতীকে বলা হয়েছে ‘নদীতমে’। এর অর্থ নদীদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ। এছাড়াও বেদে তাঁকে বলা হয়েছে ‘দেবীতমে’ এবং ‘অম্বিতমে’।
কেন তাঁর নাম সরস্বতী হল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন সরস শব্দের অর্থ হল জল। আবার কেউ বলেন সরস শব্দটা এসেছে জ্যোতিঃ থেকে। তাই সূর্যের আর এক নাম সরস্বান্। আসলে সরস্বতী নদীরূপা, শক্তিরূপা হয়ে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিদ্যারূপা হয়ে উঠেছেন।
বেদেই দেবীকে তিনটি নামে অনুধ্যান করা হয়েছে। যেমন ইলা, সরস্বতী এবং ভারতী। ভূলোকে তিনি ইলারূপে, অন্তরীক্ষে তিনি সরস্বতী রূপে এবং স্বর্গলোকে তিনি ভারতী রূপে আরাধ্যা। আবার যখন শক্তিতত্ত্বের আলোকে তাঁকে বিচার করা হয়, তখন দেখা যায় তিনি ত্রিরূপে বিভক্ত। দুর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের তত্ত্বকে প্রকাশ করি, সেভাবেই দুর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর মধ্য দিয়ে আমরা শক্তি, শ্রী ও ধী তত্ত্বকে প্রকাশ করি। তন্ত্রেও স্মৃতি, মেধা, প্রজ্ঞা অর্থে সরস্বতীকেই বোঝানো হয়েছে।
বিভিন্ন পুরাণে দেবী সরস্বতীর বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন ব্যাখ্যা। স্কন্দপুরাণে তিনি চন্দ্রশেখরা। অগ্নিপুরাণে তিনি নীলকণ্ঠী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি হংসবাহনা। তবে কোথাও কোথাও তাঁকে ময়ূরবাহনা, সিংহবাহনা এবং মেষবাহনা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। বোঝা যায় এসব ক্ষেত্রে সরস্বতী শক্তির দেবতা হয়ে উঠেছেন।
বিভিন্ন নামে তাঁকে পুজো করা হয়। সোম, সরণ্যু, পুষা, সুষমা, শুভ্রা, সপ্তস্বষা, ধনদাত্রী, অন্নদাত্রী, বাজিনীবতী, পাবকা, ঘৃতাচী, হিরণ্যবর্তিনী, যশোভগিনী, ভবিষ্মতী, জাগৃবী এমন বহু নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আমরা যে দেবী সরস্বতীর পুজো করি, তাঁর দুই হাত। কিন্তু বহু জায়গায় তাঁর চারটি হাত দেখা যায়। এই চার হাত চারটি বিষয়কে উপস্থাপিত করেছে। এগুলি হল, মন, বুদ্ধি, নিষ্ঠা এবং আত্মবিশ্বাস। আবার বলা হয়, চারটি হাত চারটি বেদকে প্রকাশ করেছে। ঋক, সাম, যজু এবং অথর্বের মূল বিষয় হল গদ্য, পদ্য এবং সঙ্গীত। দেবীর চারহাতে আছে বই, মালা, বীণা এবং কমণ্ডলু। এর প্রতিটির মধ্য দিয়ে এক একটি বিষয়কে প্রকাশ করা হয়েছে। বই হল গদ্য, মালা হল কাব্য, বীণা হল সঙ্গীত। এছাড়া কমণ্ডলুর জলের দ্বারা শিক্ষার মধ্য দিয়ে মনকে পবিত্র করে তোলার ব্যঞ্জনাই প্রকাশিত হয়েছে।
পাশাপাশি আবার অষ্টভূজা সরস্বতীর মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। সেই আটটি হাতে তিনি ধারণ করে আছেন শঙ্খ, চক্র, অঙ্কুশ, তির, ধনুক, ঘণ্টা, বীণা এবং গদা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিল্প এবং শক্তিই দুটোই তাঁর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত।
বেদের একটি জায়গায় সরস্বতীকে ধেনুরূপেও উপাসনার কথা বলা হয়েছে। ‘বাচং ধেনুমুপাসীত’। ধেনুর যেমন চারটি স্তন, তেমনই সরস্বতীর চারটি স্তনের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলি হল স্বাহাকার, স্বধাকার, বষট্কার এবং হন্তকার। এখানে দেবীকে বাকরূপে উপাসনার কথা বলা হয়েছে।
শতপথ ব্রাহ্মণে আমরা সবস্বতীকে তুষ্ট করার জন্য বলির উল্লেখ পাই। এ নিয়ে একটি কাহিনীও আছে। ইন্দ্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নিহত হলেন ত্বষ্টাপুত্র বিশ্বরূপ। সেকথা শুনে ইন্দ্রকে জব্দ করার জন্য ত্বষ্টা একটি শক্তিশালী সোমরস সংগ্রহ করলেন। সেই সোমরসের প্রতি লোভ জন্মাল ইন্দ্রের। তিনি জোর করে সেই সোমরস পান করলেন। এতে ইন্দ্রের ক্ষতি হল। তিনি তাঁর বলবীর্য সব হারালেন। ইন্দ্রের এই অবস্থা দেখে অসুর নমুচি প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করলেন। দেবতারা এতে প্রমাদ গণলেন। তাঁরা ঘোষণা করলেন, ‘যিনি ইন্দ্রকে পুনরায় বলশালী করে তুলতে পারবেন, তাঁর আনন্দবিধানের জন্য পশুবলি প্রদান করা হবে।’ ইন্দ্র সরস্বতীর কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনার মধ্যে তো সুস্থতা প্রদান করার শক্তি আছে। আপনি আমাকে ভালো করে দিন।’ সেকথা শুনে দেবী সরস্বতী সৌত্রামণী যজ্ঞের সূচনা করলেন। সেই যজ্ঞের পর ইন্দ্র সুস্থ এবং পুনরায় বলশালী হয়ে নমুচিকে বধ করলেন। এর ফল হিসেবে দেবতারা সরস্বতীকে বলি স্বরূপ মেষ উপহার দিলেন।
এমনই আর একটি কাহিনী পাওয়া যায় ব্রহ্মাকে নিয়েও। তিনি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে করতে একবার ক্লান্তি অনুভব করেন। সেই সময় তাঁর ক্লান্তি দূর করতে দেবতারা এগারোটি বলির আয়োজন করেন। এর মধ্যে একটি বলি সরস্বতীর প্রতি নিবেদিত। সেটি ছিল মেষ। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, সরস্বতী হলেন বাগ্দেবী। বলির পর সরস্বতী হলেন তুষ্ট। বাক্ শক্তিশালী হতেই প্রজাপতি ব্রহ্মা বল ফিরে পেলেন। আজ অবশ্য বলি হয় না। তবে শোনা যায় বাংলাদেশের কোথাও কোথাও আজ এই বলিপ্রথা চালু আছে। সেখানে ছাগবলি দেওয়া হয়। আবার কোথাও কোথাও সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ খাওয়ার প্রথাও চালু আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমাদের এখানে মেয়েদের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার অধিকার ছিল না। তখন মেয়েদের শিক্ষা ছিল নাস্তি নাস্তি। তাই সমাজপতিরা এমন বিধানই করেছিলেন। কালক্রমে তা দূর হয়ে যায়।
বৌদ্ধশাস্ত্রেও দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁদের নানা নাম। যেমন নীল সরস্বতী, বজ্রসরস্বতী, আর্যসরস্বতী, জাঙ্গুলতারা প্রভৃতি।
শুধু আমাদের দেশেই নয়, তিব্বত, জাপান, জাভা, সুমাত্রাতেও দেবী সরস্বতীর পুজোর প্রচলন আছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ও রূপে তাঁর আরাধনা করা হয়। জাপানে দেবীকে বলা হয় বেন তেন। তিনি বীণা হস্তে ড্রাগনের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বোধের দেবী, যশের দেবী, প্রেমের দেবী। তিব্বতের দেবীকে বলা হয় যং চন ম। যং মানে সুমিষ্ট স্বরের অধিকারী যিনি। তিনি ময়ূরবাহনা এবং তাঁর হাতে থাকে বীণা। এভাবে আমরা নানা দেশে, নানা রূপে সরস্বতীকে পাই।
মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই আমরা তাঁকে বিদ্যার দেবী বলে মেনে আসছি। মনে করা হয়, গুপ্তযুগ থেকেই তাঁকে বীণাপাণি এবং হংসাসীনা রূপে পুজো করা হচ্ছে। তবে পণ্ডিতপ্রবর যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, আজ আমরা যে রূপে সরস্বতীর পুজো করি, তা মোটামুটি দুশো-আড়াইশো বছরের পুরনো। সেই রূপের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বিদ্যার দেবী। তাই তাঁর শ্বেতবস্ত্র। তাঁর শ্বেতবস্ত্র শুদ্ধ মনের প্রতীক। তাঁর শ্বেতপদ্ম নিষ্কলঙ্ক ভাবের প্রতীক। পদ্ম হল প্রস্ফুটিত জ্ঞানের প্রতীক। তাঁর হাতের বীণায় সপ্ততার। সেই সপ্ততারের অনুরণনে ঝংকৃত হয় একটিই সুর। জ্ঞানের সেই ঐক্যবোধের প্রকাশ তাঁর হাতের বীণাটিতে। সরস্বতীর প্রিয় ফুল পলাশ। সেই ফুল পবিত্রতার প্রতীক। তাঁর পায়ের কাছে রাখা কালি, কলম ও দোয়াত। সেগুলি জ্ঞানের বিস্তারের প্রতীক। তিনি নিজেই হলেন জ্ঞানের এক অনন্ত প্রবাহ।
দেবী সরস্বতীর বাহন হংস কেন? এ নিয়েও নানা ব্যাখ্যা আছে। এ জগতে জ্ঞান এবং অজ্ঞান মিলেমিশে আছে। তার মধ্য থেকে জ্ঞানময় পরমাত্মাকে বেছে নিতে হবে সাধককে। যেমনভাবে দেবীর বাহন হংস দুধটুকু শুষে খেয়ে নেয় এবং জলটুকু পরিত্যাগ করে, তেমনই বিবেকসর্বস্ব হতে হবে সাধককে। তাঁকে হতে হবে পরমহংস। তাই দেবীর বাহন হংস। সে জলে থাকে। কিন্তু জল তার পাখায় লাগে না। তার নিত্যবস্তুর সারবত্তা এবং অনিত্যবস্তুর অসারতা যাচাই করার ক্ষমতা আছে। সে জল এবং স্থল দুই ক্ষেত্রেই বিচরণ করতে পারে। সুতরাং দেবীর বাহন হংসের মধ্যে জ্ঞানমার্গের পথে চলা সাধকের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত সেটাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ হংস হল অনুসন্ধিৎসার প্রতীক।
সকলেই তাঁর প্রতি প্রণত। আলঙ্কারিক দণ্ডী তাঁর কাব্যের সূচনায় প্রণত হয়েছেন দেবী সরস্বতীর কাছে। বলেছেন, ‘সর্বশুক্লা সরস্বতী’। এছাড়া অশ্বঘোষ, কালিদাস, বাণভট্ট, ভবভূতি, কলহণ প্রমুখ কবির কাব্যের সরস্বতীর উল্লেখ পাই।
দেবতারাও তাঁর কাছ থেকে বাক্ভিক্ষা করেন। ‘যা ব্রহ্মাচ্যূত শঙ্কর প্রভৃতিভি দেবৈ সদা বন্দিতা।’ অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর সদাই তাঁর বন্দনা করেন। ‘সা মে বসতু জিহ্বায়াং বীণাপুস্তকধারিণী।’ অর্থাৎ তাঁদেরও প্রার্থনা, দেবী সরস্বতী তাঁদের জিহ্বায় অধিষ্ঠান করুন। আমরাও বলি, ‘বীণারঞ্জিতপুস্তক হস্তে। ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে।’ মা সরস্বতী, তোমাকে প্রণাম।
অঙ্কন ও গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়
10th February, 2019