বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
লিন্ডসে স্ট্রিটের মাথায় দুই হনুমানবেশীর লম্পঝম্ফ দেখে জনগণের কৌতুকোক্তি ভেসে আসছিল—একজন গ্রাম্য সরল জাদুঘর দেখতে এসেছিল। সে বলল, মদনপুরের বহুরূপী দুটো হেথায় চলে এয়েচে। জটিল সংশয়ীরা বললেন, কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের উত্থানকল্পে নিচুতলার কর্মীরা নিজস্ব ঢঙে প্রচার চালাচ্ছে। আর বয়স্করা বললেন, বাঁদরামির একটা সীমা আছে। রামায়ণের বানররা বাঁদরামি করে লঙ্কাযুদ্ধ জয় করেনি। তারা অনেক সিরিয়াস লোক ছিল।
বুড়োর কথা যে মিথ্যে নয়, সেটা বোধহয় ওই বিশেষ রাজনীতির কলাবিদেরা বুঝে গিয়েছেন। ফলে এবারে আর তাঁরা হনুমানের সং নামাচ্ছেন না রাস্তাঘাটে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে— যে রাজনৈতিক দল সং ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো বোঝে, তারা যদি হঠাৎ অকাণ্ডে বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে ওঠে, তাহলে তাঁদের মনে মোহ-বিভ্রম তৈরি হয়। তার ফলে তাঁরা এবার হনুমানের গোত্র-পরিচয় নিয়ে এক-একজন একেক কথা বলছেন। এঁদের আবার সবাই নেতা। একটা শূন্য গোলক তাড়াতাড়ি ভরাট করতে গেলে যেমন যেখানে-সেখানে রং লাগাতে হয়, তেমনই যেখানে- সেখানে রামায়ণী কথা বললেই তাঁরা নেতা হয়ে যান। আর ধরা যাক এই যোগী আদিত্যনাথ—একজন যোগীপুরুষ, গেরুয়া পরিধান করেন এবং যাঁর উচিত ছিল যোগারূঢ় অবস্থায় ‘অপানে জুহ্বতি পানম্’—এই গীতোক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়া, তিনি হঠাৎ লেখাপড়া জানা লোকের মতো বলে উঠলেন—হনুমান ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের লোক।
এটাকে যোগ-বিভ্রাট বলে। পান-অপান-উদান বায়ু এমনভাবেই জট পাকিয়ে গেল যে, রামায়ণী চরিত্রের যেসব নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পণ্ডিতরা করেছেন, তাঁদের সমস্ত পাণ্ডিত্য অতিক্রম করে আদিত্যনাথ তাঁর যোগবিভূতি প্রকাশ করলেন— হনুমান হয়ে গেলেন দলিত। যোগী এত বড় একটা মৌলিক কথা বলেছেন, তো আর এক বিজেপি নেতা বুক্কাল নবাব সাহেব বললেন, হনুমান একজন মুসলিম। এতটাই তিনি জনপ্রিয় যে, মুসলিমদের অনেক ব্যক্তি নামের সঙ্গে হনুমান-নামের সমতা আছে। যেমন রহমান, রামজাম, ফরজাম, জিশান কিংবা কুরবান। নবাব-সাহেবের নামোপমায় আমাদের পাড়ার বটুক দাস অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে বলেছে— আমাদের এই দাস বংশও কম নয়। কারণ, এই বংশের পূর্বপুরুষরা হলেন কালিদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস এবং কাশীরামদাসও।
সম্প্রতি আবার ভূপালের জৈন সাধু মহারাজ নির্ভয় সাগরজি হনুমানকে জৈন বলে চিহ্নিত করেছেন। হনুমানের এই পরিচয়-সঙ্কটে এতই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে, অন্যতর এক কৌশলী বিজেপি নেতা শুকশারীর দ্বন্দ্ব মিটিয়ে বলেছেন— হনুমান সবারই। বেশ বুঝতে পারি, মহাসঙ্কটে পড়েই যে হনুমানকে বিজেপি আপন একান্ত সম্পত্তি মনে করে, তাঁকে এই নেতা দলিত, জৈন, কিংবা মুসলিমদের সম্পত্তি হতে দিতে চাননি। সবার নাম করে তিনি আসলে হনুমানকে আপন গৃহের রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত করেছেন। যেন হনুমান শুধুই বিজেপির।
এ কথা বলতে বাধা নেই যে, ধর্মীয় ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল হনুমানকেও আপন স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন। ব্যবহার করছেন রামচন্দ্রকেও। এবং তা করছেন অত্যন্ত বিকৃতভাবে। হনুমান এবং রামচন্দ্রের সর্বাঙ্গীণ পরিচয় তো পাব আদি কবির লেখা রামায়ণ মহাকাব্য থেকে। এমনকী সেটাকে যদি কাব্যগ্রন্থ না বলে ধর্মগ্রন্থও বলি, তাহলে তো আর কোনও উপায় থাকে না, সেটাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনা করার। বস্তুত এই বিশেষ রাজনৈতিক দলের হাতে রামায়ণ, রামচন্দ্র এবং হনুমান এতটাই বিকৃতভাবে ব্যবহৃত যে, সারাজীবন রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে গবেষণা করার পর আমাকে এটা বলতেই হবে যে, বিজেপির নেতারা রামায়ণকে যোগী-ভোগী-নবাবদের মতো মৃদু-মূর্খ-কোমল হাতে না রেখে, তাঁরা নিজেরাই যুক্তি করে একটা মহাকাব্য লিখুন, যার নাম হোক বিজেপির রামায়ণ, কিংবা নিজেরাই একটি রামচন্দ্র তৈরি করে নাম দিন বিজেপির রামচন্দ্র এবং অবশ্যই বিজেপির হনুমান।
আপনাদের প্রতি সশ্রদ্ধে নিবেদন করি, সেই ১৯৯৬-৯৭ সালে লিন্ডসে স্ট্রিটে আপনাদের হনুমান নাচানো দেখে, বলা উচিত রামায়ণের এই বিরাট চরিত্রের অপব্যবহার দেখে যে দুঃখ পেয়েছিলাম। আজও সেই দুঃখ পাচ্ছি, যখন আপনারা হনুমানকে একবার দলিত বলছেন, একবার মুসলমান বলছেন, অথবা একবার জৈন। এই ঘটনার একটাই শুধু সদর্থক দিক আছে এবং সেটা হল— হনুমানকে সকলেই আত্মীকৃত অথবা আত্মসাৎ করতে চাইছেন। আর আত্মীকরণের মনস্তত্ত্ব এটাই যে, সেই ব্যক্তি বা সেই বস্তুর মাহাত্ম্য পূর্ব-খ্যাপিত হলে তবেই সেটা ‘আমাদের’ বলে একটা দাবি ওঠে। যেমন, বাংলার রসগোল্লা। অত্যন্ত চমৎকার সুস্বাদু বলেই ওড়িশা সেটা নিজেদের শিল্প বলে আত্মসাৎ করতে চায়। যেমনটা জয়দেবের গীতগোবিন্দের ব্যাপারেও ওড়িশার দাবি একই। এখন আবার রসগোল্লা এবং গীতগোবিন্দের খ্যাতি সম্পূর্ণ অতিক্রম করে হনুমানকে জৈন-পারশিক, মুসলিম-চৈনিক, দলিত-ট্রাইবাল বলে আত্মীকরণের চেষ্টাটাই কিন্তু বিপ্রতীপভাবে হনুমানের সর্বমান্য একটা গ্রহণীয়তা তৈরি করে দিচ্ছে।
এটা অবশ্যই সেইরকম এক আত্মীকরণের প্রচেষ্টা, যেমনটা কোনও ভারতীয় ‘অ্যামেরিকান সিটিজেন’ হয়ে নোবেল পাওয়ার পর তাঁকে যেমন আত্মীকরণের চেষ্টা হয়।
কিন্তু হনুমান বরং অনেক সহজলভ্য ছিলেন। তিনি ভারতীয় মহাকাব্যের উজ্জ্বলতম এক চরিত্র। তাই হনুমানের যত মাহাত্ম্য, শৌর্য-বীর্য, ক্ষমতা, তার আকর তো সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ। একজন ভারতীয় হিসেবে ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণকে আত্মীকরণ করার অধিকার সবার আছে, কিন্তু সেই রামায়ণের একটি সর্বগত চরিত্রকে ধরে, তাঁকে ‘উনি আমাগো জাতের লোগ’, কিংবা ‘আমাগো দ্যাশের, এক্কারে নোয়াখালির মানুষ’ এমন আত্মীকরণ কি মানায়?
রামায়ণ-মূলে হনুমানের যে জন্ম-পরিচয় আছে, তাতে তিনি বৈদিক বায়ু-দেবতার পুত্র, অঞ্জনা তাঁর মা। মহাভারতের একটি কাহিনীতে হনুমানকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেছিলেন—আমি বানরেন্দ্র কেশরীর পুত্র বটে, কিন্তু জগৎপ্রাণ বায়ুর ঔরসে আমার জন্ম হয়েছে—অহং কেশরিণঃ ক্ষেত্রে বায়ুনা জগদায়ুনা। তার মানে কেশরী নামে এক বানর-নেতার স্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে হনুমানের জন্ম এবং দেবতার পুত্র বলেই জন্মাবধি তাঁর খেলাধুলো থেকে ক্রিয়াকর্ম—সর্বত্রই দেবতার দৈব আবেশ কিছু আছেই। লৌকিক দৃষ্টিতে এটা বলা যায়— রামায়ণের কালে অবশ্যই দক্ষিণ ভারতের আর্যায়ণী প্রক্রিয়া চলেছে, যে কারণে বিন্ধ্যপারের অনেক তথাকথিত বানর-নেতাই আর্যভূমির বৈদিক দেবতাদের ঔরস পুত্র। হনুমান নিজের মিশ্র জন্ম আখ্যাপন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রিয় এবং সম্মানিত দুই রাজার নাম করে বালী এবং সুগ্রীবের পরিচয় দিয়ে তাঁদেরও দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র এবং সূর্যের পুত্র বলেছেন যথাক্রমে—সূর্যপুত্রঞ্চ সুগ্রীবং শক্রপুত্রঞ্চ বালিনম্।
এই জন্ম-পরিচয়ে এটা খুব পরিষ্কার যে, হনুমানের জাত নিয়ে কোনও বজ্জাতি করা যাবে না। তিনি ব্রাহ্মণ, শূদ্র, দলিত, জৈন— এই সমস্ত জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে, দৈব-মানুষের মিশ্র জাতক তিনি এবং তাও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জাতক। রামায়ণের বর্ণনায় বানরেন্দ্র কেশরীর স্ত্রী অঞ্জনার রূপ-লাবণ্যে মোহিত হয়ে কামমোহিত বায়ুদেব দীর্ঘ-প্রসারিত বাহুতে আলিঙ্গন করলেন অঞ্জনাকে, তখন অঞ্জনা সানুনয়ে বায়ু-পুরুষকে বলেছিলেন— স্বামীর প্রতি একান্ত অনুগতা একনিষ্ঠা এক স্ত্রীর এ কী সর্বনাশ করলেন আপনি? বায়ুদেব আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন—আমি তোমার পাতিব্রত্য নষ্ট করিনি। আমি তোমাকে আলিঙ্গন করেছি বটে, কিন্তু তোমাতে উপগত হয়েছি মনে-মনে—মনসাস্মি গতো যস্ত্বাং পরিত্বজ্য যশস্বিনী। এই মানসিক গমনের ফলেই তোমার গর্ভে এক পরম বুদ্ধিমান এবং বীর্যবান পুত্র জন্মাবে, যার গতি-প্রকৃতি হবে আমারই মতো।
বায়ু-দেবতার এই মনোময় জাতক হনুমান, সোনার পাহাড়ের মতো দীপ্ত তাঁর গায়ের রং, বেদ জানেন, ব্যাকরণ জানেন— এমন মানুষের জন্ম পত্রিকা বানরের ঘরে তৈরি হল কেন, সেটা তো রামায়ণী সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিসর; সেটা কী মস্তিষ্কমেদী সেইসব ভোট-বালাই রাজনীতিকরা বুঝতে পারবেন যাঁরা রামের প্রচারের জন্য হনুমান সাজিয়ে মানুষ নাচান; নাকি বুঝতে পারবেন সেই সাধুবেশী যোগী নামে উপলক্ষিত এক ভোগী, যিনি মঠ-মন্দিরের অভীষ্ট ত্যাগ-বৈরাগ্যে জলাঞ্জলি দিয়ে মন্ত্রিত্ব উপভোগ করছেন। হনুমানের মধ্যে দলিতের গুণ-কর্ম-ভাব তাঁর কোন অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে এবং তাঁর কোন কর্মের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে—এটা যদি তাঁর যোগ-সমাধিতে চকিতে স্ফুরিত হয়, তাহলে সেটাই হবে আমাদের চরম আধ্যাত্মিক লাভ।
বাল্মীকির রামায়ণে হনুমানের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, তাতে বোঝা যায় প্রথম বাল্যজীবনে তাঁর খানিক চপলতা এবং দুষ্টুমি থাকলেও একটা সময় আসে, তিনি ভীষণভাবে বিদ্যাভ্যাসে মন দেন। সংস্কৃতে যে ব্যাকরণশাস্ত্র সমস্ত বিদ্যার আধার, সেই ব্যাকরণ পড়ার জন্য তিনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। ব্যকরণের সূত্র-বৃত্তি-পদ-ভাষ্য পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছন্দোশাস্ত্র এবং রাজনীতি-শাস্ত্র এতটাই তিনি পড়েছিলেন যে, আদি কবিকে লিখতে হয়েছে যে, হনুমানের মতো বিদ্বান তাঁর কালে কেউ ছিলেন না এবং রাজনীতিতে যেটাকে policy and impolicy (নয় এবং অনয়) বলে, সেখানে তিনি সুরগুরু বৃহস্পতিকেও ‘চ্যালেঞ্জ’ করতে পারতেন—হনূমতঃ কো’প্যধিকো’স্তি লোকে/ প্রস্পর্ধতে’য়ং হি গুরুং সুরাণাম্। আমাদের বিদ্যাবুদ্ধিতে এটাও একটা ‘পয়েন্ট’ যে, অন্য শাস্ত্রের চেয়ে ব্যাকরণ বেশি পড়ার মধ্যে একটা মানুষের যুক্তি-তর্কের সূক্ষ্মতা বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। রসশাস্ত্রকার আনন্দবর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোকে বলেছিলেন—ব্যাকরণ যিনি জানেন তাঁকেই সবার চাইতে বড় বিদ্বান বলতে হয়, কেন না সমস্ত শাস্ত্রীয় বিদ্যার মূলে আছে ব্যাকরণ—ব্যাকরণ মূলধাৎ সর্ববিদ্যানাম্।
হনুমানের জাত কিন্তু এইখানে—তিনি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি চাতুর্বর্ণ্যের সংস্কারে বাঁধা নন। এমনও যদি মনে করি যে, বানর-সভ্যতার আস্থান কিষ্কিন্ধ্যা নগরী কোনও আর্যেতর নিবাস। তাহলেও বলব আর্য এবং আর্যায়নের প্রতিভূ রামচন্দ্রের সহায়ক শক্তি কিন্তু হনুমান, সুগ্রীব, বালী, এইসব বানর-মুখ্যেরা। সেক্ষেত্রে সর্ববিদ্যার আকর আর্য সংস্কৃতির ভাষা, ব্যাকরণ, ধর্ম, দর্শন এবং শাস্ত্র যিনি অধিগত করেছেন, সেই হনুমান কিন্তু রামায়ণের ব্রাহ্মণ্য তথা আর্যসংস্কৃতির মৌলধারাকে সবচেয়ে বেশি ‘অ্যাডপ্ট্’ করেছেন। ইংরেজ আমলে অনেক বাঙালিই সাহেবদের থেকেও ভালো ইংরেজি লিখতেন, সাহেবিয়ানাতেও অনেকে হার মানাতেন সাহেবদের। কিন্তু কেন এবং কী জন্য বাঙালিরা ইংরেজি এবং ইংরেজিয়ানার ব্যাপারে এত সতর্ক হতেন, তার পিছনে যে মনস্তত্ত্ব আছে, সেই মনস্তত্ত্বেই তথাকথিত অনার্য জন-জাতীয় হিসেবে হনুমান এখানে সম্পূর্ণ আর্যায়িত এক চরিত্র।
রামায়ণে হনুমানের কথা থেকেই এটা বোঝা যায় যে, বানরত্বের ব্যাপারটা তাঁর স্বজাতির কোনও অন্তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য নয়। অস্থির চিত্ততা, ধৈর্য হারিয়ে ফেলা, ভেঙে পড়া, বস্তুবিচার না করে অক্ষম সিদ্ধান্ত নেওয়া—এইগুলির মধ্যেই বানরের স্বজাতীয়ত্ব প্রকট হয়ে ওঠে বলে হনুমান মনে করেন। রামচন্দ্রকে ঋষ্যমূক পর্বতে বিচরণ করতে দেখে সুগ্রীব তাঁকে বালীর নিযুক্ত ‘এজেন্ট’ ভেবে যেভাবে ভয় পাচ্ছিলেন, সেটা দেখেই হনুমান বলেছিলেন—আপনি অত্যন্ত চঞ্চলচিত্ত বলেই কোনও বিচার-বিবেচনা না করে নিজের বানরামি প্রকট করে তুলছেন—অহো শাখামৃগত্বংতে ব্যক্তমেব প্লবঙ্গম। আপনি বুদ্ধি এবং বিজ্ঞান-সম্পন্ন উপায়ে ইঙ্গিত বুঝে কাজ করার চেষ্টা করুন। একজন রাজা কি বুদ্ধিহীন হয়ে প্রজাশাসন করতে পারে—বুদ্ধি-বিজ্ঞানসম্পন্নঃ ইঙ্গিতৈঃ সর্বমাচর। তার মানে হনুমান কিন্তু বানর বলতে বিচারবুদ্ধিহীন চঞ্চলতা বোঝেন এবং তিনি এই লাঙ্গুল-বিক্ষেপণের মতো চঞ্চলতার, বলা উচিত, বানরতার বিপ্রতীপ স্থানে অবস্থান করছেন। রামচন্দ্রের সঙ্গে যখন হনুমানের প্রথম দেখা হয় এবং হনুমান যে অসামান্য বাগ্মিতায় রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে কথা বলেছেন, রামচন্দ্র তার প্রশংসা করে বলেছেন—ঋক্, সাম এবং যজুর্বেদের শিক্ষায় যাঁর ভাবনালোক পরিশীলিত হয়নি, তাঁর পক্ষে এমন চতুর-মধুরভাবে কথা বলাই সম্ভব নয়—নাসামবেদবিদুষঃ শক্যমেবং প্রভাষিতুম্। রামায়ণে হনুমানের কথা শুনেই বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর সময়কালের তো বটেই, এমনকী এখনকার কালেরও অনেক জৈন-চৈন-যোগী-নবাবদের জাতি-বোধের উপরে আছেন। অথচ আজ এই গণতন্ত্রে গত শতাব্দীর শেষে হনুমদ্ভক্তিবশত মানুষ দিয়ে বানর-নাচানো হল, আর একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিক-বিশেষজ্ঞরা হনুমানের জাতি-বর্ণ বিচার করে যে পদবিতে পৌঁছেছেন, হনুমান নিজেই সেটা সুগ্রীবকে বলেছেন—আপনি অত্যন্ত চঞ্চলচিত্ত বলেই কোনও বিচার-বিবেচনা না করে নিজের শাখামৃগত্ব প্রকট করে তুলছেন—অহো শাখামৃগত্বং তে ব্যক্তমেব প্লবঙ্গম। যোগী আদিত্যনাথকে দেখলেও ওই একই কথা বলতেন হনুমান।
রামায়ণে একটা অসামান্য মন্তব্যে বলা হয়েছে—শক্তি, ধৈর্য এবং প্রাজ্ঞতার মতো গুণ হনুমানের মধ্যে বাসা বেঁধে ফেলেছে একেবারে—হনুমতি কৃতালয়াঃ। আর তাঁর সব চাইতে বড় ক্ষমতা হল ‘নয়সাধন’ অর্থাৎ রাজনৈতিক সমাধান এবং ‘পলিসি মেকিং’। রামচন্দ্র হনুমান সম্বন্ধে বলেছিলেন—মানুষটা এতক্ষণ ধরে কথা বলল এবং এক রকমের কথা নয়, অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলল, কিন্তু একটা কোথাও কোনও অপশব্দ ব্যবহার করল না। কতটা লেখাপড়া থাকলে এটা সম্ভব হয়! আর কথা যা বলেছেন হনুমান, তা সবই রাজনীতির কথা এবং সেগুলি এতই সুষ্ঠু এবং কালোচিত যে, লঙ্কাকাণ্ডের শেষে সীতা যখন রামচন্দ্রের দেওয়া মুক্তোর মালাগাছি নিজের গলা থেকে হনুমানের গলায় পরিয়ে দিলেন, তখন রামায়ণের কবির বচন হল—যাঁর মধ্যে তেজ, ধৈর্য, যশ, নিপুণতা, সামর্থ্য, বিনয়, রাজনৈতিক চেতনা, পৌরুষ এবং বুদ্ধি—সব গুণই আছে, সেই হনুমানের গলাতেই নিজের গলার হারখানি পরিয়ে দিলেন সীতা—তেজো ধৃতির্বলং দাক্ষ্য সামর্থ্যং বিনয়ো নয়ঃ।
এই রকম গুণের অধিকারী এক বিরাট দৈব মানুষকে আজকের রাজনীতিকরা কখনও রাস্তায় সং সাজিয়ে নাচাচ্ছেন, আর কখনও বা তাঁকে জৈন, দলিত, আদিবাসী ইত্যাদি বিশেষণে আপন গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। এই রাজনৈতিক দলটির স্বভাবই এমন—বড় বড় বিষয়কে আপন স্বভাব এবং বুদ্ধির ছোট্ট ছোট্ট বোতলে পুরে ফেলেন এঁরা।
অঙ্কন ও গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়