বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রকাশিত গান্ধীজির এই প্রবন্ধের সবথেকে তীব্র সমালোচনা করে চিঠি এল একমাত্র কলকাতা থেকে। এবং মাত্র একজন দু’জন নয়। একঝাঁক শিক্ষিতা বাঙালি মহিলা ও ছাত্রী সম্মিলিতভাবে চিঠি লিখে গান্ধীজির অভিমতের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। তাঁরা চিঠি লিখে জানালেন, শ্রদ্ধেয় গান্ধীজি, আপনার মন্তব্যগুলি খুব একটা অনুপ্রেরণার যোগ্য নয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের গ্রাসে সবথেকে আঘাতপ্রাপ্ত যারা, সেই মেয়েদেরই আপনি এই সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করে বরং আরও বেশি আঘাত দিলেন। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, তাঁরা যেমন ভাবে মেয়েদের দেখতে চান, ঠিক তেমনভাবে হয়তো আধুনিক মেয়েদের অনেকেই পোশাক পরে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এই মেয়েরা নিজেদের অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবেই তুলে ধরে। এরকম ধারণা নারীদের প্রতি চরম অপমান। চারিত্রিক দৃঢ়তা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য এমন নয়। হয়তো কিছু মেয়ে আছে যারা এক ডজন রোমিওর জুলিয়েট হতে চায়। কিন্তু এই মনোভাব থেকে আর একটা বার্তাও স্পষ্ট হয় যে জুলিয়েটের খোঁজে রাস্তায় রাস্তায় হাফ ডজন রোমিওরাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং এমন সংশোধন দরকার সেদিকটা একটু চিহ্নিত করুন। কলকাতার মেয়েরা এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা আরও লিখলেন, গান্ধীজি কিছু মনে করবেন না, বালগঙ্গাধর তিলক, গোপালকৃষ্ণ গোখলে কিংবা দেশবন্ধু এই বিষয়ে কিন্তু এতটা অসম্মানজনক স্টেটমেন্ট দিতেন না! গান্ধীজি এই চিঠি পেয়ে প্রবল ধাক্কা খেলেন। এতটা কড়াভাবে যে তাঁর কোনও অভিমতের সমালোচনা হতে পারে, তার জন্য তিনি তৈরি ছিলেন না। তাঁর একটি ধারণা সম্পূর্ণ সত্য হিসেবে প্রতিভাত হল। যেটা তিনি আগেও জানতেন। এবার আরও একবার নতুন করে প্রমাণিত হল। সেটা হল একমাত্র এই একটি জাতি প্রতিবাদী, প্রখর আত্মসম্মান সম্পন্ন আর স্বাধীনচেতা। বাঙালি। গান্ধীজির সামনে ওই ধারণার অন্যতম উদাহরণ হিসাবে উপস্থিত ছিলেন দু’টি বিশেষ চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন দেশবন্ধুর ভাবশিষ্য। আর অন্যদিকে গান্ধীজির ভাবশিষ্য ছিলেন দু’জন। জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেল। সুভাষচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু নেহরু আর প্যাটেলের সঙ্গে সেই শ্রদ্ধার প্রধান পার্থক্যই হল, তিনি সমানভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে গান্ধীজিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জও করতেন। মতান্তর হলে স্পষ্টভাবে জানাতেন। এবং তিনি যখন বুঝতেন তাঁর কোনও একটি সিদ্ধান্ত সত্য ও যুক্তির মেলবন্ধনে প্রতিষ্ঠিত, তাহলে সেই অবস্থান থেকে কোনওভাবেই সরতেন না। গান্ধীজির কাছে এই মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী। কারণ, বাকি তাবৎ কংগ্রেস নেতাই ছিলেন তাঁর সর্বার্থে অনুগামী। ১৯২৪ সালে মাত্র একবারই গান্ধীজি কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু আদতে তিনি বরাবর ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সুপার প্রেসিডেন্ট। সভাপতির নাম জওহরলাল নেহরুই হোক অথবা মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। সকলেই পার্টির যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছে। তাঁর মতামতের জন্য অপেক্ষা করেছে। এবং তাঁর সিদ্ধান্তই অবশেষে পার্টিকে গ্রহণ করতে হয়েছে। ঠিক এখানেই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী চরিত্রের নাম ছিল সুভাষচন্দ্র বসু। শুধু কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নয়, বাংলার প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবেও সুভাষচন্দ্র ছিলেন স্বাধীনতাপ্রিয়। তিনি দেশ ও বাংলার স্বার্থ সামান্যতম ক্ষুণ্ণ হবে এরকম কোনও ইস্যুতেই আপস করেননি।
আত্মসম্মান
গানটি প্রথম জনপ্রিয় হয় ১৯০৫ সালে। স্বদেশি আন্দোলনের মন্ত্র হিসেবে। অরবিন্দ ঘোষ নিজের রাজনৈতিক পত্রিকার নাম দিয়েছিলেন এই গানটির নামে। ‘বন্দেমাতরম’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সুরটি দিলেন সেটি প্রথমবার গাওয়া হল ১৯০৫ সালের বেনারস কংগ্রেস অধিবেশনে। গাইলেন সরলাদেবী চৌধুরাণী। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি। ঠিক সেই বছরই তামিল কবি সুব্রহ্মনিয়াম ভারতী গানটিকে তামিলে অনুবাদ করলেন। সুরও দিলেন অন্যরকমভাবে। ঠিক এভাবেই পৃথকভাবে অনুদিত হল তেলুগু, কন্নড়, গুজরাতি আর হিন্দিতে। সমস্যা হল ১৯৩৭ সালে রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর। কোনও কোনও সময় বন্দেমাতরম গাওয়া শুরু হল সরকারি অনুষ্ঠানে। মুসলিম লিগ আপত্তি তুলল। এক বিধানসভার মুসলিম লিগ সদস্য সরাসরি বললেন এই গানটি অ্যান্টি মুসলিম। কিছুদিন পর মহম্মদ আলি জিন্না নিজেই ঘোষণা করলেন, বন্দেমাতরম মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা থেকে রচিত হয়েছে। দেশজুড়ে বিতর্ক তুঙ্গে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের উপর প্রবল চাপ যে তাহলে কি গানটি গাওয়া হবে না? নিষিদ্ধ করা হবে? মুসলিমদের দাবি ও আবেগ নিয়ে জিন্না বিপজ্জনকভাবে এগচ্ছেন তখন। তাই দ্বিধায় পড়লেন সকলে। প্যাটেল আর নেহরুকে ডেকে বৈঠক করলেন গান্ধীজি। কিন্তু সমাধানসূত্র সামনে আসছে না। কারণ, স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। ঠিক তখন একটি চিঠি এল গান্ধীজির কাছে। সুভাষচন্দ্র বসু লিখছেন, আমাদের রাজ্য (বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়) বন্দেমারতম নিয়ে এই বিতর্কে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যদি কংগ্রেসের অধিবেশন কিংবা সম্মেলনে কোনওভাবেই বন্দেমাতরম বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এ রাজ্যের সমস্ত হিন্দুই মনেপ্রাণে প্রস্তুত সামগ্রিক প্রতিবাদে শামিল হতে। যে কোনও মূল্যে বাধা দেওয়া হবে। আমাদের কিন্তু বন্দেমাতরমকে নিষিদ্ধ করার সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণের আগে অন্তত একশোবার চিন্তা করতে হবে। সুভাষচন্দ্র একাই নন। সমাজসেবী সতীশ দাশগুপ্ত গান্ধীজিকে বললেন, সুভাষচন্দ্র ঠিক বলেছেন। এর সঙ্গে কোনও হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের সম্পর্ক নেই। জন্মভূমির প্রতিটি সন্তানই তাঁর মাতৃভূমিকে বন্দনা করছে এই গানে। একদিকে সুভাষচন্দ্র সহ বাঙালির প্রবল আপত্তি এবং অন্যদিকে জিন্নার চাপের মধ্যে গান্ধীজি মাঝামাঝি অবস্থান নিলেন। তিনি গানের প্রথম দুটি পংক্তিই কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়া হবে বলে জানালেন। জিন্না সেটাও মানবেন না। কিন্তু গান্ধীজির নির্দেশে নেহরু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, বন্দেমাতরম নিষিদ্ধ করার প্রশ্নই নেই। ওই দুই পংক্তি গাওয়া হবে অবশ্যই। সুভাষচন্দ্রের চাপেই বস্তুত বন্দেমাতরমকে কংগ্রেস তথা প্রদেশ সরকারগুলি সরকারিভাবেই স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয় জাতীয় গান হিসেবে। ঠিক এখানেই সুভাষচন্দ্র বসু আমাদের মতো আমজনতার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। কারণ কী? কারণ হল, এই উপকাহিনীটি পড়ে আমাদের মনে মনে ধারণা হবে, ও আচ্ছা, তাহলে তো সুভাষচন্দ্র কট্টর হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। আদৌ নয়। কট্টর হিন্দু হিন্দুত্ববাদীদের তিনি বরং মৌলবাদী মনে করতেন। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থে তিনি হিন্দু মহাসভাকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, এরা মুসলিম মৌলবাদেরই প্রতিবিম্ব, যারা ব্রিটিশ রাজের হাতের পুতুল হয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। এখানেই তিনি সকলের থেকে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ যিনি কোনও একমাত্র নিজের বিবেক, বুদ্ধি আর সত্যের পথে অবিচল থাকবেন। কোনও দল, কোনও সংগঠন, কোনও বিশেষ পন্থার প্রতি তাঁর দাস মনোভাব ছিল না।
একক যুদ্ধ ১
প্রথমবার বল্লভভাই প্যাটেল কিছুতেই মেনে নেবেন না। গান্ধীজি তাঁকে শান্ত করেন। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি পদে। বল্লভভাই প্যাটেলের সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ধারণা খুব ভালো ছিল না। এই মনান্তরের প্রকট সূত্রপাত ১৯৩৩ সালে। বল্লভভাইয়ের প্যাটেলের দাদা বিঠ্ঠলভাই প্যাটেলর প্রবল অসুস্থতার সময় তাঁর পাশে সর্বক্ষণ পেয়েছিলেন একজনকেই। সুভাষচন্দ্র। সুভাষচন্দ্র অসুস্থ বিঠ্ঠলভাইকে এতটাই সেবা শুশ্রুষা করেন ওই অসুস্থতার সময় যে, মৃত্যুর আগে বিঠ্ঠলভাই তাঁর সম্পত্তির তিন চতুর্থাংশ সুভাষচন্দ্রের নামে উইল করে যান। সেই উইলে লেখা ছিল, ভারতের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিদেশে প্রচারের কাজে যেন ওই সম্পত্তি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বিঠ্ঠলভাই প্যাটেলের ছোটভাই বল্লভভাই প্যাটেল সেটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, ওই উইল যে সত্যি সেটা সুভাষচন্দ্র প্রমাণ করুন। শুধু চ্যালেঞ্জই নয়, মামলাও করেছিলেন প্যাটেল। দীর্ঘদিন ধরে সেই মামলা চলল। এবং মামলায় সুভাষচন্দ্র পরাজিত হন। আদালত রায় দেয় ওই একই কাজে সম্পত্তির ব্যবহার করতে পারেন বিঠ্ঠলভাইয়ের পরিবার। সুতরাং সেই শুরু।
১৯৩৮ সালে স্বয়ং গান্ধীজি সুভাষচন্দ্রকে সভাপতি পদে মনোনীত করলেন তখন প্যাটেল সর্বাগ্রে আপত্তি তোলেন। কিন্তু গান্ধীজি সেই আপত্তিতে কর্ণপাত করেননি। সেই গান্ধীজিই ১৯৩৯ সালে কিন্তু সুভাষচন্দ্রকে দ্বিতীয়বার দেখতে চাইলেন না সভাপতি পদে। কারণ কিছুটা অনুমেয়। সুভাষচন্দ্র ছিলেন কংগ্রেসের অন্দরে প্রতিটি রাজ্যেই প্রবল জনপ্রিয়। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে দু’জনই ছিলেন সবথেকে জনপ্রিয়। নেহরু আর সুভাষচন্দ্র। কিন্তু সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র অনেক বেশি স্বাধীন মনোভাব নিয়ে কাজ করতেন। প্রতিটি ছোটখাটো সিদ্ধান্তই গান্ধীজির অনুমোদন নিতে হবে কিংবা নিয়ম করে গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে হবে এরকম অবস্থান তিনি নেননি। যদিও গান্ধীজিকে অন্ধকারে রেখে তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমনও নয়। অথচ যে কোনও কারণেই হোক গান্ধীজি চাইলেন না আবার সুভাষ সভাপতি হন। তাই সর্বাগ্রে তিনি আবুল কালাম আজাদকে প্রস্তাব দিলেন। তিনি রাজি নন। এরপর প্রস্তাব দেওয়া হল নেহরুকে। তিনিও প্রত্যাখ্যান করলেন। অবশেষে কাউকে সামনে না পেয়ে গান্ধীজি অন্ধ্রপ্রদেশের পট্টভি সীতারামাইয়াকে বললেন প্রার্থী হতে। আর সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার সভাপতি হতে চাওয়ার ওই প্রয়াসে এতটাই বিরক্ত হলেন যে তিনি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে চিঠিতে লিখলেন, আমাদের পক্ষে সুভাষের সঙ্গে কাজ করা অসম্ভব।
১৯৩৮ সালেও অনেকে বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু গান্ধীজির কথার উপর কে কথা বলবেন? এবার সেই গান্ধীজিও বিরুদ্ধে। সুতরাং সম্ভব কি সুভাষচন্দ্রের পক্ষে জয়? গোটা ভারতকে বিস্মিত করে সুভাষচন্দ্র আবার জয়ী হলেন। স্বয়ং গান্ধীজির প্রার্থীকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র জিতলেন অনেক বেশি ভোটে। আর তারপর থেকেই তাঁকে পদচ্যুত করার চেষ্টা শুরু হল প্রবলভাবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিংহভাগই সুভাষবিরোধী ছিলেন। কমিটির সদস্যরা পদত্যাগ করলেন। এমন এক সময় যখন গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক পরিস্থিতি এক মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একটামাত্র লোক সমস্ত বিশ্বের ইতিহাস আর ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছেন। অ্যাডলফ হিটলার। এটাই সুর্বণ সুযোগ। কারণ, ব্রিটিশ সূর্যে গ্রহণ লাগতে শুরু করেছে। অথনৈতিক মন্দা। আর তার সঙ্গে জার্মানির অসীম হুঙ্কার। সুভাষচন্দ্র আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তিনি চাইছেন এখনই আঘাত করতে ব্রিটিশরাজকে। দুর্বল মুহূর্তে। গান্ধীজিকে তিনি লিখলেন, এখনই সময় এসেছে পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলার। এখনই ব্রিটিশ সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া উচিত। যদি আমাদের দাবি মানা না হয়, তাহলে সমস্ত মন্ত্রিসভার থেকে কংগ্রেস বেরিয়ে আসুক আর দেশজুড়ে আন্দোলনে নামা হোক।
উত্তেজিত এবং প্রবলভাবে কিছু একটা করতে উদ্যত সুভাষচন্দ্র বললেন, আমার স্থির বিশ্বাস, এখনই সর্বাত্মক আন্দোলনে নামা হলে ব্রিটিশ শক্তি সেটা সামলাতে পারবে না। ১৮ মাসে মধ্যে আমরা স্বরাজ অধিকার করব। কিন্তু গান্ধীজির উত্তর ছিল অত্যন্ত শীতল। তিনি পাল্টা চিঠিতে লিখলেন, তুমি তোমার পছন্দমতো ওয়ার্কিং কমিটি নির্বাচিত করো। আর তারপর এই প্রস্তাব এআইসিসির সামনে পেশ করো। যদি সেটা গ্রহণ করা হয় তাহলে সংখ্যালঘু মত সত্ত্বেও সেটা প্রয়োগ করে নতুন সভাপতি শপথ নিক। আর হ্যাঁ, আমার মনে হয় না এখন এমন কোনও পরিস্থিতি এসেছে যে কোনও গণ আন্দোলন হতে পারে। বরং আমার তো মনে হচ্ছে এই প্রস্তাবে সহিংসতার গন্ধ আছে। আর এটাই সবথেকে বড় ফারাক দু’জনের। স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্র কখনওই মনেপ্রাণে অহিংসার পুজারি ছিলেন না। তিনি ছিলেন ইটের বদলে পাটকেলের পক্ষে। ১৯৩৫ সালে তাঁর লেখা বই ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইতে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের শুধুমাত্র নিয়তিবাদী হওয়া কোনও কাজের কথা নয়। সোজাসুজি তিনি লিখেছিলেন, মহাত্মা গান্ধী দেশের জন্য যা করেছেন তা অকল্পনীয়। তিনি সেই দেশসেবা আগামীদিনেও করে যাবেন অতুলনীয়ভাবে। কিন্তু ভারতের যুদ্ধ তাঁর নেতৃত্বে আসা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র বলতে চাইলেন, অহিংসার দ্বারা। সুভাষচন্দ্রকে ইস্তফা দিতেই হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনের সেই সুভাষচন্দ্র হঠাও কর্মসূচির জেরে গোটা বাংলা এতটাই আহত হয়েছিল যে, তার প্রমাণ মাত্র দু’টি চিঠি গিয়েছিল গান্ধীজির কাছে। প্রথম চিঠিতে বাংলার ৭৫ জন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বাক্ষর ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল অনেক কথা। কিন্তু আসল কথা ছিল একটি লাইনে। ‘মিস্টার গান্ধী, যেভাবে আপনি আর আপনার অনুগামীরা আমাদের বিবেকে জখম দিলেন, তারপর আর আপনাকে ‘মহাত্মা’ সম্বোধন করতে সেই বিবেকই সায় দিল না। তাই মিস্টার গান্ধী’। আর দ্বিতীয় চিঠিতে বলা হয়েছিল, বিগত কংগ্রেস অধিবেশনে কিছু রুক্ষ আচরণের মাধ্যমে বাংলাকে অসম্মানজনকভাবে আঘাত করা হয়েছে। আমার আপনার প্রতি অনুরোধ অনতিবিলম্বে বাংলার সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। এই চিঠি কে লিখেছেন? গান্ধীজি যাঁকে সবথেকে বেশি শ্রদ্ধা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! সুতরাং এই চিঠি গান্ধীজিকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিল। তিনি আবার বুঝলেন বাংলার অনুভূতি কতটা সংবেদনশীল আর মনোবল কতটা শক্তিশালী।
একক যুদ্ধ ২
বাঙালি সবথেকে বেশি পছন্দ করে গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে। অ্যাডভেঞ্চার আজীবন এক রহস্যময় আকর্ষণ হয়ে ডাক দিয়েছে বাঙালি মননকে। সেই অ্যাডভেঞ্চারের নায়করা কিংবা গোয়েন্দাদের লার্জার দ্যান লাইফ ভাবমূর্তি, কার্যকলাপে নির্জন দুপুরে আমরা শিহরিত হয়ে চলেছি বছরের পর বছর। বাঙালি উত্তমকুমারের ভক্ত। কারণ ধুতি-পাঞ্জাবিতে তিনি ঠিক পাশের বাড়ির চেনা সুদর্শন যুবকটি। অথচ, পর্দায় তাঁর উপস্থিতির মধ্যে এক মোহিনী রহস্য থাকে। বাঙালির মতো সৌভাগ্যশালী জাতি আর নেই। কারণ একটি আদর্শ পরিবার, একটি কিশোর, একজন যুবক বাঙালির মন ঠিক যতদূর পর্যন্ত কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে, তার প্রতিটি বিন্দু সফলভাবে স্পর্শ করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু। আইসিএস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে তিনি হেলায় সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁকে যতটা ধুতি পাঞ্জাবিতে নিপাট সৌম্য এক বাঙালি সুদর্শন যুবক, ঠিক ততটাই আন্তর্জাতিক মানের দুরন্ত স্মার্টনেস আইএনএ ইউনিফর্মে। একজন যুবক প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সামান্য আপস করেন না। কোনও দুঃসাহসিক কাহিনীর রচয়িতা বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক যে প্লট লিখতে পারেননি কোনওদিন, ঠিক সেই চরম রহস্যময় আর অসমসাহসী অভিযানে এককভাবে বেরিয়ে গিয়েছেন। ভবানীপুরের একটি গলিতে একটি উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের আর্থসামাজিক নিরাপত্তায় বসে থাকা এক যুবক মনে মনে প্ল্যান করতে পারেন ব্রিটিশ পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে মধ্যরাতে একটি গাড়িতে চেপে গোমো স্টেশন হয়ে আফগানিস্তান থেকে জার্মানি চলে যাওয়া যায়। যে সময় গোটা পৃথিবীকে শাসন করার স্বপ্ন দেখছেন যে একনায়ক, সেই হিটলারের সঙ্গে কলকাতার একটি যুবক দেখা করে ভারতকে ব্রিটিশমুক্ত করার স্বপ্ন দেখতে পারেন, এটাও প্রমাণ করা যায়। হিটলারের থেকে সেরকম আশ্বাস না পেয়ে সেই যুবক কোনওভাবেই দমে না গিয়ে জাপানে যাবেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের কাছে আত্মসমর্পণ করা ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি পূর্ণ সেনাবাহিনী নির্মাণ করার মতো রূপকথা রচনা করবেন। দেশের যে নেতারা তাঁর প্রস্তাব ও কর্মপদ্ধতিকে নস্যাৎ করেছে সেই নেহরু, গান্ধীজির বিরুদ্ধে সামান্যতম ক্রোধ, ক্ষোভ, ঘৃণা পুষে রাখা নয়। বরং উল্টে তাঁদের নামেই নিজের সেনাবাহিনীর তিনটি ব্রিগেডের নামকরণ করার মতো অত্যাশ্চর্য উদারতা দেখানো। সাবমেরিনে চেপে সমুদ্রপার। এবং সত্যিই ব্রিটিশকে আতঙ্কিত করে আক্রমণ করা। এই বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অন্যতম সাহসী অভিযানগুলির নায়ক মাত্র একজন। এবং তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনা। যা আজও এক চিররহস্যে আচ্ছাদিত।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালি ছিলেন না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় ছিলেন না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কোনও মানবচরিত্র ছিলেন না। তিনি আসলে একটি একক অস্তিত্ব! এক ক্ষণজন্মা রোলমডেল। যাঁকে আমরা আজকের বাঙালি আইকন হিসেবে পুজো করি। সেই পুজোটির প্রাপক একটি মূর্তি। দেবতার নাম নেতাজি-প্রতিমা। প্রতিমা কেন? কারণ, দেবতাকে বন্দনা করার সুবিধা হল দেবতা হয়ে ওঠার কোনও আকুলতা থাকে না। অনেক উঁচু আসনে বসিয়ে বড় ফুলের মালা পরাই। নমো করি। কিন্তু দেবতাকে অনুসরণ করতে নেই। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নেতাজিকে দেবত্বের আসনে বসিয়েছি। যাতে তাঁকে অনুসরণ করতে না হয়। তাঁর প্রদর্শিত পথে চলার কোনও মানসিক চাপ না থাকে। আমাদের পক্ষে আর সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, খুব স্বাভাবিক। ১৯৪৩ সালের ২ অক্টোবর ব্যাঙ্কক থেকে একটি রেডিও ভাষণে নেতাজি দু’টি শব্দের উপর জোর দিয়েছিলেন। সে দু’টি হল সেল্ফ রেসপেক্ট আর সেল্ফ কনফিডেন্স। আত্মসম্মান। আর আত্মবিশ্বাস। নেতাজি এক অনন্ত কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অন্তর্ধানের ৭৪ বছরে মধ্যে বাঙালি হারিয়েছে ওই দু’টি শব্দ। আত্মসম্মান। আত্মবিশ্বাস!
ছবি ধ্রুব হালদার
গ্রাফিক্স সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় স্বাগত মুখোপাধ্যায়