বিদ্যার জন্য স্থান পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণামূলক কাজে সাফল্য আসবে। কর্মপ্রার্থীরা কোনও শুভ সংবাদ পেতে ... বিশদ
‘জোর বলতে শুধু গায়ের জোর বোঝায় না। মনের জোরেই সব হয়। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে শরীরের দুর্বলতা ঢাকা দেওয়া যায়। শরীর যতটা করতে পারে ভাবে, তার থেকেও শরীরকে দিয়ে বেশি করাতে পারে ইচ্ছার জোর। সেজন্য শরীর গড়লেই হয় না, মনকেও গড়তে হয়। শরীরকে হুকুম দিয়ে মন কাজ করাবে।...সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবেই, নয়তো কিছুতেই সাধ্যটাকে বাড়ানো যাবে না। যন্ত্রণায় ঝিমঝিম করবে শরীর, টলবে, লুটিয়ে পড়তে চাইবে যন্ত্রণার পাঁচিলের সামনে। আর তখন জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ দিতে হবে ওই পাঁচিলটাকে। এজন্য চরিত্র চাই, গোঁয়ার রোষ চাই।...যন্ত্রণাকে বোঝ, ওটাকে কাজে লাগাতে শেখ, ওটাকে হারিয়ে দে। শরীরটাকে ঘষে ঘষে শানিয়ে তোল। দেখবি কি অবাক তোকে করে দেবে ওই শরীর। যা অসম্ভব ভাবছিস তাকে সম্ভব করে দেবে। সোনার মেডেল-ফেডেল কিছু নয় রে, ওগুলো এক একটা চাকতি মাত্র। ওগুলোর মধ্যে যে কথাগুলো ঢুকে আছে সেটাই আসল—মানুষ পারে, সব পারে”। –মতি নন্দীর ক্ষিদ্দা, কথাগুলো বলেছিল কোনিকে।
আন্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মাউন্ট ভিনসন’-এর দিকে যখন হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে চলেছে মেয়েটি, হাঁটুর নীচে খোয়া যাওয়া বাঁ পা অবশ আর রড ঢোকানো কয়েক টুকরোর ডান পা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, তখন এই কথাগুলোই অস্ফুটে কে যেন তাঁর কানে কানে বলে গেল! ‘যন্ত্রণাকে হার মানাতে শেখ, যন্ত্রণা আর সময় দুটোই তোর অপোনেন্ট। যন্ত্রণাকে হারাতে পারলে সময়কেও পারবি হার মানাতে।’ তাপমাত্রা মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি, বরফ ঝড়ে বিশ্বচরাচর অবলুপ্ত। দলের সঙ্গী-সাথীরা এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। অস্পষ্ট তারা। চিৎকার করে ডাকলেও শুনতে পাচ্ছে না। কোমরে বাঁধা দড়ির ক্যারাবিনারে টান পড়লেই মালুম হচ্ছে কেবল চলতে হবে। থেমে থাকলেই অবধারিত মৃত্যু। কিন্তু চলা যে অসম্ভব। কোমরের হাড় টুকরো টুকরো, প্রচণ্ড যন্ত্রণা বিবশ করে ফেলছে। কষ্ট বাদবাকিদেরও, কিন্তু মেয়েটির সীমাহীন কষ্টের, গভীর গোপন অব্যক্ত যন্ত্রণার বিন্দুমাত্র অনুধাবনও তাদের পক্ষে অসম্ভব!
কী ভাবছিল মেয়েটি তখন? ‘হাঁটতে আমার খুব অসুবিধা। আমার একটা পা কৃত্রিম। আরেকটাতে রড ঢোকানো। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আমার অনেক বেশি সময় লাগে হাঁটতে। আমার সতীর্থদের কাছে পৌঁছতে আমার ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় লাগবেই। সূর্যের তীক্ষ্ণ ঝলসানো হুল ফোটানো রশ্মি। আমার মুখটা পুড়ে যাচ্ছে। আমি যে ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেকটা উঁচুতে। সর্বাঙ্গ আবৃত থাকলেও উন্মুক্ত কেবল মুখের সামান্য অংশ আর নাকটা। অবিশ্রান্ত বরফের কুচি বুলেটের মতো ফুঁড়ে দিচ্ছে। নাম আমার অরুণিমা সিনহা। আজকে যারা আমার লেখাটা পড়ছেন তাদের একটা কথা আমি শুধু বলতে চাই। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন, আপনিই আপনার ঈশ্বর, আপনার নিয়ন্তা। বিশ্বে এমন কিছু নেই যা আপনার অসাধ্য। স্বপ্ন দেখুন, বিরাট বিরাট অনতিক্রম্য স্বপ্ন। ছোট ছোট বাধা তখনই অক্লেশে অবহেলায় অতিক্রম করে যাওয়া যায়।আমার কোমর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, আমার দুটো পা নেই। আমি পারলে আপনারাও পারবেন, খুব সহজেই। আমি, আমার সমস্ত পাঠক ও তামাম দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনাদের ভালোবাসা, আশীর্বাদ ছাড়া ‘মাউন্ট ভিনসন’-এর চূড়ায় আমি উঠতে পারতাম না। পারতাম না করতে এই অসাধ্যসাধন। সব প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে আমি এভাবেই দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। মিনতি শুধু, পাশে থাকুন আপনারা। আমার এই জয় আমি বর্তমান-এর ‘রবিবার’-এর মাধ্যমে উৎসর্গ করছি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। দেশের জন্য তাদের উৎসর্গীকৃত জীবনকে। জয় হিন্দ।’
দুঃস্বপ্নের দিনলিপি
অরুণিমার ডাক নাম সোনু। জন্ম উত্তরপ্রদেশে, লখনউয়ের কাছে আম্বেদকর নগরে। বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার। তিন বছর বয়সে বাবাকে হারানো। মা স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী। বরাবরই একরোখা। খেলাধুলায় চৌকস। ভলিবলে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলেও সমান দঢ়। খুব তাড়াতাড়ি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহা। একা মা-র রোজগারে সংসার চলে না। বাবা-র বড় আদরের ‘সোনুর’ চোখে একরাশ স্বপ্ন। বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ জলে ভরে ওঠে। জাতীয়-স্তরের খেলোয়াড়, চাকরির ইন্টারভিউও তো বিস্তর দেওয়া হল! কিন্তু শিকে ছেঁড়ে না। সেনাবাহিনীতে স্বতঃপ্রবৃত্ত আবেদন, কিছুদিন হতোদ্যম হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ দিল্লি থেকে ‘সিআইএসএফ’-র লিখিত পরীক্ষার ডাক। চিঠিটা এসে পৌঁছলও পরীক্ষার ঠিক আগের দিন। ডাউন ‘পদ্মাবত এক্সপ্রেস’, যাবে লখনউ থেকে দিল্লি। রিজার্ভেশন মেলেনি। ১১ এপ্রিল, ২০১১। রাতের ট্রেন। অগত্যা উঠে পড়তে হল জেনারেল কামরায়। বসার জায়গাও মিলে গেল একটা। জানলার ধারে। ভৌতিক বাড়িঘর আর ঝুপসি অন্ধকারে ঢাকা কুয়াশার চাদর জড়ানো ধু ধু মাঠ দ্রুতগতিতে রাতের অন্ধকারে অপস্রিয়মাণ। গলায় ছোটবেলাকার একটা জ্বলজ্বলে সোনার হার, বাবার দেওয়া, স্মৃতি-সুধায়পুণ্য। অমূল্যও বটে। ট্রেনের দুলুনিতে টি-শার্টের ফাঁক দিয়ে হারটা মাঝেমধ্যেই ঝিকমিক করছে। উল্টোদিকের সিটে গোটা চার পাঁচেক ষণ্ডামার্কা লোক বারেবারে তাঁর গলার হারটাকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কী যেন কানাকানি করছে। লোকগুলোকে অরুণিমার প্রথম থেকেই ভালো লাগেনি। যাক কামরায় তো অনেকেই রয়েছে, ঘুমিয়েও পড়েনি সবাই। রাত তখন প্রায় ১টা। কামরার আলো নিভে গিয়েছে, সকলেই প্রায় নিদ্রিত। আচমকাই অরুণিমার গলার হারে হ্যাঁচকা টান, সিট থেকে ধপাস করে পড়ে গেল অরুণিমা। তিন চারজন মিলে হারটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। অরুণিমা প্রাণপণ শক্তিতে বাধা দিচ্ছে। দুষ্কৃতীরা ক্রমশঃ ঠেলতে ঠেলতে তাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দরজার দিকে। অনেকেই অরুণিমার চিৎকারে জেগে উঠেছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না সাহায্য করতে। দুর্দান্ত খেলোয়াড়ি শক্তিতে অরুণিমা কিল-চড়-লাথি মেরে যাচ্ছে। একজন তাঁর হাঁটুর গুঁতোয় পড়েও গেল। দু’জন, তার হাত পিছমোড়া করে ধরল আর একজন ক্রমান্বয়ে তলপেটে লাথি মেরে যেতে লাগল। তাদের হাঁটুর উপর্যুপরি গুঁতোয় অরুণিমার কোমরের হার ভেঙে গেল, অজ্ঞান হয়ে গেল অরুণিমা। তলপেটে অমানুষিক আঘাতের কারণে শুরু হয়ে গেছে প্রবল রক্তক্ষরণ। নির্বাক-নিস্পন্দ ক্লীব একদল ট্রেনযাত্রীর সামনেই, অচৈতন্য অরুণিমাকে তিন ডাকাত চ্যাংদোলা করে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল ট্রেনের খোলা দরজা দিয়ে। ধপাস করে ক্ষীণ একটা শব্দকে মাড়িয়ে চলে গেল ট্রেনের কর্কশ জান্তব গতি।
অজ্ঞান অরুণিমা ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের রেললাইনে, জ্ঞান ফিরে এল আচম্বিতে। দুদ্দাড় গতিতে একটা ট্রেন এগিয়ে আসছে। অরুণিমা ট্রেনের আওয়াজ টের পেল, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে লাইন থেকে টেনে সরাতে পারল না । বাঁ পায়ের উপর দিয়ে চলে গেল ১৮ কামরার দৈত্যাকৃতি ট্রেন। অরুণিমা দেখল কাটা জিনসের টুকরোর সঙ্গে হাঁটুর নীচ থেকে কাটা পা ঝুলছে। ছোট ছোট ইঁদুর লাইনের আশপাশ থেকে জুটে গিয়েছে। কাটা পা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে তাদের মহোৎসব। ক্ষীণ চাঁদের ম্লান আলোয় অরুণিমা প্রত্যক্ষ করছে ইঁদুরদের অপার্থিব উল্লাস। চোখের দৃষ্টি ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আসছে। ডান পায়ের হাড় টুকরো টুকরো। আর্ত চিৎকার তখনও চলছে, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া ট্রেনের যাত্রীরা অনেকে সেই চিৎকার শুনেছেও। ভোরের আলো সবে ফুটেছে। গ্রামবাসীরা ছিন্নভিন্ন অরুণিমাকে লাইন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল বেরিলি জেলা হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরে এসেছে অরুণিমার। ডাক্তাররা বলছে রক্ত নেই, নেই অজ্ঞান করার লোক। কিন্তু এখনই হাঁটুর নীচ থেকে বাঁ পা কেটে বাদ না দিলে বাঁচানো যাবে না রোগীকে। সব কথাই অরুণিমা শুনতে পাচ্ছে। অরুণিমা চিৎকার করে উঠলো ‘ডাক্তারবাবু কিছু একটা করুন, সারারাত আমি লাইনে পড়ে ছিলাম, আমি আর পারছি না, আমার পাটা কেটে বাদ দিন, বাঁচান আমাকে।’ সহৃদয় ডাক্তার-নার্স, আশেপাশে যারা ছিলেন সকলে মিলে রক্ত দিলেন। কোনওরকম অ্যানাস্থেশিয়া ছাড়াই ইমার্জেন্সির ডাক্তারবাবু বাঁ পা কেটে একেবারে বাদ দিলেন। সেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার স্মৃতি শয়নে-স্বপনে এখনও তাড়া করে অরুণিমাকে।
ইতিমধ্যে মিডিয়ার লোকজন জড়ো হয়েছে। রাজ্য ভলিবল চ্যাম্পিয়ন অরুণিমাকে তারা চিনতে পেরেছে। মিডিয়ার দৌলতে বেরিলি থেকে তৎক্ষণাৎ লখনউয়ের ‘কিং জর্জ মেডিক্যাল কলেজে’ স্থানান্তরিত অরুণিমা। সেখান থেকে দিল্লির ‘এইমস’-এর ট্রমা সেন্টার। ক্রীড়ামন্ত্রীর তত্ত্বতালাশে চিকিৎসাও দ্রুত শুরু হল। চিকিৎসা চলেছিল টানা ৪ মাস। ক্রীড়ামন্ত্রক ২৫০০০ টাকা দিল। কিন্তু অরুণিমার মতো একজন জাতীয় চ্যাম্পিয়নকে পঁচিশ হাজার টাকার সরকারি দাক্ষিণ্য! দেশজুড়ে ধিক্কারের ঝড় উঠল। তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী অজয় মাকেন তড়িঘড়ি ২ লাখ টাকা অনুমোদন করলেন। দিন ২৫ বাদে অরুণিমা একটু সুস্থ। সকালের খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। চোখ আটকে গেল একটা খবরে। সরকার অরুণিমার ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে। নানা রসালো গল্প তদন্তকারীরা খাড়া করেছেন। একদল বলছে, বিনাটিকিটে ভ্রমণ করছিল তাই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েছে। আরেকদলের অনুসন্ধান, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অরুণিমাকে, তাই আত্মহত্যার চেষ্টা! তদন্তকারীদের যাবতীয় কুযুক্তিকে নস্যাৎ করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চ রেলকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিল। অরুণিমা বলছেন, ‘আমি তখন হুইলচেয়ারে ঠিকমতো বসতে পারছি না, ক্র্যাচ ধরতে পারছি না। আমার একটা পা বাদ গিয়েছে। জানি না কীভাবে আমার বাকি জীবন কাটবে! বাড়ির লোকেরা ভেঙে পড়ছে এ ধরনের মিথ্যে সংবাদে, আর আমি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি এই অন্ধকার চক্রব্যূহ থেকে আমাকে যেভাবেই হোক বেরতে হবে। নিজেকে বললাম আর ভলিবল নয়, সবচেয়ে কঠিন খেলা, পর্বতারোহণই আমার সব অপমানের, যন্ত্রণার জ্বালা জুড়োতে পারে। পঙ্গুং লঙ্ঘতে গিরি—আমার কাছে অন্তত আপ্তবাক্য হয়ে থাকবে না। আমাকে এভারেস্ট জয় করতেই হবে।’
কতটা পথ পেরলে তবে
অরুণিমা তাঁর গোপন ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করতেই, সকলে তাঁকে পাগল ঠাওরালেন। যাঁর একটা পা নকল আরেকটাতে রড ঢোকানো, সে চড়বে এভারেস্ট! সকলে হাসাহাসি করলেও বাড়ির লোকেরা সমর্থন দিল। বড়দা ওমপ্রকাশ যথেষ্ট উৎসাহ দিলেন। ৪ মাস বাদে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরুণিমা বাড়ি না গিয়ে সোজা চলে গেলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা এভারেস্টজয়ী বাচেন্দ্রী পালের কাছে। বাচেন্দ্রী অরুণিমাকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন। ডান পায়ের সেলাই তখনও কাটা হয়নি। কিন্তু অরুণিমার মনের জোরে স্তম্ভিত বাচেন্দ্রীর মনে হয়েছিল পারলে এ মেয়েই পারবে! বাচেন্দ্রী তখন টাটা স্টিল অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের অধিকর্ত্রী। তাঁরই তত্ত্বাবধানে শুরু হল পর্বতারোহণের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, উত্তরকাশীর নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে। নকল পা কেনার টাকা জোগাড় হয়েছিল ভদোদরার রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের মাধ্যমে।
ট্রেনিংয়ের সময় রাস্তা থেকে বেসক্যাম্পে যেতে বাকি সদস্যদের দু মিনিট লাগত। অরুণিমা সেই দু মিনিটের পথ প্রথমদিকে পেরিয়েছেন তিন ঘণ্টায়। কারণ দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও তখন তাঁর ছিল না। সতীর্থরা অরুণিমাকে আশ্বস্ত করত, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে তুমি এসো। ধীরে না চলে উপায়ও নেই, পায়ে চাপ পড়লেই শুরু হবে রক্তক্ষরণ! সতীর্থদের করুণা অরুণিমাকে যেন বিদ্রূপ করত। আটমাসের প্রশিক্ষণ পর্ব শেষে বেসক্যাম্প থেকে শিখরে পৌঁছনোর দিন অরুণিমা সকলের আগে পৌঁছেছিলেন। প্রস্তুতিপর্বে, ২০১৩ সালের ১লা এপ্রিল টাটা স্টিল অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের পরামর্শদাতা সুশেন মাহাতের সঙ্গে ৬৬২২ মিটারের চামসার কাংরি শৃঙ্গ জয়, তারপরেই এভারেস্ট অভিযানের সলতে পাকানো শুরু। ৫২ দিনব্যাপী অরুণিমার এভারেস্ট অভিযান চলেছিল। দু’ পা নেই এমন অভিযাত্রীকে কিছুতেই সঙ্গে নেবেন না শেরপা। তাঁর ভয়, খানিকটা যাওয়ার পরই হয়তো অরুণিমাকে কাঁধে করে বইতে হবে! এভারেস্টে যা অসম্ভব! এভারেস্ট অভিযানের সমস্ত প্রশিক্ষণ পর্বই যে অরুণিমা বিরল কৃতিত্বে সুসম্পন্ন করেছেন, তা শেরপা বুঝতে পারেননি। বহু আবেদন নিবেদনের পর নিমরাজি শেরপা। সকালের সোনাঝরা রোদে নিবাত-নিষ্কম্প, নীলাভ-সবুজ কাঁচের মতো বরফের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এভারেস্ট অভিযাত্রী দল। খানিকটা এগোনোর পরই অরুণিমা বুঝতে পারলেন তাঁর নকল বাঁ পা বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছে, বরফের উপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। ঘুরে যাচ্ছে বারেবারে, বড়সড় দুর্ঘটনা শুধু সময়ের অপেক্ষা। শেরপা বলল, কোনওমতেই অরুণিমা উপরে উঠতে পারবেন না। পায়ের চাপে দৃঢ়-সংকল্পে ছোট ছোট গর্ত করে অরুণিমা এগনোর চেষ্টা করছেন। ধীরে ধীরে এগতে থাকার অমানুষী প্রত্যয়ে অভ্যাস হয়ে গেল ওভাবেই বরফে ভারসাম্য রেখে এগিয়ে চলার। বেস ক্যাম্প থেকে ‘ক্যাম্প থ্রি’ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। হঠাৎই নকল পা ঘামতে শুরু করল। এমন অবস্থা যে পা’টা খুলে বেরিয়ে আসতে পারে। অরুণিমা হাতের গ্লাভস খুলে যে পা ঠিকঠাক করে আটকে নেবেন, তারও উপায় নেই। কারণ, গ্লাভস খুললেই হাতে তুষারক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা। অমানুষিক পরিশ্রমে টেনে-হিঁচড়ে কেঁদেকঁকিয়ে এগিয়ে চলা। বজ্রাঘাত! এক সতীর্থের আকস্মিক মৃত্যু। একে অরুণিমা চলতে পারছে না, তার ওপর অভাবিত এই মৃত্যু। শোকে মুহ্যমান গোটা দল। দাঁতে দাঁত চেপে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে অরুণিমা ‘হিলারি স্টেপস’-এ। আর মাত্র কয়েক কদম তারপরে গোটা বিশ্ব ভূলুণ্ঠিত! চির উন্নত শির! পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে দু’পা খোয়ানো এক মানবী। অরুণিমার মনে পড়ে যাচ্ছে এক প্রতিবেশীর হাহাকার, ‘এ খোঁড়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে?’ মনে পড়ে যাচ্ছে মা’র কথা। বলতেন, ‘ভয় পাস না, একটা পাহাড় টপকে পিছন ফিরলেই দেখবি তুই কত ওপরে। সামনেরটা তখন টপকাবি সহজেই।’ এমন সময় শেরপার আর্ত চিৎকার, আবার কি বিপদ, বুকটা ধড়াস করে উঠলো! ‘অরুণিমা তোমার অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমি নেমে চল, মারা পড়বে না হলে!’ হিলারি স্টেপসে দাঁড়িয়ে প্রত্যাবর্তন? অসম্ভব! অরুণিমা চিৎকার করে উঠল, ‘কিছুতেই না।’ এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করা মানে সেটাও মৃত্যুরই সমান। ‘সামিট আমি করবই।’ শেরপা সহ সকলেই হতবাক। তারা বুঝতে পারছে অরুণিমার জেদ আত্মহত্যার শামিল। শুধু সামিট নয়, তারপর তো নামতেও হবে। এক ব্রিটিশ অভিযাত্রী, নিঃসন্দেহে দৈব-প্রেরিত। নেমে আসছেন। অভিযান অসফল। তার কাছে একটা বাড়তি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল তিনি সেটা সানন্দে অরুণিমাকে দিলেন। ২০১৩ সালের ২১ মে, ১০.৫৫ মিনিট। বিশ্বে প্রথম কোনও মহিলা এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতের পতাকা ওড়াচ্ছেন, দু’ বছর আগে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় যাঁর দু’টি পা’ই খোয়া গিয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ জীবনের ধ্রুবতারা, উত্তিষ্ঠ্যত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিভ্যতে অরুণিমার মন্ত্র। সামিট করা পর্যন্ত বুকে আঁকড়ে ছিলেন বিবেকানন্দের ছবি। ভারতের পতাকার সঙ্গে বিনম্র শ্রদ্ধায় এভারেস্টের চূড়ায় রেখে এসেছেন বিবেকানন্দের একটি ছবিও। চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিলেন, পারেননি। অস্ফূটে শুধু বলেছিলেন, ‘পেরেছি, আমি পেরেছি।’ সেই মূহূর্তে ঝোড়ো-বাতাসে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে হিলারির সেই অমোঘ উক্তি, ‘পাহাড় নয়, মানুষ পাহাড়ে উঠে নিজেকেই জয় করে।’
হাল ছেড়ো না বন্ধু
এভারেস্টের পর সাত মহাদেশের সপ্তশৃঙ্গের মধ্যে জয় হয়েছে ছ’টিই। রাশিয়ার ১৮৫১০ ফিট উচ্চতার ‘মাউন্ট এলব্রুস’, আফ্রিকার তানজানিয়ার ১৯৩৪১ ফিটের ‘কিলিমাঞ্জারো’, অস্ট্রেলিয়ার ৭৩১০ ফিট উচ্চতার ‘কসকিয়াসকো’, আর্জেন্টিনার ২২৮৩৭ ফিটের ‘আকনকাগুয়া’, ইন্দোনেশিয়ার ১৬০২৪ ফিটের ‘পুনকাক জাইয়া’ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি আন্টার্কটিকার ১৬০৫০ ফিটের ‘মাউন্ট ভিনসন’। এভারেস্ট বিজয়ের পর উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব অরুণিমার লখনউয়ের ৫নং কালীদাস মার্গের বাড়িতে গিয়ে ২৫ লাখ টাকা দেন। সে পুরস্কারমূল্যে ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ মানুষ বা শিশুদের জন্য অরুণিমা গড়ে তুলছেন ‘পণ্ডিত চন্দ্রশেখর বিকলাঙ্গ খেল অ্যাকাডেমি’। প্রথম বিশেষভাবে সক্ষম মহিলা হিসেবে এভারেস্ট জয়ের কৃতিত্বে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ‘পদ্মশ্রী সম্মানে’ ভূষিত অরুণিমা। নকল অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পর সড়গড় হতে সাধারণের ২ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। নকল পা নিয়ে অরুণিমা হাঁটতে শুরু করেছিলেন ঠিক দু’দিন পরে। অরুণিমার এই অতিমানবিক সাফল্যের রহস্য জানতে চাইলে মৃদু হেসে উত্তর দেন, ‘আভি তো ইস বাজ কি আসলি উড়ান বাকি হ্যায়। আমি কেবল সমুদ্রের উপর এক চক্কর ডানা মেলে উড়ে এসেছি, গোটা আকাশটাই যে এখনও বাকি পড়ে আছে।’ তাঁর মতে, ‘কন্যাশিশুকে উচিৎ সবসময় উৎসাহ দেওয়া, তার অমিত সম্ভাবনার কথা বহিঃপৃথিবী জানেই না।’ তাঁর কাছে ব্যর্থতা মানে লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারা নয়, লক্ষ্যটাকেই ঠিক না করতে পারা। কী যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেলেন ম্যান্ডেলা, ‘ইট অলওয়েজ সিমস ইম্পসিবল আনটিল ইট ইজ ডান...।’