সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
প্রতিমা, বয়স ৫৫। আমার মায়ের বান্ধবী। জীবনের শুরুতে বাড়ির নানা চাপে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাননি। যখন ভাবার বয়স হল, তখন ঘাড়ে এসে পড়ল গোটা একটা সংসার। দুই ভাই আর দুই বোনের সংসারে বড় প্রতিমাই। বড় ভাই আর বোনের বিয়ে তাঁর বাবা দেন। কিন্তু ছোট ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তার পুরো দায়িত্ব নিতে হয় প্রতিমাকেই। বাবা-মা আজ কেউই বেঁচে নেই। ভাইবোনরাও নিজেদের জীবনে থিতু। যে যার মতো সংসার জীবন কাটাচ্ছে। সুখে হোক বা অসুখে, তাদের যাবতীয় প্রয়োজনে ডাক পড়ে এঁর। অথচ পান থেকে চুন খসলেই নিন্দে-মন্দ, দোষারোপ। অসহায় এক মহিলা বেঁচে আছেন পারিবারিক সম্পত্তি আগলে, অসুস্থ ভাইয়ের দেখভাল করতে।
প্রতিমার বাবা, জেঠু ছিলেন চূড়ান্ত রাশভারি। তাঁদের দাপটে নাকি এক সময় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। এমন মেয়েকে যে তাঁরা দাবিয়ে রাখবেন, সে আর বিচিত্র কি! তাই স্কুল, কলেজের বাইরে, বাড়ির ঘেরাটোপে এমন আটকা ছিলেন প্রতিমা, যে কোনও দিন বান্ধবীদের সঙ্গে বাইরে বেরনোর কথাও ভাবতে পারেননি।
আর একজনের কথা বলব আজ। সম্পর্কে তিনি আমার এক পিসিমাই হন। যদিও আমরা ছোটরা তাঁকে ডাকতাম মিনিদিদি বলে। শহরতলির এক মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন মিনিদিদি। তিনিও আজীবন অবিবাহিতা। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাও বেশ কয়েকবছর হল। জীবনের শুরুতে পড়াশোনা আর কেরিয়ারের চাপে নিজেকে নিয়ে ভাবতেন না। পড়াশোনাতে চিরকাল অসাধারণ। চাকরিও হল মনমতো। উচ্চমাধ্যমিক গার্লস স্কুলে। রাশভারি ভাবটা তাঁর যে চেহারার বাহ্যিক আবরণ মাত্র, আমরা ছোট দুষ্টুর দল তা খুব বুঝতাম। ছোট থেকেই সাজুনি আমি, মিনিদিদির বাড়িতে গেলেই চলে যেতাম তাঁর বিরাট আয়না দেওয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পাউডার, ক্রিম, সেন্ট— সব মেখে ভূত সাজলে যেন আদরের মাত্রাটা আরও বেড়ে যেত তাঁর। শত দুষ্টুমিতেও কোনও দিন তাঁর থেকে কড়া কথা বা কড়া চোখের শাসন পাইনি। এখনও মনে পড়ে মিনিদিদির হাতের তৈরি পোলাও, বোঁদে আর রসগোল্লার পায়েসের কথা। মায়ের মুখেই শোনা, সেই মিনিদিদির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। পাকা দেখা, আশীর্বাদের পর বিয়ের তোড়জোড়, কেনাকাটা সব শেষ। অত উচ্চশিক্ষিতা, চাকরিরতা মেয়ের বিয়ে বলে কথা। নিমন্ত্রণপত্র ছাপানোর পরে এল সেই দুঃসংবাদ। অজ্ঞাত কোনও এক কারণে এই বিয়েতে রাজি নয় পাত্রপক্ষ। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। এমনও হয়! স্বনির্ভর এমন মেয়েকে বোধ করি ঘরের বউ করতে ভয় পেয়েছিলেন ব্যাকডেটেড পাত্রপক্ষের দল। সব আশঙ্কা সত্যি করে এমনটাই হল। বাড়ির লোকেরা ছেলের বাড়িতে কথা বলতে যাবে বললেও এবারে আর রাজি হলেন না মিনিদিদি। বলেছিলেন, ‘ওদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। এ বিয়ে আমি আর করব না।’ ভেঙে গেল বিয়ে। সারাজীবন একা থাকার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন তিনি। বিয়ের জন্য তৈরি খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিলেই আজীবন সাজলেন। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে কখনও কি ভেসে উঠত আগের ছবি! কিংবা নিজের কোনও অচেনা রূপ কি ধরা পড়ত তাঁর চোখে? কে জানে! তাঁকে যতটুকু চিনেছি তাতে, মনে হয়নি বিয়ে না হওয়াটা তাঁর কাছে একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। বরং নিজের শিক্ষাকেই তিনি কাজে লাগিয়ে মেয়েদের বলতেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে বহু টানাপোড়েন হামেশাই দেখা যায়। মেয়ের বয়স পঁচিশের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। বিয়ের ঠিক সময় কোনটা তা কে জানে! তবু কলেজ ছেড়ে বেরনো মানেই মেয়ে উপযুক্ত। অতএব মেয়ের জন্য পাত্র দেখার শুরু। মেয়ের বিয়ে না হলে এখনও হতাশ হয়ে পড়েন বাবা-মা। কিশোরী শ্যামলা মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে চিন্তিত মাকে দেখেছি সর-ময়দা, হলুদবাটা লাগাতে। এই সমাজে মেয়েদের বিয়ে না হওয়া কি অপরাধ?
পেশায় সাংবাদিক তৃণা। দিল্লি থেকে জার্নালিজমে মাস্টার্স করে ন্যাশনাল চ্যানেলে রিপোর্টার। আমারই এক বান্ধবী। তুমুল কেরিয়ারিস্ট মেয়েটি এখন তিরিশের কোঠা পেরিয়েও বিয়ের কথায় বলে, ‘ওসব আমার জন্য নয়। কাজ ছাড়া ভাবতেই পারি না কিছু। বিয়ে মানেই কাজ শেষ।’ ওর সঙ্গে কথা বলে বহুবার বুঝতে চেষ্টা করেছি, কেউ আছে কি না মনের মানুষ। সত্যি বলতে কি, আলাদা করে আর বিয়ে করার তাগিদ অনুভব করে না তৃণা— একথা স্পষ্ট বুঝেছি। কিন্তু আত্মীয়স্বজনরা বুঝতেই পারেন না একাও সুখে থাকা যায়। তৃণার মা চিন্তিত একমাত্র মেয়ের গতি কী হবে তা ভেবে। কোনও অনুষ্ঠানে গেলেই শুরু হয়ে যায় কানাঘুষো। ধিঙ্গি মেয়ে কী করে বাবা! বিয়ের নাম নেই। বিরক্ত হয়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে তৃণা।
তিনজনের জীবন তিনটি বৃত্তের। কিন্তু তিনজনেই সাত পাকে বাঁধা পড়েননি। কারণটা যদিও ভিন্ন। আসলে বর্তমান সময়টা নারী ও পুরুষের সমানতালে তাল মিলিয়ে চলার। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পিছিয়ে নেই কোনও দিক থেকেই। শিক্ষা-দীক্ষা, কাজে-কর্মে সব জায়গাতেই মেয়েরা এগিয়ে। তবুও অবিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে চলতে থাকে কানাঘুষো ফিসফাস। কেউ জানতেও চান না মেয়েটি আদতে বিয়ে করতে ইচ্ছুক কি না।
ঘটনাগুলো সবই সত্যি। এঁরা আমাদের আশপাশেই রয়েছেন। অবিবাহিতা মধ্যবয়সি প্রতিমা আজ অসহায় বোধ করেন। জীবনের মাঝ আকাশে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো জীবন কারই বা ভালো লাগে! তাঁর এ অসহায়তা নিরাপত্তাহীনতার। সংসারের জোয়াল টেনে চললেও, আগে এঁদের বলা হত ‘সংসারের বোঝা’। এখন সম্ভবত তাঁরা ‘সমস্যা’র নামান্তর। পেনশনের টাকায় সংসার চালান, তাই হাত পাততে হয় না কারও কাছেই। তবুও হাজার সমস্যাতেও ভাই, ভাইয়ের বউ, বিবাহিতা ছোট বোনের কাছে ইনি অপাংক্তেয়। অথচ নিজেদের প্রয়োজনে অবলীলায় এসে পড়তে পারে প্রতিমার ঘাড়ে। অবিবাহিতা হওয়ার মাসুল দিতে হয় কড়ায় গন্ডায়।
মিনিদিদির বিয়ের আগেই বিয়েভাঙা তাঁকে চোখে আঙুল দিয়ে ঠুনকো সম্পর্কের জটিল আবর্ত চিনিয়েছিল।
তৃণার মতো মেয়েরা স্বনির্ভরতার দাপটে চলেছে। তাদের পাশে নির্ভর করার জন্য পুরুষ কাঁধের দরকার নেই। বিয়ে না করার জন্য এঁদের কেউ কেউ সামাজিকভাবে সমস্যায় পরলেও, সবাই যে সত্যি অসুখী নয়, সেটা বোঝেন না অনেকেই। সময়টা যে বদলেছে, তারই ছাপ তৃণার মতো মেয়েদের চরিত্রে। প্রতিমা যে সমস্যায় পড়েছেন, তা শিক্ষা-স্বনির্ভরতার ডানায় উড়ান দিয়ে উতরে গেছেন মিনিদিদি। আবার মিনিদিদি যে ধাক্কা খেয়েছেন, সেটা তৃণার ভবিষ্যত নয়। এটাই বদলে যাওয়া সমাজের চিত্র।