বিতর্ক বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ। ... বিশদ
বলা বাহুল্য গল্পটি রূপক। ছোট কাহিনীটির মধ্যে আমরা পাই মানুষের অসীম, অপরাজেয় সম্ভাবনার ইঙ্গিত। নিবেদিতা তাঁর অনুপম ভঙ্গীতে যার বর্ণনা করেছেন, ‘Men are finite dreamers of infinite dreams’ —মানুষ সীমার গন্ডিতে থেকেও অসীমের পূজারী। অধ্যাত্মসম্পদে দীন ব্যক্তির কাছে ভগবান ওই সাধুর মতো পথপ্রদর্শক বা আচার্যরূপে উপস্থিত হন। তিনিই মুক্তিপিপাসুকে অসৎ থেকে সতে, তমসা থেকে জ্যোতিতে, মৃত্যু থেকে অমরত্বে উন্নীত করেন। তিনি কেবলই বলেন, —‘এগিয়ে যা।’
এই কাহিনীটি কি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? দুশো বছরের বিদেশী শাসন ও পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে পঁচিশ বছর আগে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। এই স্বাধিকার অর্জন করতে তখনকার মুক্তি-যোদ্ধাদের ওই কাঠুরের মতোই বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। একদিন তাঁরা নিজেদের জীবন, স্ত্রী-পুত্র, গৃহ-সম্পদ তুচ্ছ করে, ভবিষ্যতের সব আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য সম্মুখে রেখে মুক্তি-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেদিন যৎসামান্য সুবিধা বা অধিকার লাভ করেই তাঁরা যদি তৃপ্ত হয়ে থেমে যেতেন— তবে কেবলমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা তুলে ধরবার অধিকার ও জাতীয় সঙ্গীত গাইবার গৌরবটুকু লাভ করতেই আমাদের আরো অনেকগুলি পঁচিশ বছর পেছনে ফেলে আসতে হত। কিন্তু স্বল্পে তুষ্ট হয়ে তাঁরা থেমে থাকেননি। স্বদেশের পূর্বগগনে স্বাধীনতা-সূর্যের পূর্ণ জ্যোতির্ময় আবির্ভাব না দেখা পর্যন্ত সেই জীবনপণ তপস্যা থেকে নিবৃত্ত হননি।
আজকের ছেলেমেয়েদের সম্মুখে স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তির পুণ্যলগ্ন সমাগত। দিনটি নিঃসন্দেহে একটি উৎসবের দিন। কিন্তু এ কি নূতন সংকল্পেরও দিন নয়? কান পেতে শোন, কে যেন বলছে—‘এগিয়ে যা।’ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। আম-কাঁঠালের বন থেকে কাঠুরে এসেছে চন্দনের বনে।
পৌঁছতে হবে ‘হীরার খনি’ পর্যন্ত। সে যে অনেক—অনেক দূরের পথ! এখনও অসংখ্য বন অতিক্রম করতে বাকি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উচ্চচূড়া এখনও সুদূরতম দিগন্তে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, বৈজ্ঞানিক প্রগতি, উন্নতমানের জীবনচর্যা সবই চাই—প্রত্যেক স্বদেশবাসীর জন্য। কিন্তু ভিক্ষা করে পাওয়া নয়, আপন বীর্য দিয়ে অর্জন করা— চাই অতন্দ্র তপস্যা। দেশমাতা আরো অনেক আত্মত্যাগী, স্বার্থশূন্য সন্তান চান—যারা দেশ গড়ার কঠিন সঙ্কল্প বুকে নিয়ে অনায়াসে সব বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে। ত্রিবর্ণ পতাকাকে পৌঁছতে হবে স্বাধীনতার রজত-জয়ন্তী থেকে সুবর্ণ-জয়ন্তীর লগ্নে—সেখান থেকে হীরক-জয়ন্তীর মহালগ্নে। যাত্রা কি তখনও শেষ হবে? হয়তো যেতে হবে নিঃসঙ্গ—যেমন গিয়েছিলেন মহাত্মাজী। কেউ যে ডাক শুনে সঙ্গে আসবে তারই বা নিশ্চয়তা কী? হয়তো বা ওই কাঠুরের মতোই নিঃসঙ্গ যাত্রা—যেমন দেখেছি সমুন্নতশির কটিবস্ত্রাবৃত দন্ডপানি মহাত্মা গান্ধীকে—চলছেন মহামন্ত্র জপতে জপতে—
বজ্রানলে/ আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে/ একলা জ্বলো রে।