আইভি চট্টোপাধ্যায়: দিন ধরে খুব মনখারাপ তিতলির। সবার বাড়িতে ‘পেট’ আছে। প্রায় সব বাড়িতেই আছে নানা জাতের পুষ্যি কুকুর। স্প্যানিয়েল-পোমেরিয়ান-ফ্রেঞ্চ বুলডগ থেকে ল্যাব্রাডর-রিট্রিভার-ডাচসুন্ড-অ্যালসেশিয়ান। কিন্তু মা একদম রাজি নয়। কুকুরকে মায়ের খুব ভয়।
পিকলুদের বাড়িতে চারটে বেড়াল, ওরা একটা দিতেও চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের ভয়, বেড়াল থেকে ডিপথেরিয়া অসুখ হয়। খরগোশ, গিনিপিগ। মা বলে, ওরা বাড়ি নোংরা করে। খাঁচায় সুন্দর টিয়া। মা বলে, বন্দি পাখি রাখা ভালো নয়। অ্যাকোরিয়াম, সুন্দর সুন্দর মাছ। চঞ্চল গাপ্পি, সুন্দর সুন্দর গোল্ডফিশ। মা বলে, যত্ন না পেলে মাছ মরে যায়।
আসল কথা তা নয়। ‘পেট’ মানে বন্ধু, একটা সবসময়ের সঙ্গী। সেটা বাবা-মা বুঝতেই পারে না। বাবা বলে, সারাদিন কে দেখবে পুষ্যিকে? আমি আর মা অফিস যাই, তুই স্কুলে যাস। বাড়িতে একা একা ও থাকবে কী করে?
তাছাড়া আমরা যখন বেড়াতে যাই, কার কাছে থাকবে ও? মা বলেছে। তিতলির মন ভালো করার জন্যে বাবা পুরো শীতকাল ধরেই প্রতি রবিবার বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। চিড়িয়াখানা, ইকো-পার্ক, ডিয়ার-পার্ক, নিক্কো-পার্ক, ওয়াটার-স্পোর্টস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বোটানিক্যাল গার্ডেন। রবীন্দ্র-সরোবরে পাখি।
বাবা বলল একদিন, কী রে তিতলি, বাড়িতে ‘পেট’ থাকলে এত বেড়ানো হতো?
অমনি তিতলির মনখারাপটা ফিরে এল। আর যেমনটা হয়, মনখারাপ হলেই বারান্দায় চলে যায় তিতলি। আকাশটা আজ খুব নীল। বিকেল নেমেছে, এখনও সূর্য ডুবে যায়নি। একটা কমলা আলো পড়েছে নীল
আকাশের গায়ে।
একলা একলা বসেছিল বারান্দায়, আকাশের দিকে চোখ পড়ে গেল। একঝাঁক হাঁস উড়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর! এগুলো কি পরিযায়ী পাখি?
সেদিন রবীন্দ্র-সরোবরে এমনই অনেক হাঁস, সারস নানারকম পাখি ছিল না?
বাবা বলেছিল, এদের পরিযায়ী পাখি বলে। মাইগ্রেটরি বার্ড। অনেক দূরের দেশ থেকে উড়ে উড়ে আসে ওরা। গরম দেশে শীতের সময়টা কাটাতে আসে।
হিমালয়ের উত্তরদিক থেকে, বরফের পাহাড় পেরিয়ে আসে। কোনও পাখির দল আবার সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে আসে। শীতের শুরুতে আসে। শীতের শেষে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়।
বাবা বলছিল, একদিন তোকে সাঁতরাগাছির ঝিল দেখাতে নিয়ে যাব তিতলি। ওই ঝিলে প্রচুর সাইবেরিয়ান প্রজাতির হাঁস আসে। রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসা
হাঁস, বুঝলি?
রীতেনমামা সেদিন বলল, ট্রান্স-হিমালয়ান পাখিরা আসে মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া ও উত্তর-চীন থেকে।
যদিও ব্যাঙ্কে কাজ করে, আসলে রীতেনমামা একজন বার্ডার। পাখির ছবি তুলতে বা পাখি দেখতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের বলা হয় ‘বার্ডার’। রবীন্দ্র সরোবরে পাখি দেখতে গিয়ে রীতেনমামার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।
অনেক পাখি চিনিয়ে দিয়েছিল রীতেনমামা, ওই দেখ, ট্রান্স-হিমালয়ান বার্ড। গ্যাডওয়াল। ওদিকে দেখ, ওগুলো সাইবেরিয়ান প্রজাতির হাঁস। গ্রেল্যাগ গুজ। ওগুলো সাইবেরিয়ান ক্রেন। আর এইদিকে এগুলো বার-হেডেড হাঁস আর রুডি শেলডাক।
নানারকম পাখি চিনিয়ে দিয়েছিল রীতেনমামা। যেমন বাহারি নাম, তেমন বাহারি গায়ের রং। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মাইগ্রেটরি।
বাবা দেখিয়েছিল ইন্ডিয়ান পিটা আর ব্ল্যাক-হুডেড পিটা। ছোট্ট, অপূর্ব সুন্দর এবং
বিরল প্রজাতি।
রবীন্দ্র-সরোবর, পাখি ও পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখি চেনার চেষ্টা করছিল তিতলি। আজকাল প্রায়ই দলে দলে উড়ে যায় ওরা। হয়তো আগেও যেত, তিতলি খেয়াল করেনি। এক একটা দল এত উঁচুতে উড়ে যায়, কিচ্ছু চেনা যায় না। কোনও কোনও দলের ডানার শনশন শব্দ শোনা যায়। আবার একদল হয়তো গাঁক গাঁক শব্দ করে উড়ে গেল। আজকাল এই পরিযায়ী পাখি দেখা বেশ নেশা হয়েছে তিতলির।
....
সেদিনও দুপুরে বারান্দায় বসেছিল। একঝাঁক বুনো হাঁস উড়ে যাচ্ছে। হঠাত্ একটা হাঁস দল ছেড়ে নীচে নেমে পড়ল। ফ্ল্যাটের সামনেই সারি দিয়ে রঙ্গন ফুলের গাছের ঝোপ। পাখিটা ঝোপের ওপর নেমে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
‘মা’ বলে জোরে ডেকে উঠেছে তিতলি। তারপরই মনে পড়েছে, মা তো অফিসে। বাড়িতে কেউ নেই। দরজা খুলে সোজা নীচে ছুটেছে। নীচে এসে দেখল, আরও একটা হাঁস নেমে এসেছে। সেটা ঝোপের ওপর বা মাটিতে বসেনি। অন্য হাঁসটার চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে।
তিতলিকে ছুটে বেরতে দেখে সিকিউরিটি আঙ্কলও বেরিয়ে এসেছে।
বলল, পাখিটা জখম হয়েছে। তাই বেচারি উড়তে পারছে না।
ওকে এখানে রাখা যাবে না, তিতলি বলল, রাস্তার কুকুর বেড়াল ওকে মেরে ফেলবে।
আমি সোসাইটির গার্ডেন ডিপার্টমেন্টকে ডেকে দিচ্ছি, ওরা এসে ব্যবস্থা করবে,
আঙ্কল বলল।
তিতলি বলল, তোমার ফোনটা একটু দেবে আঙ্কল। আমি বাবাকে কল করব?
বাবা বলল, রান্নাঘরের দিকের ব্যালকনিতে একটা ঝুড়ি আছে। তুই ওই ঝুড়িটা এনে পাখিটাকে তুলে দিতে বল সিকিউরিটি আঙ্কেলকে। ওকে ফোনটা দে, আমি বলে দিচ্ছি। আমি তো একটু পরেই লাঞ্চে বাড়ি আসব। তখন দেখছি কী করা যায়।
তাই করা হল। অন্য হাঁসটা প্রথমে তেড়ে এসেছিল, তারপর উড়ে গিয়ে একতলার ফ্ল্যাটের বারান্দার রেলিংয়ে বসল।
....
মজার ব্যাপার হল সন্ধেবেলায়। বাড়িতে ঢুকে হাঁসটাকে ছেড়ে দিয়েছিল তিতলি। উড়তে পারছিল না ও, টুকটুক করে হেঁটে ঘরের মধ্যে ঘুরতে লাগল। ঘর ছেড়ে বারান্দা, আবার এঘর-ওঘর। অন্য হাঁসটাও এসে তিতলির বারান্দাতে বসে রইল।
সব্জির টুকরো, ফলের কুচি, ভুট্টার দানা, ভাত, মাছ সবই খেল পাখি দুটো।
বাবা বলল, মনে হচ্ছে এরাও মাইগ্রেটরি বার্ড। কিন্তু দেখ, দুটো দু’রকম। কী নাম জানতে পারলে ভালো হতো।
—রীতেনমামাকে ছবি পাঠাও না বাবা।
—ঠিক বলেছিস। রীতেনকে পাঠাই।
—রীতেন রায়গঞ্জ গেছে। কুলিক পাখিরালয়। সারা শীতকাল ও পাখি দেখে বেড়ায়। তবে, ছবি পাঠিয়ে দিই। আর ফেসবুকেও দিয়ে দেখি। কেউ বলতে পারে কি না।
ছবি পেয়ে রীতেনমামা উচ্ছ্বসিত। এ পাখি নাকি সচরাচর ভারতে আসে না। তুন্দ্রা বিন গুজ বা হাঁস। ভিডিও-কলে পাখি দেখতে চাইল।
....
একলা একটা তুন্দ্রা বিন গুজ। রাশিয়ান প্রজাতির হাঁস, তবে পাখিটা মূলত মঙ্গোলিয়ার। অন্য পাখির ঝাঁকের সঙ্গে কোনওভাবে চলে এসেছে এখানে। আসলে পথ হারিয়ে
ফেলেছে ও।
এই হাঁসের বৈশিষ্ট্য হল কালো ঠোঁট এবং ঠোঁটের মাঝে একটি কমলা দাগ। কালচে শরীর, যা বাকি হাঁসদের থেকে আলাদা। বাদামি ও ধূসর পালক, মাঝখানে কমলা ব্যান্ড। পালকের সরু সাদা ঝালর। কণ্ঠস্বর হল একটি উচ্চস্বরে হর্নিং, ছোট প্রজাতির মধ্যে উচ্চতর পিচ। খাদ্য জলাশয়ের উদ্ভিদ।
অন্য হাঁসটার নাম ল্যাঞ্জা হাঁস। নর্দার্ন পিনটেল বা উত্তরের ল্যাঞ্জা হাঁস। এটাও সাইবেরিয়ার পাখি, বড় ঝাঁকে উড়ে আসে। হয়তো এদের দলেই কোনওভাবে এই একলা তুন্দ্রা বিন হাঁসটা চলে এসেছে।
ফেসবুকেও সাড়া পড়ে গিয়েছে। কত যে পক্ষীপ্রেমী। সবাই চাইছেন, একবার এসে এই পাখি দেখতে। উত্তর সাইবেরিয়ার বাসিন্দা এই পাখি সাধারণত পরিযানে এই পথ নেয় না। ও বেচারি হারিয়ে গিয়েছে।
সেই থেকে হারিয়ে যাওয়া বেচারা তুন্দ্রা বিন হাঁস দেখতে কত যে লোক আসছে। ল্যাঞ্জা হাঁসটাকে বনদপ্তর থেকে নিয়ে গিয়েছে, ঝিলে ছেড়ে দেবে। হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানতে পেরেই এসেছিলেন তাঁরা। তুন্দ্রা বিন গুজকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, বিরল এই পাখি লেকের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠবে
এবারের শীতে।
কিন্তু ছোট্ট পাখিটা ডানা ঝাপটে উঠে এসেছে তিতলির কোলে।
ওঁরা বললেন, ও এখানেই থাক বরং। একলা পাখি, একটা সঙ্গীও নেই ওর। এই ছোট্ট মেয়েটিকেই বন্ধু ভেবে নিয়েছে ও। ওর থাকার মতো পরিবেশ করে দিন আপনারা। জল, জলজ উদ্ভিদ, জলের পোকামাকড়।
বাবা একটা বড় চীনেমাটির গামলা এনে দিয়েছে। গামলার কাছে সবুজ গাছ। মূলত জলাশয়ের উদ্ভিদ। বিরল প্রজাতির পাখি যাতে নিশ্চিন্তে কয়েকটা দিন এখানে কাটাতে পারে, তার জন্য বনদপ্তর থেকেও নিয়মিত খাবার দিয়ে যায়। তবে তুন্দ্রা বিন তিতলির হাত থেকে ভাত খেতে সবচেয়ে ভালোবাসে। পাখি আর ছোট্ট মানুষের বন্ধুত্বের খবর বেশ সাড়া
ফেলে দিয়েছে।
পাশের বিল্ডিংয়ের সুদীপ আঙ্কল নিজের খবরের কাগজে এই খবর করেছেন, তিতলির সঙ্গে তুন্দ্রা বিন গুজের ছবি দিয়ে। টেলিভিশন চ্যানেল থেকেও এসেছিল, দুই বন্ধুর ছবি দেখিয়েছে নানা চ্যানেলে।
আস্তে আস্তে হাঁসের ডানা সেরে গেল। একটু একটু উড়তে চেষ্টা করত। বারান্দার রেলিং অবধি উঠে, আবার টুক করে নেমে আসত।
এমনি করে সারা শীতকাল কেটে গেল। আজকাল আবার দলে দলে হাঁস উড়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। এবার ওরা উল্টোদিকে উড়ে যাচ্ছে। পাখিদের ঝাঁক দেখলেই তুন্দ্রা বিন হাঁস চঞ্চল হয়ে উঠছে।
তিতলি নিজে নিজেই বুঝেছে, এবার বন্ধুকে ছেড়ে দিতে হবে।
তারপর একদিন একটা হাঁসের দল উড়ে যাবার সময় মজার কাণ্ড। ঝাঁক থেকে একটা হাঁস বারান্দায় নেমে এল। ওমা, এ তো সেই ল্যাঞ্জা হাঁস! যাত্রা করার আগে তুন্দ্রা বিন হাঁসকে ডাকতে এসেছে। এটি সেই ডাকে সাড়াও দিল। তুন্দ্রা বিন গুজ উড়ে একবার তিতলির কাঁধে বসল, তারপর দুটো হাঁস একসঙ্গে উড়ে গেল। দূরে হাঁসের দলটা যতক্ষণ দেখা গেল, চেয়ে রইল তিতলি। চোখে জল এসে গিয়েছে, তবু মনে মনে বলতে লাগল, যা পাখি, উড়ে যা। নিজের দেশে ফিরে যা। আর হারিয়ে যাস না যেন।
পথ ভুলে এসেছিল, আর হয়তো কোনওদিন আসবে না ওই ছোট্ট হাঁস। কিন্তু তিতলি রোজ গামলায় টলটলে ঠান্ডা জল ভরে রাখে। আজকাল অনেক পাখি শালিখ, চড়াই, বুলবুলি, পায়রা, কাক এসে বারান্দায় জল খায়। জলের মধ্যে স্নান করে। সেটা দেখেই খুশি ছোট্ট তিতলি। বাবা বলেছে, আমাদের তিতলির এখন এক আকাশ পাখি-বন্ধু। এক আকাশ পাখি। বন্ধুপাখি। শীতকালে আবার আসবে আকাশের পথ দিয়ে পরিযায়ী পাখির দল। আর মনখারাপ হয় না তিতলির।