সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে ৫০ হাজার বছরের প্রাচীন গুহাচিত্র। আদিম মানবের শিল্পকীর্তির ইতিহাস ফিরে দেখলেন রুদ্রজিৎ পাল।
মানুষ অন্য যেকোনও প্রাণীর থেকে আলাদা। মানুষের ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতার পাশাপাশি সৃজনশীলতা আমাদের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। বিবর্তনের পথে এপ থেকে মানুষ হওয়ার প্রথম ধাপেই অনিবার্য চিহ্ন ছিল ‘প্যাক হান্টিং’ (দলবদ্ধ শিকার) ও আগুনের ব্যবহার। আর ছিল শিল্পের বিকাশ। হাতের আঙুলে একটা কিছু ধরে, যেকোনও সারফেসে দাগ কেটে কিছু একটা সৃষ্টি করা যায়, এই ভাবনার উন্মেষ কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্বের উত্তরণের পথে একটা বিরাট পদক্ষেপ।
প্রথম যুগের সেই সব আঁকিবুঁকি যদি মাটিতে বা বালির ওপর হয়ে থাকে, সেটা মিলিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হাজার বছর ধরে সেটা থেকে যাবে, যদি সেই আদিম মানুষের হাতের কাজ করা হয়ে থাকে পাথরের ওপর। কোন পাথর? সেটা এমন পাথর হতে হবে, যেটা ভবিষ্যতের মানুষের চোখের আড়ালে নিশ্চিন্তে যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির হাতে সযত্নে সুরক্ষিত থাকতে পারে। সেই পাথর হল আদিম মানুষের বাসস্থান। অর্থাৎ পাহাড়ের গুহার দেওয়াল। এককালে, নিবু নিবু কাঠের আগুনের আলোতে, বাইরের শ্বাপদ ও ঝড়ঝঞ্ঝার সঙ্গে লড়াই করেও কোনও এক পূর্বপুরুষ অব্যক্ত খেয়ালে যে রেখা এঁকে দিয়েছিল হাতের আলগোছে, সেটাই রয়ে গিয়েছে সেই পৃথিবীর টাইম ক্যাপসুল হিসেবে।
১৮৮০ সালে স্পেনের দুই গবেষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন আলতামিরার গুহায় পাওয়া কিছু চিত্রের বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু প্রথম প্রকাশের পর প্রায় কুড়ি বছর প্রশংসার বদলে নিন্দাই জুটেছিল তাঁদের কপালে। সত্যিই কী হাজার হাজার বছর আগে মানুষের হাতে আঁকা ছবি পৃথিবীতে আছে? তখনকার ইউরোপ সুন্দর শিল্পের জন্মকাল বলতে ভাবত রেনেসাঁ (নবজাগরণ) যুগকে। ফলে সেই যুগের হাজার হাজার বছর আগেও যে মনোগ্রাহী ছবি আঁকার ক্ষমতা ছিল মানুষের, সেই সত্য হজম করতে বেশ দেরি হয়েছিল পণ্ডিতদের। এমনকী সেই আবিষ্কর্তাদের জোচ্চোরও বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে সবাই নিজেদের ভুল শুধরেছেন। আলতামিরার বাইসনের ছবি এখন জগদ্বিখ্যাত।
কিন্তু এরপর ১৯০২ সালে ফ্রান্সের ল্যাসকোঁর গুহায় আবার পাওয়া গেল এরকম প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র। বোঝা যাচ্ছে যে, অ্যানাটমিক্যাল ডিটেইল (শরীরের বর্ণনা) বেশ ভালো। যদি এই কথা মনে রাখা যায় যে, এই সব ছবি কুড়ি বা তিরিশ হাজার বছরের পুরনো, তবেই সেই অনামী শিল্পীর মুন্সিয়ানা বোঝা যাবে। কুড়ি হাজার বছর পরেও সেই প্রায়ান্ধকার গুহার ভেতরের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে আঁকা ছবি এতটাই স্পষ্ট যে, প্রাণীটার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে! মানে শিল্পীর হাত যেমন ভালো, তেমন রঙের উপাদানও চোখ কপালে তোলার মতো। মানে শুধু যে শিল্পবোধ ছিল, তাই নয়। তার সঙ্গে রঙের রসায়নের যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও তৈরি হয়েছিল।
ভারতে এইরকম পুরনো গুহাচিত্রের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায়। প্রত্যেকটা ছবি দেখে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে— মানুষ প্রথম যে ছবি এঁকেছিল, সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে তার চারপাশে দেখা পশুজগৎ। অর্থাৎ, যে পশু তখনকার মানুষ হয় শিকার করত, নইলে প্রতিপালন করত। ওড়িশাতেও এরকম গুহাচিত্র অনেক পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, এদের বয়স সঠিকভাবে নির্ধারণ
করা হয়নি।
যে মহাদেশ থেকে মানুষ নামক প্রাণীর উৎপত্তি, সেই আফ্রিকায় গুহাচিত্র থাকবে না, এটা হয়? এখনও পর্যন্ত যা বৈজ্ঞানিক তথ্য, তাতে এটা প্রমাণিত যে, আফ্রিকাতেই আমাদের সবার পূর্বপ্রজন্ম শুরু হয়েছিল। সুতরাং শিল্পের প্রথম কলমের আঁচড় যে সেখানেই পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে, ব্লমবোস গুহায় পাওয়া গিয়েছে এক জ্যামিতিক নকশা। বয়স? প্রায় ৭৫ হাজার বছর! এটাই বোধহয় মানুষের হাতে তৈরি সবথেকে পুরনো নকশা। মানে, সেই মানুষ, যাকে এতদিন পণ্ডিতেরা বর্বর বা অশিক্ষিত ভেবে এসেছেন, তারাই কিন্তু বেশ জটিল নকশা রচনা করতে জানত।
কিন্তু এই ২০২৪ সালে আবার ইতিহাসের নতুন দরজা খুলে গিয়েছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের একটি গুহায় পাওয়া গিয়েছে এমন এক প্রাগৈতিহাসিক চিত্র, যার বয়স ৫০ হাজার বছরের বেশি। এই চিত্রে দেখা যাচ্ছে তিনজন মানুষ ও একটি বিশাল শুয়োর। সম্ভবত দলবদ্ধ মানুষ বুনো শুয়োর শিকার করছে। এখনও পর্যন্ত এটাই সবথেকে প্রাচীন ‘চিত্রগল্পে’র নমুনা। সুতরাং এতদিন আমরা যে পূর্বপ্রজন্মকে বর্বর বা শাখামৃগসমান ভেবে এসেছি, তাদের ইতিহাস এবার নতুন করে ভাবতে হবে। সেই অন্ধকার যুগে, বন্য পশুদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এবং সমস্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারী সামলেও যে এরকম কালজয়ী চিত্র রচনা করা যায়, সেটা তখনকার মানুষ কিন্তু করে দেখিয়েছিল।