হ য ব র ল

আলোছায়া মুখ
সঞ্জয় কর্মকার

সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরের লোধাশুলির জঙ্গলটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে তিতলি। একটু আগেই  মুষলধারায় বৃষ্টি হয়ে গেল। এখন অবশ্য জারুল রঙা মেঘ ভেদ করে শেষ বিকেলের আলো সোনার কুচির মতো ছড়িয়ে পড়েছে নদীর চরে। তিতলি দেখল, একটা বালির ঢিপির পাশে দাঁড়িয়ে ওর মা আর বিশাখা আন্টি সেলফি তুলছে। তিতলিকেও বিশাখা আন্টি বলছিল, ‘তুইও আয় না, খুব মজা হবে।’ কিন্তু ও যায়নি। আবারও তিতলির চোখ গেল দূরের জঙ্গলটার দিকে। এবার তিতলি স্পষ্ট বুঝতে পারল, দিনের আলো শেষ হতেই কেমন যেন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে লোধাশুলির জঙ্গলের চেহারাটা। এই হাতিবাড়িতে আসার সময়ও গাড়িতে বসে যে শাল-পিয়ালের জঙ্গলটাকে ওর খুব নিরীহ আর চেনা মনে হয়েছিল এখন কিন্তু তা আর মনে হচ্ছে না। বরং পাতলা অন্ধকারের চাদরে ক্রমশ ঢেকে যাওয়া গাছগুলোকে এখন ওর বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার জঙ্গলটার খুব কাছে যেতেও ইচ্ছে করছে। কিন্তু তারও তো উপায় নেই। মা ওকে চোখের আড়ালে যেতেই দেয় না কখনও। এবার তিতলি মাকে লক্ষ করে এগিয়ে যায়। নদীর চরে কত ছোট ছোট নুড়ি পড়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে দু-চারটে  নুড়ি কুড়িয়ে নেয় তিতলি।
‘মা, আর কত দেরি করবে? চল, এবার আমরা হোটেলে ফিরে যাই। বাবা আর তমাল আঙ্কেল এতক্ষণে চলে এসেছে নিশ্চয়ই। আমরা তো সেই কখন...’
মেয়ের কথাটা শেষ না হতেই তিতলির মা শ্রীপর্ণা বলে উঠল, ‘ইস, টাইমটা খেয়ালই করিনি রে! শিগগির চল। আর লেট করা যাবে না। গিয়ে তো আবার তোর সুবিনয় জেঠুর বাড়িতেও একবার যেতে হবে।’
হোটেলের তেত্রিশ নম্বর রুমে একটা সোফায় বেশ চিন্তিত মুখে বসে আছে তিতলি। মাঝে মাঝে হোটেলের ব্যালকনিতে গিয়েও থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকছে কিছুক্ষণ। নাহ, রাত আটটা বেজে গেল, বাবা এখনও ফেরেনি। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথাই নয়। সামনেই  হাতিবাড়ি মার্কেটে যাওয়ার কথা বলে বাবা আর তমাল আঙ্কেল সেই কোন  বিকেলে বেরিয়েছিল। যাওয়ার সময় বাবা বলে গেল, ‘সুবিনয়দার বাড়িতে এই প্রথমবার যাচ্ছি। খালি হাতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। একটা গিফ্ট কিনে আধঘণ্টার মধ্যেই হোটেলে ফিরছি। তারপরই সুবিনয়দার বাড়িতে আমরা সবাই মিলে যাব। তোমরা রেডি থেকো।!’ অথচ তমাল আঙ্কেল কিছুক্ষণ পর হোটেলে ফিরে এলেও বাবা এখনও ফিরল না!
এখন বারবার সুবিনয় জেঠুর কথাটা মনে পড়ছে তিতলির। আজ দুপুরে এখানে আসার পরই জেঠু সতর্ক করে বলে দিয়েছিল, ‘বেশি রাত পর্যন্ত কেউ বাইরে থেকো না। বিপদ হতে পারে।’
তিতলি তখন পাশেই ছিল। তাই কৌতূহলবশেই ও জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এখানে আবার কীসের বিপদ জেঠু?’
তিতলির প্রশ্ন শুনে গলার স্বরটা বেশ গম্ভীর করে সুবিনয় জেঠু বলে, ‘এসব জায়গায় বিপদ তো হাজার রকমের আছে। অতশত তুমি আর জানতে চেয়ো না খুকি। শুধু এটুকুই শুনে রাখ, এখান থেকে একটু দূরেই  রামেশ্বর মন্দিরের গা ঘেঁষে তপোবন আর কমলাশোলের ঘন জঙ্গল। আর সেই জঙ্গল থেকেই মাঝে মাঝে বুনো হাতির দল আমাদের লোকালয়ে চলে আসে। তখন যে কী তাণ্ডব চালায় ওরা! মাঠের ফসল, দোকানপাট সব কিছু তছনছ করে দেয় একেবারে। সামনে মানুষ পেলে শুঁড় দিয়ে তুলে তক্ষুনি...’’
কথাটা আর শেষ করেনি সুবিনয় জেঠু। একটা ঢোঁক গিলে অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল তমাল আঙ্কেলের সঙ্গে।
...
কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে মা সুবিনয় জেঠুকে  বলছে, ‘আপনি নিজে একটু দেখুন দাদা। এখানে তো আমরা কখনও আসিনি। আপনার বন্ধুও না। অচেনা জায়গা। মানুষটা নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছে! এদিকে বারবার  ফোনে ওকে ট্রাই করেও পাচ্ছি না। নট রিচেবেল্ বলছে। এখন কী যে করি!’
হ্যাঁ, সত্যিই সুবিনয় জেঠু জোর না করলে এখানে ওদের আসাই হতো না। সুবিনয় জেঠু বাবার অফিসেই চাকরি করত। এই তো দু’বছর আগে রিটায়ার্ড করেছে। আগে গড়িয়াহাটে থাকত। তবে এখন তো জেঠু দেশের বাড়ি এই গোপীবল্লভপুরেই থাকে। চারদিকে শুধু শাল-পিয়ালের জঙ্গল। আর এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কিছু আদিবাসী গ্রাম। সুবিনয় জেঠুর প্রস্তাবটা শুনে বাবা রাজি হয়ে গেছিল সঙ্গে সঙ্গে।
সুবিনয় জেঠু হোটেলে চলে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। টেনশনে মুখটা শুকিয়ে গেছে জেঠুর। বারবার এদিক-ওদিক ফোন করে খোঁজখবর নিচ্ছে। মা অনর্গল কান্নাকাটি করছে দেখে জেঠু বলল, ‘আমি দু-চারটে ছেলেকে অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে নির্মাল্যকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবে। আসলে, নির্মাল্য তো বরাবর এরকমই। আমি নিশ্চিত ও কোনও একটা আদিবাসী গ্রামে গিয়ে বসে আছে। হয়তো ওদের সঙ্গে গল্পগাছায় মজে গিয়ে এদিকের কথা খেয়ালই 
নেই ওর।’
তমাল এতক্ষণ ধৈর্য রাখলেও এবার খানিকটা ঝাঁঝালো সুরেই বলল, ‘তাই বলে মানুষ এতটা বেখেয়ালি হয় কী করে! কী অদ্ভুত! আমাকে মার্কেটে একলা দাঁড় করিয়ে রেখে দিব্যি হাওয়া হয়ে গেল! তাছাড়া, আমরা যে এতগুলো মানুষ এদিকে টেনশনে অস্থির হয়ে উঠতে পারি, সেটাও কি রিয়েলাইজ করতে পারছে না ও! এখানে আসার জন্য জোর করে দেখছি ভুলই করেছি আমি। তবে এটাই শেষ বার। নির্মাল্যর মতো এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন লোকের সঙ্গে আর কক্ষণও কোনও ট্যুরে যাব না।’
তমাল কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে হোটেলের রুম থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল। তাঁর পিছু নিল সুবিনয়। তিতলি রুমের দক্ষিণ দিকের জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এখন বাইরের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে ও। এদিকটায় আলো তেমন নেই। শুধু শাল গাছের ঘন জঙ্গল। দিনের বেলায় তিতলি দেখেছিল, এই জঙ্গলের ভিতর দিয়েই সরু একটা মোরামের রাস্তা এঁকেবেঁকে  চলে গিয়েছে সামনের দিকে। হোটেলের কেয়ারটেকার বলছিল, রাস্তাটা নাকি সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে গিয়ে মিশেছে। তিতলির এখন তমাল আঙ্কেলের ওপরও  রাগ হচ্ছে খুব। বাবা না হয় বেখেয়ালি মানুষ। তাই বলে বাবার জন্য অপেক্ষা না করে তমাল আঙ্কেল কীভাবে একা ফিরে এল হোটেলে!
হঠাৎই জঙ্গলের দিকে চোখ দুটো আটকে গেল তিতলির। দুটো  ছায়ামূর্তি নড়াচড়া করছে যেন! মা এখন ঠিক পাশেই বিশাখা আন্টিদের রুমে আছে। মাকে কি ডাক দেবে ও! হ্যাঁ, ছায়ামূর্তি দুটো ক্রমশ জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। ভয়ে তিতলির গা-টা শিরশির করে উঠছে। মাকে চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও কণ্ঠার কাছে স্বরটা কেমন যেন আটকে যাচ্ছে ওর।
মাকে না বলেই তিতলি এক ছুট্টে বেরিয়ে যায় হোটেলের রুম থেকে। হোটেলের বাইরে বেরতেই তিতলি দেখল, কেয়ারটেকার লোকটাও কেমন একটা অদ্ভুত  দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জঙ্গলটার দিকে। কী দেখছে লোকটা এভাবে? তিতলি এর আগেও খেয়াল করেছে, কেয়ারটেকার লোকটা ওকে যেন ফলো করছিল। জানলার ধারে যখন ও দাঁড়িয়েছিল, তখন এই লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওদের রুমের দিকে। অথচ চোখে চোখ পড়তেই সরে যাচ্ছিল একটা দেওয়ালের আড়ালে। তিতলির সন্দেহটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে এখন। ও নিজে দেখেছে, এখানে আসার পর এই  কেয়ারটেকার লোকটাই যেচে যেচে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে আসছিল। একবার তো বাবা হোটেলের রুমে এসে সবার সামনে বলেও ফেলল, ‘শুনলাম কেয়ারটেকারটা এখানে নতুন এসেছে। লোকটার কথাবার্তা আমার কেমন যেন আনন্যাচারাল মনে হচ্ছে। তোমরা একটু অ্যালার্ট থেকো।’
বাবার কথা শুনে তখন সুবিনয় জেঠু বলে উঠেছিল, ‘অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট। আমারও তাই মনে হয়।’
লোকটা ওকে নিশ্চয়ই এখন ফলো করবে। তিতলি সামনের দিকে পা না বাড়িয়ে চট করে ফিরে এল হোটেলের করিডরে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকার পর এবার ও দ্রুত পায়ে চলে এল হোটেলের ঠিক পিছনের শাল জঙ্গলটায়। এদিকটায় অন্ধকার বেশ গাঢ়। তাই তো ছায়ামূর্তি দুটোকে ঠিক চিনতে পারছে না তিতলি। সামনে এগতে এখন বেশ ভয়ও করছে ওর। আকস্মিক থমকে দাঁড়িয়ে একটা বড় গাছের আড়াল নিল তিতলি। হ্যাঁ, ধ্বস্তাধ্বস্তিই তো চলছে এখন! কিন্তু কারওর মুখেই আর কোনও শব্দ নেই। আজ বিকেলেও  কত আনন্দ ছিল এখানে। অথচ এইটুকু সময়ের মধ্যেই একের পর এক অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে! বাবা এখনও ফেরেনি। বাবাকে ছেড়ে ও তো এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। 
‘বড্ড লোভ তোমার, তাই না? এই লোধাশুলি-ভোণ্ডুডিহি-ফুলাকেন্দু-সোনারীমারার জঙ্গল থেকে রোজ রাতে ঝাড়খণ্ড আর ওড়িশায় যত কাঠ পাচার হয় তার মাস্টারপ্ল্যানার হচ্ছ তুমি। আর এ কাজে এখানকার মহাজনদের সঙ্গেও তুমি হাত মিলিয়েছ। কিন্তু কী ভেবেছিলে? তোমার এই দুষ্কর্মের কথা কেউ, কোনওদিন জানতে পারবে না! জেনে রাখ, এই গোপীবল্লভপুরের আইসি রজত মুখোপাধ্যায় আমার স্কুলের বন্ধু। রজত এখানে পোস্টিং হয়ে এসেইছে স্রেফ কাঠ চোরাকারবারিদের ধরতে। এতদিন তোমাকে কেউ বাগে আনতে পারছিল না।  তাই তো আমার সাহায্য নিয়ে...’
এ তো বাবার গলার স্বর! কিন্তু কাকে বলছে বাবা কথাগুলো! 
মুহূর্ত দেরি না করে এবার গাছের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে তিতলি বলে ওঠে, ‘কী হয়েছে বাবা? তুমি এখানে!’
‘সব বলব তোকে। এখন এটুকুই জেনে রাখ, তুই যাদের আদর করে ছায়াবন্ধু বলিস, স্রেফ টাকার জন্য সেই গাছগুলোকে এই একটা লোক নিজের হাতে ধ্বংস করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কিন্তু আজকের পর...’
নিকষ অন্ধকার ভেদ করে আকস্মিক পিছন দিক থেকে আসা একটা জোরালো টর্চের আলো পড়তেই  তিতলি কেঁপে ওঠে। ওই তো হোটেলের কেয়ারটেকার লোকটা। আর তার ঠিক পাশে! এ তো সুবিনয় জেঠু! বাবা পিছমোড়া করে ধরে রেখেছে  সুবিনয় জেঠুকে। তার মানে বাবা কথাগুলো এতক্ষণ সুবিনয় জেঠুকে বলছিল! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তিতলির। ইস্, সুবিনয় জেঠু তাহলে ওর ছায়াবন্ধুদের এইভাবে শেষ করে দিচ্ছে! তিতলির চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। কেয়ারটেকার লোকটা হঠাৎই এগিয়ে এসে তিতলির মাথায় আলতোভাবে একটা হাত রাখে। 
‘আর একটা কথা শোন তিতলি, আমি তো ইচ্ছে করেই এতক্ষণ গায়েব হয়ে ছিলাম। তা না হলে তো...’
‘বাকিটা না হয় পরে বোলো নির্মাল্য। এখন বড্ড খিদে পেয়েছে। শিগগির খেতে চল।’ তিতলি দেখল, ওর ঠিক পিছনেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তমাল আঙ্কেল। সঙ্গে কয়েকজন পুলিসও।
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মস্থলে জটিলকর্মে অনায়াস সাফল্য ও প্রশংসালাভ। আর্থিক দিকটি শুভ। ক্রীড়াস্থলে বিশেষ সাফল্য।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১০ টাকা৮৪.৮৪ টাকা
পাউন্ড১০৮.৬৪ টাকা১১২.১৯ টাকা
ইউরো৯১.৫৩ টাকা৯৪.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
14th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা