বিশেষ নিবন্ধ

দোষ ঢাকতেই সংগঠনের দোহাই বিজেপির
তন্ময় মল্লিক

‘সিবিআই, ইডি দেখিয়ে বা কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোটে জেতা যায় না। ভোটে জিততে গেলে সংগঠন মজবুত করাই একমাত্র রাস্তা।’— সুকান্ত মজুমদার।
‘আমরা সংগঠন করতে জানি। আমরা আন্দোলন জানি। কিন্তু ভোট করাতে জানি না।’—দিলীপ ঘোষ।
‘ভারত মাতা কি জয় বলে স্লোগান দিতে জানে। মিছিল করতে পারে। কিন্তু বিজেপি ভোট করাতে পারে না। আগে সংগঠন করতে হবে, তারপরে তো তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই।’—অর্জুন সিং।
এঁরা প্রত্যেকেই রাজ্যের অতি পরিচিত মুখ। বিজেপি নেতা। তাঁদের এইসব মন্তব্য আসলে চব্বিশের নির্বাচনে দলের ধরাশায়ী হওয়ার সাফাই। তাঁদের দাবি, বাংলার মানুষ বিজেপিকে চায়। কেবল সংগঠন নেই বলে তাঁরা হারছেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নাকি তাঁরা সংগঠনের ঘাড়ে দায়টা চাপিয়ে আসল সত্যিটা আড়াল করতে চাইছেন! 
কেন উঠছে একথা? ২০১৯ সালে বাংলায় বিজেপির সংগঠন বলে কিছুই ছিল না। তা সত্ত্বেও বিজেপি এরাজ্যে ১৮টি আসন জিতেছিল। উনিশের তুলনায় চব্বিশে বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা অনেক বেশি। সংগঠনও কিঞ্চিৎ বেড়েছে। তারপরেও আসন কমেছে ৩৩ শতাংশ। নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে সংগঠন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সব নয়। সেটা যদি হতো তাহলে সিপিএমকে বাংলা থেকে কেউ সরাতে পারত না। 
বাম আমলে এ রাজ্যে অনেক অত্যাচার, অবিচার হয়েছে। তারপরেও তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে চাষিদের জমি জোর করে কেড়ে নিতে যাওয়াই তাদের কাল হয়েছিল। মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে চাওয়ার জবাব বাংলার মানুষ সিপিএমকে দিয়েছিল। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারও এ রাজ্যের গরিবের পেটে লাথি মারছে। হাজার অনুরোধেও ন্যায্য প্রাপ্য মেটাচ্ছে না। উল্টে আরও কতভাবে বাংলাকে বঞ্চিত করা যায়, তার ফন্দি এঁটে চলেছে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি তার ‘উচিত শিক্ষা’ পেয়েছে। 
কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে বাজেট, সব ক্ষেত্রেই বাংলাকে ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত করে চলেছে বিজেপি। দিল্লি বিজেপি বাংলার মানুষের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে গরিবের মাথার উপর ছাদ। মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অথচ রাজ্যের কোনও বিজেপি নেতা স্বীকার করেননি, ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে দেওয়াটা তাদের ভুল হয়েছিল। কেউ একবারও বলছেন না, তালিকা তৈরি করিয়েও আবাস যোজনার টাকা আটকে দেওয়াটা অন্যায়।
বঞ্চনা ও অত্যাচারের জবাব বাংলা সবসময় ব্যালটেই দেয়। এটা দিল্লির বিজেপি নেতারা না জানতেই পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ পড়ে বড় হওয়া বঙ্গ বিজেপির নেতাদের না জানার কথা নয়। তবুও তাঁরা দিল্লিকে কিছু বলেননি। উল্টে ‘গুড বুকে’ থাকার লোভে কেন্দ্রের প্রতিহিংসার রাজনীতির আগুনে ঘি ঢেলেই চলেছেন। এমনকী, বাজেটে বাংলাকে কিছু না দেওয়াকেই সমর্থন করেছে। বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পল প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কেন বাংলাকে বিশেষ প্যাকেজ দেবে?’ এসব বলে অগ্নিমিত্রা হয়তো রাজ্য সভাপতির দৌড়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেন, কিন্তু বাংলার মানুষ কি এটা ভালো চোখে দেখবে?
লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বাংলার উন্নয়নে বিশেষ নজর দেবেন বলেছিলেন। গুজরাতের চেয়ে বাংলায় ভালো ফল আশা করেছিলেন। কিন্তু বাংলা নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে। মোদিজি ফের বুঝলেন, মমতাকে হারানোর হিম্মত তাঁরও নেই। তাই এবারও একুশের স্টাইলে বাংলাকে ‘শিক্ষা’ দিতে নেমে পড়েছেন। কিন্তু তিনি কেন বুঝতে চাইছেন না, চাপ দিয়ে বাপ বলানো অন্য রাজ্যের জন্য মোক্ষম কৌশল হতে পারে, কিন্তু বাংলায় তা খাটবে না। 
এটা নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার সরকারের প্রথম বাজেট। সিংহাসন বাঁচাতে সিংহভাগ টাকাই ‘পাল্টুরাম’ নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুকে খুশি করতে চলে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর দলের ১২জন জিতলেও বঙ্গের জন্য ভাষণ ছাড়া কিছুই নেই। তারজন্য মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বাংলার মানুষ। বাজেটের পরই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুকান্তবাবুর আধ ঘণ্টার বৈঠক। তিনি বাংলার জন্য বিশেষ কিছু আদায় করতে পারলে এই বৈঠকই হতো ঐতিহাসিক। কিন্তু বৈঠকে তাঁর দাবি কী ছিল? উন্নয়নের স্বার্থে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরবঙ্গকে যুক্ত করতে হবে।
বিষয়টি সামনে আসামাত্র প্রশ্ন উঠেছে, ফের কি শুরু হল বাংলাভাগের চক্রান্ত? উন্নয়ন উদ্দেশ্য হলে তিনি তো বাংলার জন্য বিশেষ প্যাকেজই দাবি করতেন। উত্তরবঙ্গ এবারও বিজেপিকে উজাড় করে দিয়েছে। বিহারের মতো উত্তরবঙ্গের বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্যাকেজও তিনি দাবি করতে পারতেন। এমনকী, ১২জন সাংসদের জন্য বাংলায় দু’জনকেই ‘হাফ মন্ত্রী’ না করে একজনকে পূর্ণমন্ত্রী করার দাবিও জানাতে পারতেন। তবুও মানুষ জানত, নিজেদের স্বার্থে হলেও তিনি অন্তত বাংলার হয়ে বলার সাহস দেখিয়েছেন। কিন্তু তা না করে বাংলা ভাঙার আশঙ্কা উস্কে দিলেন।
বিভাজনের রাজনীতি করার জন্যই বাংলায় ধরাশায়ী হচ্ছে বিজেপি। তাতে কর্মীদের হতাশা বাড়ছে। তাঁদের উজ্জীবিত করতে নেওয়া হচ্ছে নানান কৌশল। কেউ কেউ এব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত তুলে ধরছেন। বলছেন, একটা সময় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা এক হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে তৃণমূল আজ রাজ্যের শাসক দল। তাহলে আমরা পারব না কেন? 
ভোকাল টনিক হিসেবে এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। তবে বিজেপি নেতারা ভুলে যাচ্ছেন, এক থেকে একশো হওয়ার রেসিপিটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন। তিনি যখনই ক্ষমতা পেয়েছেন তখনই বাংলার জন্য কাজ করেছেন। রেলমন্ত্রী হয়েই যুগ যুগ ধরে বাংলাকে বঞ্চিত করে রাখার যন্ত্রণা সুদেআসলে উসুল করে নিয়েছিলেন। বাংলাকে দিয়েছিলেন একের পর এক রেল প্রকল্প। চালু করেছিলেন নতুন নতুন ট্রেন ও রেলপথ। তিনি রেলমন্ত্রী না হলে বাংলার বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থান আজও রেল মানচিত্রের বাইরেই থেকে যেত। পেট্রল, ডিজেলের অগ্নিমূল্যের আঁচে বাংলার বহু পর্যটন কেন্দ্র  হয়ে যেত পর্যটকশূন্য।
উনিশে বঙ্গবাসী প্রায় অর্ধেক আসনে বিজেপিকে জিতিয়েছিল। তার বিনিময়ে কী পেয়েছে? শুধুই হুঙ্কার। টাকা আটকে দেওয়ার হুঙ্কার, জেলে ভরে দেওয়ার হুঙ্কার। করেছেও। মানুষ কি তাঁদের এইজন্যই নির্বাচিত করেছিল, নাকি দিল্লি পাঠিয়েছিল এলাকার সমস্যা সমাধানের জন্য! কিন্তু ক’জন বিজেপি সাংসদ নিজের এলাকার জন্য বিশেষ কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্প আনতে পেরেছেন? নতুন প্রকল্প তো দূরের কথা, অধিকাংশ সাংসদ তাঁদের এমপি ল্যাডের টাকাই খরচ করতে পারেননি। 
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুম করে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাননি। রেলমন্ত্রী হিসেবে কাজ করে মানুষের মনে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে একটা ছাপ ফেলেছিলেন। তারজন্যই বাংলার মানুষ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। মানুষ বুঝেছিল, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হলে বামেদের ‘চলছে না, চলবে না’ রাজনীতি থেকে মিলবে মুক্তি। সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলেই একবার নয়, দু’বার নয়, তিন তিনবার তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। 
প্রথমবার তিনি সিপিএমের ‘নেগেটিভ’ ভোটের দৌলতে ক্ষমতায় এলেও পরের প্রতিটি নির্বাচন জিতেছেন কাজের জোরে। বাংলার গরিবরা জেনে গিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন ততদিন তাঁদের না খেয়ে থাকতে হবে না। মানুষের এই বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন। তাই বিরোধীরা তাঁকে যতই হেলাফেলা করুক না কেন বাস্তবটা হল, তিনিই দেশের একমাত্র হ্যাটট্রিক করা মহিলা মুখ্যমন্ত্রী।
সুকান্তবাবুর কথায়, ‘ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সংগঠন দানা বাঁধে।’ একেবারে হক কথা বলেছেন। কিন্তু এবার আসন সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। তা সত্ত্বেও বাংলার তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মধ্যে দু’জনই হেরে গেলেন কেন? তাঁরা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তাঁদের এলাকায় সংগঠন জমাট বাঁধল না কেন?
নির্বাচনে জেতার ক্ষেত্রে সংগঠন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শেষ কথা নয়। তারজন্য কিছু ভালো কাজের নমুনা মানুষের সামনে রাখতে হয়। বিজেপি শক্তিশালী হলে বা ক্ষমতায় এলে মানুষের ভালো হবে, এই বিশ্বাস অর্জন করাটা ছিল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিজেপি বাংলায় সেটা তৈরি করতে পারেনি। উল্টে সবসময় কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে টাইট দেওয়ার প্যাঁচ কষেছে। তার মোক্ষম জবাব দিচ্ছে বাংলা। সুকান্তবাবু, সংগঠনকে কাঠগড়ায় তুলে আপনারা নিজেদের দোষ ঢাকতে চাইছেন। কিন্তু বালিতে মুখ গুঁজে কি প্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়?
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা