নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি ও কলকাতা: এক মাস অতিক্রান্ত। প্রথমে কলকাতা পুলিস, তারপর সিবিআই। প্রতিদিন তদন্তের গতি আরও শ্লথ হয়েছে। নারী সুরক্ষার দাবিতে শুরু হওয়া স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের মঞ্চে এখন রাজনীতির আনাগোনা। আর জি করে নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের স্লোগান এখন পিছনের সারিতে। আন্দোলনের সৎ অভিমুখে থাবা বসিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ, ক্ষমতার লোভ। তার মাশুল কাকে গুনতে হচ্ছে? সত্যিকারের বিচারপ্রার্থী এবং সাধারণ মানুষকে। প্রথম পক্ষ বিচার চেয়ে এবং বিচারের অপেক্ষায় অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আর দ্বিতীয় পক্ষ, অর্থাৎ গরিব মানুষ ভোগ করছে বিনা চিকিৎসার যন্ত্রণা। জাস্টিসের লক্ষ্যে কর্মবিরতিতে এখনও অনড় জুনিয়র ডাক্তাররা। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে অসহায়ের কান্না। সরকারি হিসেব বলছে, এই এক মাসে রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি অস্ত্রোপচার বাতিল হয়েছে এবং মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পৌঁছনোর পরও বিনা চিকিৎসায় অন্তত ২০ জনের এই এক মাসে মৃত্যু হয়েছে। মুর্শিদাবাদের পিয়ারুল শেখ, মালদহের সদ্যোজাত কন্যা, দেগঙ্গার সঙ্গীতা আচার্য, কলকাতার ছন্দা দেবী কিংবা মিনতি বিশ্বাসের বাড়ির লোকের চোখের জল এখনও শুকায়নি। অথচ, তালিকা বাড়ছে। রোজ।
লালবাজার সূত্রে প্রথম থেকেই বলা হয়েছে, স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের আড়ালে শহুরে নকশালদের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ইন্ধন সেখানেই শেষ হয়নি। গত দু’সপ্তাহে এই আন্দোলনের মুখে কালি মাখাতে প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাম ও বিজেপির। এই অবস্থান যে দিল্লির শাসকের পক্ষেও খুব সুবিধাজনক হয়নি, তার প্রমাণ মিলছে এখন। কারণ, খোদ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফ থেকে বঙ্গ বিজেপির নেতাদের কাছে বার্তা এসে গিয়েছে, রাজ্য সরকারের বিরোধিতা চলতে পারে। কিন্তু ডাক্তারদের কর্মবিরতিকে সমর্থন করা যাবে না। এতে সাধারণ মানুষ খেপে উঠছে। রাজ্যের বিরাট সংখ্যক আম জনতার মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠছে—রাজনীতির জন্যই অভয়ার বিচার পেতে দেরি হচ্ছে। আর তার ফল ভুগতে হচ্ছে মানুষকে।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনে হয়েছে, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেলেও ডাক্তারদের কর্মবিরতি ও চিকিৎসা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জোগানো যাবে না। এই ইস্যুতে তাঁদের তরফ থেকে বিরক্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। বঙ্গ বিজেপির কাছে স্পষ্ট বার্তা এসেছে, রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে হবে। কিন্তু তার জন্য কোনওভাবেই দলের গায়ে যেন গরিব-বিরোধী স্ট্যাম্প না পড়ে যায়। সরাসরি কোনও নেতা-নেত্রী চিকিৎসা ধর্মঘটকে সমর্থন করলে, তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নেওয়ার বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যভবন সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুধু আর জি করে ১ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সিটি স্ক্যান হয়েছিল ৩ হাজার ৭০০টি, ডিজিটাল এক্স-রে ৮ হাজার ৪০০ এবং এমআরই ১ হাজার ৬৭৪টি। সেখানে ৯ আগস্ট থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত ওই তিনটি পরীক্ষা আর জি করে হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৩৫৭, ২ হাজার ৮৬৬ এবং ৫৯৬টি। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, মাসের পর মাস এমআরআই বা এক্স-রে’র জন্য হত্যে দিয়ে থাকা মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে পরিষেবায়। সিনিয়র ডাক্তাররা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু গোটা রাজ্য থেকে আর জি কর সহ প্রধান পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজে এসে ভিড় করা বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এই অবস্থায় গরিব, প্রান্তিক মানুষ এক বুক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে সুপ্রিম কোর্টের দিকে। আগামী কাল, সোমবার আর জি কর মামলার শুনানি রয়েছে শীর্ষ আদালতে। যদি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ চিকিৎসা কর্মবিরতি নিয়ে কোনও নির্দেশিকা জারি করে। এর আগে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের আবেদন মেনে গোটা দেশেই ডাক্তারদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার হয়েছে। সর্বত্রই ডাক্তাররা প্রতিবাদ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজেও যোগ দিয়েছেন। ব্যতিক্রম শুধু কলকাতা। এবার সুপ্রিম কোর্ট যদি নির্দেশিকা জারি করে, পরিস্থিতি বদলাতে পারে। সেই দিকে তাকিয়ে আছে বিজেপি নেতৃত্ব। কারণ, সেই মতো তাদের স্ট্র্যাটেজি স্থির হবে। ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে নারী নিরাপত্তায় টাস্ক ফোর্স সহ একাধিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। এই ইস্যুতে রূপরেখা তৈরিতে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনাতেও বসতে হবে তাদের। কর্মবিরতি যদি জারি থাকে এবং তাতে বঙ্গ বিজেপি সমর্থন জুগিয়ে যায়, কেন্দ্রের পরিকল্পনাই মাঠে মারা যাবে।