বিশেষ নিবন্ধ

বঙ্গবঞ্চনা থেকে বঙ্গভঙ্গ: আপনার প্ল্যান কী? 
সমৃদ্ধ দত্ত

২৬ এপ্রিল মালদহে নির্বাচনী জনসভায় আপনি জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনাদের এই উপচে পড়া ভালোবাসা দেখে আমার মনে হচ্ছে, আগের জন্মে আমি নিশ্চয়ই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলাম। অথবা আগামী জন্মে আমার জন্ম হবে এই বাংলায়। 
আপনি আরও বলেছিলেন, আপনারা এত বিশাল সংখ্যায় আজ এসেছেন। অথচ এই মাঠ সেই তুলনায় ছোট হয়ে গিয়েছে। আপনাদের অসুবিধার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই ভালোবাসার বিনিময়ে আমার আপনাদের প্রতি ভালোবাসা অসীম উন্নয়নের মাধ্যমে আপনাদের নিশ্চিত ফেরত দেব। 
২৮ মে উত্তর কলকাতায় রোড শো করার পর আপনি বলেছিলেন, মায়ের বাড়ি, রামকৃষ্ণ মঠ, বাগবাজারে যেতে পেরে অত্যন্ত ধন্য মনে হচ্ছে। এই সেই স্থান যেখানে পবিত্র মা সারদা দেবী কয়েকবছর অতিবাহিত করেছেন, (অবশ্য ‘কয়েক বছর’ মানে কী আমরা জানি না। এখানে শ্রীমা সারদা দেবী ১৯০৯ সাল থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বাস করেছেন)। নেতাজির পায়ে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করার ছবি দিয়ে আপনি বলেছিলেন, কলকাতা আজ আমার মন জয় করে নিয়েছে। আজকের রোড শো আজীবন আমার স্মৃতিতে থেকে যাবে। 
আপনি এসব কথা মাত্র সাতদিনেই ভুলে গেলেন? ২৮ মে বলেছিলেন। আর ভোটের ফলপ্রকাশ হয়েছিল ৪ জুন। না ভুলে গেলে ২৩ জুলাই  আপনার সরকারের বাজেটে সেই বাংলার অসীম ভালোবাসা, সেই আজীবন মনে রাখার প্রতিজ্ঞা, সেই পরজন্মে বাংলায় জন্মগ্রহণের ইচ্ছাপ্রকাশ এসব কথার কোনও প্রতিফলন দেখা গেল না কেন? 
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে গোটা দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সবথেকে বেশি টাকা কোন রাজ্যবাসী তুলে দেয় ভারত সরকারের ডাকবিভাগকে? বাংলা। অর্থাৎ গোটা দেশে যত মাসিক আয় প্রকল্প, কিষান বিকাশ পত্র, ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট, সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা, পাবলিক প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি তাবৎ ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে যত টাকা গোটা দেশ থেকে ভারত সরকার পায়, তার সর্বোচ্চ আসে বাংলা থেকে। 
গোটা দেশে নেট ডাইরেক্ট ট্যাক্স অর্থাৎ মোট প্রত্যক্ষ কর যে রাজ্যগুলি থেকে সবথেকে বেশি আদায় করা হয়, সেই সর্বোচ্চ ট্যাক্সদাতা ১০ টি রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ উপরের সারিতে। সর্বোচ্চ জিএসটি কোন কোন রাজ্যগুলি থেকে পাওয়া যায়? প্রথম আটের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ। 
দেশের সবথেকে বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কোথায় আছে? উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে। আপনি বলেছিলেন, আপনার প্রতি বাংলার মানুষের ভালোবাসা আপনি ফিরিয়ে দেবেন উন্নয়নের মাধ্যমে। উন্নয়ন কীভাবে প্ল্যান করা হয়? বাজেটে। বাজেটে বাংলা কী পেল? বাংলা শেষ কবে কোনও মেগা প্রকল্প উপহার পেয়েছে? পায়নি। ধরা যাক, ৫০ হাজার কোটি টাকার কোনও একটি প্রকল্প। কবে বাংলায় এসেছে? আসেনি। অথচ এই অঙ্কের প্রকল্প বাকি রাজ্যগুলিতে যখন তখন ভোট ছাড়াই ঘোষণা করা হয়ে থাকে। 
১২ মে বারাকপুরের মঞ্চ থেকে আপনি পাঁচটি গ্যারান্টি দিয়েছিলেন বাংলার মানুষকে। ১) ধর্মের ভিত্তিতে কোনও সংরক্ষণ হবে না ২) তফসিলি এবং ওবিসিদের সংরক্ষণ বজায় থাকবে ৩) রামনবমীর উৎসবে কেউ বাধা দিতে পারবে না ৪) সুপ্রিম কোর্টের রামনবমী নিয়ে রায় কেউ অমান্য করতে পারবে না এবং ৫) সিএএ কেউ অমান্য করতে পারবে না। ভালো করে আজ একবার মনে করে দেখুন। বাংলার মানুষকে বড় মাপের নির্বোধ মনে করা না হলে একটি রাজ্যে এসে একজন প্রধানমন্ত্রী এই কথাগুলোকে তাঁর নিজের গ্যারান্টি হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন? এই গ্যারান্টিগুলোর অর্থ কী? এগুলো কে না জানে? প্রথম দুটি তো সংবিধানের গ্যারান্টি। আপনি কে গ্যারান্টি দেওয়ার? রামনবমীর উৎসব বাংলায় বিজেপির জন্মগ্রহণের কয়েকশ বছর আগে থেকে হয়। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই। আপনার দলের হাওড়া শাখার কাছে খোঁজ নিয়ে দেখুন যে, রামরাজাতলা নামক জায়গাটির জমিদার কে ছিলেন। অযোধ্যারাম চৌধুরী। তিনি কোন পুজো শুরু করেছিলেন ৩০০ বছর আগে? রামপুজো। কবে থেকে? রামনবমীর দিন থেকে একমাস ধরে। বাকি রাঢ়বঙ্গের রাম উৎসবের প্রাচীনত্ব তো আছেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করতে যাবে কে? রামমন্দির তো সকলে মেনে নিয়েছে। সুতরাং এসব কথা নিছক যে গ্যালারি শোয়ের হাততালিবান্ধব সংলাপ এসব বাঙালি বোঝেনি ভাবেন? 
বাংলায় পরাজিত হওয়ার পর হয়তো প্রচণ্ড রাগ হয়েছে আপনার। সেটা হতেই পারে। এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২৮ মে আপনি বলেছিলেন, বাংলাই এবার বিজেপির জন্য বেস্ট পারফর্মিং স্টেট হতে চলেছে। সবথেকে ভালো ফল আসবে বাংলা থেকে। সেটা হয়নি। বরং অনেক আসন কমে গিয়েছে এই রাজ্যে। ভোটে হারজিত আছে। তাই বলে কি বাংলা নামক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যকে বঞ্চিত করা হবে উন্নয়ন থেকে?
সবথেকে বিস্ময়কর হল, বাংলার বিপুল সংখ্যক মানুষ আপনাদের ভোট দিয়েছে। ৩৮ শতাংশ ভোট পাওয়া সোজা কথা নয়। আপনার সভায় যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে জলে অপেক্ষা করেছে আপনার ভাষণ শুনবে বলে, রোড শোতে মিছিল করেছে, দূর দূরান্ত থেকে বাস ট্রেন ম্যাটাডোর লরিতে চেপে এসেছে নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে, তারপর ভোট দিয়েছে আপনার দলের প্রতীকে। তারা কী পেল? বাজেটে বাংলাকে এই যে কিছুই দেওয়া হল না, এর অর্থ হল, তারাও বঞ্চিত হল। আপনাকে ভোট দিয়েও। অর্থাৎ যারা আপনাকে ভোট দেয়নি, তারাও সাজা পেল। যারা দিয়েছে, তাদেরও ভাগ্যে কিছু নেই। 
বছরের পর বছর যারা আপনার দলকে ভোট দিয়ে আসছে, তাদের কথা ভেবেও তো কিছু কিছু উপহার দেওয়া যেতে পারত। এই যে, যেমন বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশকে লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ প্রকল্প দেওয়া হল, ওই রাজ্যে সবাই বিজেপি সমর্থক এমন তো নয়। বিজেপি বিরোধী ভোটাররাও ওইসব প্রকল্পের সুবিধা পাবে। 
সেরকমই বাংলায় কেন্দ্রীয় সরকার কোনও একটি প্রকল্প রূপায়ণ করলে অথবা আর্থিক প্যাকেজ দিলে কিংবা পরিষেবা বৃদ্ধি করা হলে, সেই সুবিধা সকলেই পেত। রাস্তা হলে সেই রাস্তায় সব দলের ভোটারই হাঁটে। ট্রেন দিলে সব দলের ভোটারই চড়ে। বন্যা অথবা সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলে শুধুই কি তৃণমূল সমর্থক থাকে নাকি? বিজেপি সমর্থকও থাকে। বিহার, অসম বন্যা মোকাবিলায় প্যাকেজ পেল। বাংলা পেল না। ঘাটাল, উদয়নারায়ণপুর, আরামবাগ, মালদহের বন্যাপ্রবণ এলাকার বিজেপি সমর্থকরা কী দোষ করল? ভোট দিয়েও উপহার পেল না? বন্যা হলে তৃণমূল ভোটারের ঘরবাড়ি সম্পত্তি ভেসে যাবে। বিজেপি ভোটারেরও একই হাল হবে। 
বঙ্গবঞ্চনাতেই তাহলে সমাপ্ত হচ্ছে না ক্ষোভের প্রকাশ? এরপর বঙ্গভঙ্গ? এতদিন দলের উত্তরবঙ্গের কয়েকজন নেতা, এমপি এমন দাবি করতেন। কিন্তু এখন সরাসরি দলের বঙ্গসভাপতিই জানিয়ে দিলেন যে, তাঁরা চান বঙ্গভঙ্গ হোক। উত্তরবঙ্গকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে, উত্তর পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। দলের সভাপতি নিশ্চয়ই জানেন যে, এই দাবির অর্থ হল, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কেই অপমান করা? কেন? ১৯৪৭ সালে কোচবিহার নামক দেশীয় রাজ্যের ভারত অন্তর্ভুক্তির পর স্থির করা হচ্ছিল সীমানা নির্ধারণ। 
অসমের রাজ্যপাল আকবর হায়দারি ২৯ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে একটি চিঠিতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখেন যে, কোচবিহারের ৬ থেকে ৭ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা মাত্র ৩০ হাজার। তাহলে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করার জন্য বাঙালি রাজনীতিবিদরা এত মরিয়া হয়ে যাচ্ছে কেন? সবথেকে ভালো সমাধান হল, কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হোক। আর একান্ত সম্ভব না হলে কোচবিহার হোক অসমের অন্তর্ভুক্ত। 
এই চিঠি পড়ে এবং হায়দারির রিপোর্ট পেয়ে  সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও একসময় ভাবছিলেন অসমেই যাওয়া উচিত কোচবিহার। কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়, উপেন্দ্রনাথ বর্মণ, অতুল্য ঘোষ এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একজোট হয়ে দলীয় মতাদর্শের দূরত্ব ভুলে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গেই রাখার জন্য নেহরু ও প্যাটেলের কাছে জোরদার চাপ দেন। আর সেটাই কার্যকর হয়। সুতরাং উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গকে একজোট রেখে পূর্ণাঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ করার সেই সাফল্যকে আজ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের মতাদর্শের উত্তরসূরিরাই ভেঙে ফেলতে উদ্যত! 
আমরা বঙ্গবাসী হিসেবে একটা কথা আজ পর্যন্ত এবং বিগত ১০ বছরেও বুঝতে পারছি না। সেটি একটি রহস্য। ক্ষুদ্র মাঝারি অথবা বড় নেতা, তাঁরা রাজনৈতিক স্বার্থে যে কোনও দাবি তুলতেই পারেন। সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এই যে বঙ্গভঙ্গের দাবি ওঠে মাঝেমধ্যেই, তারপর বাংলাজুড়ে আলোচনা, চর্চা এবং বিতর্কও শুরু হয়। এমতাবস্থায় কার একটিমাত্র মন্তব্য সব বিতর্ক থামিয়ে দিতে পারে? আপনার। অথচ আপনি কিছুই বলেন না। 
আমরা তাই আজ আপনার কাছে জানতে চাইছি যে, আপনি কি বঙ্গভঙ্গের এই প্রস্তাব এবং দাবি সমর্থন করেন? নাকি বিরোধিতা করেন? প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি একবারও এই বিষয়ে কোনও মন্তব্যই করেন না কেন? আপনি বলেন না কেন যে, কোনও অবস্থাতেই পুনরায় বঙ্গভঙ্গ হবে না, এটা আপনার গ্যারান্টি? যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি কোনও নিশ্চিত, স্পষ্ট বিবৃতি দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে সংশয় থেকে যাবে যে, এত বড় একটা বাজেটে বাংলা বঞ্চিত হল, তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দলের পক্ষ থেকেই দাবি করা হল, বঙ্গভঙ্গ করার। এসবের কারণ কী? ঠিক কী প্ল্যান আছে এই রাজ্যকে নিয়ে?
এই যে বাংলার ভোটারদের নিয়ে এত এক্সপেরিমেন্ট, বঙ্গবঞ্চনা থেকে বঙ্গভঙ্গ...শেষ পর্যন্ত বিজেপির বঙ্গবিদায়ের পথ প্রশস্ত করবে না তো? আপনার দলের ৩৮ শতাংশ ভোটারের মনেও কিন্তু এই শঙ্কা থেকে যাচ্ছে! 
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা