বিশেষ নিবন্ধ

‘তিব্বত অ্যাক্ট’ উত্তেজনার নয়া উপাদান!
মৃণালকান্তি দাস

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রাক্তন অফিসার ব্রুস রিডেল একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম ‘জেএফকে’স ফরগটেন ক্রাইসিস’। ব্রুস রিডেল সেখানে লিখেছেন, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে শত শত তিব্বতি বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণের জন্য আমেরিকার সেনা ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছিল এবং প্রশিক্ষণের পর তিব্বতে ফেরত পাঠাতে ব্যবহার করা হয়েছিল ঢাকার কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি। এই বিমান ঘাঁটি তখন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের হাতে।
১৯৫৭ সালে তিব্বতের ছ’জন গেরিলার প্রথম দলটি কুর্মিটোলা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন ঘাঁটি ‘সাইপান’ দ্বীপে উড়ে গিয়েছিল। তিব্বতের তৎকালীন শীর্ষ নেতা দলাই লামার বড়ভাই থুবতেন নোরবুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিদ্রোহীদের অন্যতম নেতা ছিলেন এই ছয় গেরিলা যোদ্ধা। রিডেল জানিয়েছেন, নোরবু সেই সময় সিআইএ নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ‘কমিটি ফর ফ্রি এশিয়ার’ সঙ্গে যুক্ত। পোল্যান্ডত্যাগী কমিউনিস্ট বিরোধীরা কুর্মিটোলা থেকে একটি বি-১৭ বোমারু বিমানে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে ভারতের উপর দিয়ে উড়ে তিব্বতে নামিয়ে দেয়। যাতে কোনও আমেরিকান গুপ্তচর ধরা না পড়েন। পাক সেনা নিয়ন্ত্রিত কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি থেকে দ্বিতীয় ফ্লাইট উড়েছিল ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে। এই সময় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বেতার সরঞ্জামও কুর্মিটোলা হয়ে বিমানে করে তিব্বতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমেরিকা তখন পেশোয়ার থেকে ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানের সাহায্যে রাশিয়া-চীনে নজরদারি এবং তিব্বত অভিযানের জন্য কুর্মিটোলা ঘাঁটি ব্যবহার করত। সব জানতেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। রিডেলের কথায়, 
তিব্বতের বিদ্রোহীদের কাছ থেকে আমেরিকার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-গোলাবারুদ পাওয়ার কথা জানতে পারলেও এর পিছনে আসলে কার হাত রয়েছে তা চীন ধরতেই পারেনি। বিস্ময়করভাবে তারা পাকিস্তান নয়, এই অপারেশনে শুধু ভারতের হাত ছিল বলে সন্দেহ করত।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ১৯৫০ সালে তিব্বতকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে যুক্ত করার পর থেকে তিব্বতের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি করে আমেরিকা ও ভারত। সিআইএ ১৯৫০ সালেই প্রথমে যোগাযোগ গড়ে তোলে দলাই লামার অগ্রজ (মেজদাদা) গিয়ালো থন্ডুপের সঙ্গে। ওই সময়ে কালিম্পং শহরে সিআইএ-র গোপন অপারেশনের ঘাঁটি স্থাপিত হয় এবং সেখান থেকেই তিব্বতে গোপন অভিযান চলত। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-ও। এক ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসার তখন কালিম্পঙের অভিবাসী গিয়ালোকে রোজ উৎসাহ দিতেন, ‘চরবৃত্তির জন্য প্রতি মাসে তিনজনকে তিব্বতে পাঠান। আমি অর্থসাহায্য করব।’ ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সের তৎকালীন ডিরেক্টর বি এন মালিক এই চরবৃত্তির বিরোধী ছিলেন। কিন্তু উপরমহলকে না জানিয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেওয়া, এই রোগ তখনই ধরে গিয়েছিল।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৬। ভারত সফরে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই। চৌয়ের অভিযোগ: ‘আপনাদের কালিম্পঙে লক্ষ লক্ষ চীনবিরোধী গুপ্তচর।’ কালিম্পঙের মতো অতটুকু শহরে লক্ষ লক্ষ চর? অভিযোগ, ১৯৫০ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিব্বতের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে হাত ছিল সিআইএ এবং ভারতের আইবির। বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নেপাল-তিব্বত সংলগ্ন মাসটাং নামে গোপন আস্তানা থেকে তিব্বতের অভ্যন্তরে পাঠানো হতো। ওই সময়ে তিব্বতে সিআইএ পরিচালিত সেন্ট সার্কাস এবং সেন্ট বারনাম নামে গোপন অভিযানে উপমহাদেশের তিনটি দেশ আমেরিকাকে সহযোগিতা করেছে— ভারত, নেপাল ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়।
আর সেই বছরই মার্চের এক রাতে লাল ফৌজের লাল চক্ষু এড়িয়ে পথে নেমে পড়েছিলেন দলাই লামা। অচেনা, অজানা রুটে। কপালে কী লেখা রয়েছে, তা না জেনেই। যাচ্ছেন কোথায়, জানা ছিল। ভারত। ভারত ভূখণ্ডে পালিয়ে আসার দু’দিন পর জানতে পেরেছিল লাল ফৌজ। তারপরেই তিব্বতে দলাই লামার খোঁজে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়েছিল তল্লাশি, অত্যাচার। বন্দুকের মুখে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে তিব্বতকে গায়ের জোরে দখলে নিয়ে এসেছিল চীন। সেটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২১ মার্চ। ততদিনে দলাই লামা ঢুকে পড়েছেন ভারত ভূখণ্ডে। ভারত তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় এপ্রিলের ৩ তারিখে। তাঁর নির্বাসিত সরকারকে জায়গা দেয় হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায়। প্রায় ৪০ হাজার তিব্বতি দলাই লামার নেতৃত্বে ভারতের ধর্মশালায় সরকার গঠন করে তিব্বতের স্বাধীনতার দাবি তোলে। যা ভালো চোখে নেয়নি চীন। ফলে দু’দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধতে বেশি সময় নেয়নি। ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এই যুদ্ধে চীন পশ্চিম রণাঙ্গনে আকসাই চীনের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি দখল করে নেয়। একইসঙ্গে তারা পূর্ব সীমান্তে অসমের পূর্ব পর্যন্ত দখল করে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। ভারতের কাছ থেকে হাতছাড়া হওয়া আকসাই চীন আজও চীনের দখলে। সেখানে দুই দেশের সীমান্তরেখা টানা হয়েছে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের (এলএসি) মাধ্যমে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে ভারতের ব্যাপক পরাজয় শুধু নেহরুর জন্যই নয়, ভারতের জন্যও মানসিক যন্ত্রণা। আজও। 
আমেরিকা নিজের অবস্থান বদলায় ১৯৭১ সালে। চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক স্থাপনের মূলে ছিল হোয়াইট হাউসের ‘এক চীন নীতি’ গ্রহণ। ১৯৭২ সালে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বৈঠক হয়। সেখানেই ‘এক চীন’ নীতিতে সমর্থন জানায় আমেরিকা। সেদিন আমেরিকাও তিব্বত ও তিব্বতের বহিরাংশকে চীনের অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমেরিকা ফের অবস্থান বদলায় ট্রাম্প জমানায়। বিশ্বশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঠেকাতে ফের মরিয়া হয়ে ওঠে ওয়াশিংটন। ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে কোয়াডের উদ্ভব এবং বৃহৎ শক্তি হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে চীনের কাছে এখন দু’টি সংবেদনশীল বিষয় রয়েছে। একটি তাইওয়ান, অপরটি তিব্বত। ১৯৭৫ সালে ভারতের সিকিম দখল এবং ভূখণ্ডটিকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পরও ভারত ও চীনের মধ্যে একধরনের অলিখিত বোঝাপড়া ছিল যে, তিব্বত এবং তিব্বতে দলাই লামার কথিত কর্তৃত্বের বিষয়টি চাপা থাকবে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক জটিলতর হয়ে উঠেছে। তাছাড়া কয়েক বছর ধরেই ভারত আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় এই উদ্যোগ গতি পায়। ভারত আমেরিকার সহযোগী হিসেবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতার ঘূর্ণিপাকে প্রবেশ করে। ইন্দো-প্যাসিফিক জোট এই অঞ্চলে একটি চীনবিরোধী সামরিক জোট। এই জোটে সাউথ ব্লক যোগ দেওয়ার পর থেকে চীন-ভারতের সম্পর্ক দ্রুতগতিতে অবনতি হতে থাকে। যার কিছু বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূর্ব লাদাখ সীমান্ত সংঘর্ষ ও পরবর্তী সময়ে দুই দেশের সীমান্তে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।
তিব্বতকে ঘিরে চীন-ভারত-আমেরিকার ভূরাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ যে জটিল এবং সংঘাতের দিকে যাচ্ছে, তা বেশ স্পষ্ট। সম্প্রতি আমেরিকার প্রাক্তন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি-সহ সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে এসে ধর্মশালায় গিয়ে দলাই লামা এবং প্রবাসী সরকারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। মার্কিন প্রতিনিধিরা তিব্বতের নেতাদের হাতে তুলে দেন গত ১২ জুন পাস করা ‘তিব্বত পলিসি অ্যান্ড সাপোর্ট অ্যাক্ট ২০২০’ (টিপিএসএ)–এর একটি কপি। ওই আইন অনুযায়ী, তিব্বতের ইতিহাস, মানুষ ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সম্পর্কে চীনের ‘মিথ্যা তথ্য’-এর মোকাবিলা করতে অর্থ সহায়তা করবে আমেরিকা। তিব্বত তাদের অংশ বলে চীন যে দাবি করে, সেই ভাষ্যের পাল্টা জবাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই আইনে। তিব্বতের নেতাদের সঙ্গে চীনের যে আলোচনা ২০১০ সাল থেকে বন্ধ হয়ে আছে, তা চালু করার জন্য বেজিংয়ের উপরে চাপ সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে, যাতে তিব্বত নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছনো যায়।  টিপিএসএ ২০২০-এর মূল বিষয় হল, ভারতের ধর্মশালায় অবস্থিত স্বাধীন তিব্বত সরকারপ্রধান ও ধর্মীয় প্রধান ১৪ তম দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন ও তিব্বতের রাজধানী লামাতে আমেরিকার কনস্যুলেট স্থাপন। চীন এখনও পর্যন্ত আমেরিকাকে সেখানে কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দেয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকার নয়া তিব্বত নীতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে ভারতের নতুন করে উত্তেজনার পথ প্রশস্ত হয়েছে। কূটনৈতিক শিবিরে চর্চা, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক পক্ষকালের মধ্যেই চীন বিরোধিতার এই মহামঞ্চ গড়লেন কেন? বিশেষত তাঁর ভিত এ বারে দুর্বল। তা হলে কি আমেরিকার প্রতি নির্ভরতা কিছুটা বাড়াতে চেয়ে এই পদক্ষেপ? নাকি গোটা অঞ্চলে চীনের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথমেই সরাসরি লড়াইয়ের বার্তা না দিয়ে, পরোক্ষ কৌশল নিলেন মোদি? কারণ, মল্লপুরম অথবা উহানের ঘরোয়া সংলাপে বেজিং-প্রীতির বলয় তৈরি করতে গিয়ে ঘা খাওয়া নরেন্দ্র মোদি জানেন যে, চীনের সঙ্গে রোমান্টিকতার জায়গা নেই। যা করতে হবে, তা নিজের শক্তি বাড়িয়ে সমমনস্ক দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। তিব্বতের তাস যদি আমেরিকা খেলে, তা ভারতের জন্য সুবিধাজনক। 
নেহরুর তৃতীয় মেয়াদে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল ভারত। মোদির তৃতীয় মেয়াদে কী তেমন কোনও সম্ভবনা রয়েছে? ইতিহাস বলে, প্রয়োজনের সময়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে আমেরিকার। অতীতে তার সাক্ষীও থেকেছে ভারত। শুধু ১৯৬২ নয়, ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমেরিকা ভারতের পাশে থাকেনি। বরং তারা পাকিস্তানকে সাহায্য করেছিল। ফলে পা মেপেই এগতে চাইবে সাউথ ব্লক!
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা