বিশেষ নিবন্ধ

কর্মসংস্থানের নামে বাজেটে শুধুই ধাপ্পা!
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

এটা কি গোটা দেশের বাজেট? যেখানে সরকার বাঁচাতে দুটো ছাড়া আর কোনও রাজ্য নিয়ে বিশেষ কোনো উল্লেখ নেই! লুক ইস্ট নীতি মানে কি শুধুই বিহার আর অন্ধ্রের উন্নয়ন? সরকারের দুই ‘ক্রাচ’ নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবুর তোষামোদিই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির অগ্রাধিকার। বেশ বোঝা যাচ্ছে, গদি বাঁচাতে মোদিজি উন্নয়ন ভুলে শরিক তুষ্টির বাধ্যবাধকতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি! নিশ্চয় মনে মনে আজ দুয়ো দিচ্ছেন নবতিপর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। 
সরকারের এই দেউলিয়া রূপটাই মঙ্গলবারের বাজেট চোখে আঙুল দিয়ে প্রকাশ করে দিল। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে গ্রাম ভারতে সবচেয়ে আসন কমেছে বিজেপির। অর্থনীতিতে সবচাইতে বড় জলন্ত ইস্যু এখন আকাশছোঁয়া বেকারত্ব। সেইসঙ্গে কৃষকের ক্ষোভ। এই দুই চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে অর্থমন্ত্রী যা করলেন তাকে এক কথায় বলা যায় প্রহসন। গালভরা আশ্বাস আছে কিন্তু কর্মসংস্থানের সুস্পষ্ট দিশা নেই। নেই রপ্তানি বৃদ্ধির রোড ম্যাপ। সবটাই স্রেফ ধাপ্পা।
পরিসংখ্যান বলছে, কাজের সন্ধানে বাজারে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ নতুন যুবক-যুবতী প্রবেশ করে। এই বৃহৎ যুব বাহিনী নিয়ে সরকারের কোনও নির্দিষ্ট প্রকল্প নেই। সরকারি ক্ষেত্রে প্রায় দশ লক্ষ পদ ফাঁকা থাকলেও কর্মসংস্থান  বাড়াতে কোনও ঘোষণাই অর্থমন্ত্রী এদিন করেননি। বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে কুড়ি লক্ষ অর্থাৎ বছরে মাত্র চার লাখ ছেলেমেয়ের দক্ষতা বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নেবে সরকার। তাহলে বাকি ৬০-৬৫ লাখ যদি বেকার হয়, তাদের চাকরি দেবে কে? সরকারি ক্ষেত্রকে এড়িয়ে সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি সৃষ্টি করার জন্য মোদির বিজেপি তাকিয়ে আছে বেসরকারি ক্ষেত্রের দিকে। সেই জন্য বাজেটে ঘোষণা করা হল যে  বেসরকারি সংস্থাগুলিকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতনের ক্ষেত্রে তিন হাজার টাকা করে নাকি ভর্তুকি দেবে। বলা হচ্ছে, ইপিএফও নাকি নতুন চাকরি প্রাপকদের এক মাসের বেতন দেবে, তাও তিন কিস্তিতে। কিন্তু চাকরি হলে তো তবেই তো এই টাকা পাওয়ার প্রশ্ন উঠবে, তার আগে নয়। ফলে পুরো প্রস্তাবটাই আছে হাওয়ায়। এর চেয়ে বড় লোক হাসানো প্রস্তাব আর কী হতে পারে? বিনাস্বার্থে কর্পোরেট সেক্টর কি বেকারদের বেশি বেশি চাকরি দেবে? কিংবা কংগ্রেসের ইস্তাহার থেকে চুরি করে যুবকদের ৫ হাজার টাকার মাসিক স্টাইপেন্ড দেওয়ার প্রস্তাব? আসলে সবটাই লোক দেখানো গালভরা ঘোষণা মাত্র। এটা অর্থমন্ত্রী নিজেও বিলক্ষণ জানেন। 
দেশের ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয় অসংগঠিত ও কৃষি ক্ষেত্রে। সরকার সেক্ষেত্রে কেবলমাত্র মুদ্রা লোন দেওয়ার জন্য বাজেট বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে যে ৪০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় তাতে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি। অন্যত্র চাকরি যাতে বাড়ে তার জন্য সরকারের বাজেটে কোনও সদর্থক প্রস্তাব নেই। এমনকী, কৃষি মজুরি বৃদ্ধির জন্য যে দীর্ঘদিনের দাবি সেটাও মানা হয়নি। ভালোর দিক একটাই মুখ ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলিকে ব্যবসা করবার জন্য বন্ধকহীন ঋণ দেওয়ার একটা সহজ ব্যবস্থা ঘোষণা হয়েছে।। এই সমস্ত সংস্থা বাঁচলে বেশ কিছু মানুষের চাকরি হবে। কিন্তু তারা কতটুক কর্মসংস্থান করতে পারবে? তাহলে কর্মসংস্থানটা হবে কোথায়? গোটা বাজেট জুড়ে কেমন কোথাও কোনও পরিকল্পনা চোখে পড়ল না। 
বাজেটে ২ লক্ষ ৬৬ হাজার কোটি টাকা গ্রামের উন্নয়নে বরাদ্দ করা হয়েছে, কিন্তু সেটা প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ভাগচাষিদের জন্য নয়। বরাদ্দটা এমন ভাবে হয়েছে যাতে কৃষিক্ষেত্রের কর্পোরেটরা সুবিধা পায়। গ্রামের মানুষের হাতে চটজলদি নানা উন্নয়নমূলক কাজের মধ্যে দিয়ে অর্থের জোগান বাড়িয়ে কার্যত ভোগ্যপণ্যের বাজারে চাহিদা বাড়াতেই এই বাজেট নির্মিত হয়েছে। সেখানে নেই চাষের খরচ কমাতে সার ও বিদ্যুতে ঘাটতি দেওয়ার প্রস্তাব। নেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে কোনও আইনি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। গ্রামের উন্নয়নে  ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ  হয়েছে। গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ, ফসলের মজুতকরণ, বিপণনের জন্য মূলত বরাদ্দ হয়েছে, তাতে বড় পুঁজির কৃষি ব্যবসা ও বড় চাষিদের সুবিধা। বলা হচ্ছে, এইভাবে নাকি দশ বছরে ২৫ কোটি দরিদ্র মানুষকে আনা হয়েছে দারিদ্র্যসীমার বাইরে! অথচ মজার ব্যাপার হল, মোদি সরকার আসার পর থেকে গত ১০ বছরে দারিদ্র্যসীমার সংজ্ঞাই নির্ধারণ করা হয়নি। এবং, আগের সংজ্ঞা অনুযায়ী সঠিকভাবে দরিদ্র বা গরিব মানুষ কতজন, সেটা আজও সরকারিভাবে জানানো হয়নি। 
এমনই আজগুবি দাবি করা এই সরকারের অভ্যাস। যথারীতি বাজেট পেশ করার সময়ও একই অভ্যাসের পুনরুক্তি করা হয়েছে। এবার সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জিনিসের দাম কমানো ও কাজের সুযোগ বৃদ্ধি। অদ্ভুতভাবে সরকার এমন একটা বাজেট পেশ করল যার জন্য বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে এবং বেকারত্ব কমাবে না। খাদ্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়ছে। সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য জিনিসের দাম কমাতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খাবারের দাম কমানোর কোনও উদ্যোগই  নেই, উল্টে বাড়বে। কিন্তু  বাজেটে সবাইকে চমকে দিয়ে দাম কমল সোনা, রুপো ও প্ল্যাটিনামের।
আসলে, এই সরকারের বাজেট মানে সবসময়ই কিছু বিশেষ পেটোয়া শিল্পপতি বা কর্পোরেটকে সুবিধা করে দেওয়া। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ছাড় দেওয়া হচ্ছে বড় শিল্পপতিদের সুবিধার্থে। বাজেটে ধরে ধরে সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই ছাড় দেওয়া হয়েছে। উচ্চবিত্ত ও ধনীদের আয়করে সুবিধা দিতে লং টার্ম ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ ব্যবসায়ীদের কথা কোথাও ভাবা হয়নি।অথচ বিদেশি সংস্থা এ দেশে ব্যবসা করতে এলে তাদের করে আরও ৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 
বাজেটে প্রচুর উপায় ছিল সাধারণ মানুষকে ভালো রাখতে সরকারি বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো গড়ে তোলার। এবছর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দিয়েছিল ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকার রেকর্ড পরিমাণ বাৎসরিক লভ্যাংশ। সরকার সেই অর্থ দিয়ে দেশব্যাপী চাকুরিমুখী কর্মসৃষ্টির কেন্দ্র তৈরি করতে নানা প্রকল্পে বরাদ্দ করতে পারত। কিন্তু সেটা না করে, এমনকী রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে তা ব্যবহার না করে ঘাটতি কমিয়ে আনা যাবে বলে ঘোষণা করেছে। করবহির্ভূত রাজস্ব কীভাবে বৃদ্ধি পাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করবার পর জানিয়েছেন যা তাতে ফের জিএসটি হার বাড়ানো হবে, এমনই ইঙ্গিত। তাতে জিনিসের দাম আরও বাড়বে এবং কমবে দেশের উন্নয়নের হার। অবশ্য বাজেটে অর্থমন্ত্রী বৃদ্ধির হার ধরেছেন সাড়ে ১০ শতাংশ, যা অর্জন করার মতন কোনও পরিকল্পনাই বাজেটে নেই। বাজেট অনেকটা মনগড়া এবং বেশিটাই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হারানো ভোট পেতে কিছু ঘোষণা আছে মাত্র, তার ভিত্তিতে কি কখনও অর্থনীতি চলে?
আয়কর কাঠামোয় মানুষকে নামমাত্র ছাড় দিয়ে এবং সামান্য জিএসটি হার কমিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়াতে উৎপাদনমুখী যে ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, তাতে অর্থমন্ত্রী যদি বরাদ্দ বাড়াতেন তাহলে এই বাজেটেই প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের মুখ দেখা যেত। দরকার ছিল রপ্তানি বাড়াতে বিশেষ কিছু ঘোষণার। ভারতের অর্থনীতির বিকাশের এবং কর্মসংস্থানের দুটি বিশেষ জায়গা এক, উৎপাদন ক্ষেত্র এবং দুই রপ্তানি। এই দুটি ক্ষেত্রই এবারের বাজেটে বিশেষভাবে উপেক্ষিত হল। ফলে এই বাজেট দিয়ে কর্মসংস্থানহীনতা ও বেকারত্বের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা যাবে না, দেশে বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি—দুটিই বাড়তে থাকবে। ফলে অতিশয় ঋণনির্ভর এই বাজেট এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারসাম্য রক্ষার বদলে এর ফলে বৈষম্যই বাড়বে সর্বস্তরে। প্রমাণ হবে যে এই বাজেট আসলে নানাবিধ ধাপ্পারই এক প্রদর্শনী!
লেখক অর্থনীতি বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা