বিশেষ নিবন্ধ

মমতার জলযুদ্ধ!
মৃণালকান্তি দাস

সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের নায়িকা ছিলেন দীপাবলি। যাঁকে উত্তরবঙ্গের চা-বাগান থেকে বহুবার সকরিকলি মনিহারি ঘাট হয়ে স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতা আসতে হতো। কলকাতা এবং উত্তরবঙ্গের যোগসূত্র তখন অর্ধেক পথ ট্রেনে, তারপরে স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে আবার অন্যপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন।
সমরেশ মজুমদার নিজেই উত্তরবঙ্গের চা-বাগান অঞ্চলের মানুষ। তাই তাঁরও বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথমবার কলকাতায় আসা, ওই নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ধরে অর্ধেক পথ এসে তারপরে স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে বাকি অর্ধেক পথ ট্রেনে চেপে। সমরেশ মজুমদার যখন কিশোর বয়সে কলকাতায় আসার জন্য দ্বিতীয়বার গঙ্গা পেরিয়েছিলেন, ততদিনে অবশ্য ফরাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ দপ্তরের এক ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য নিজের উদ্যোগে তৈরি করে ফেলেছেন একটি গ্রাউন্ড রিপোর্ট। যে রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে বলা হয়েছিল, কেন ওই ফরাক্কা বাঁধ ক্ষতিকারক হবে। সেদিন কেউ পাত্তা দেয়নি সেচদপ্তরের সেই ইঞ্জিনিয়ারের কথা। সেই পঞ্চাশের দশকে ফরাক্কায় বাঁধ দিলে কী কী ক্ষতি হতে পারে বলে কপিল ভট্টাচার্য যা যা ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন, প্রায় তিন-চার দশক পরে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেসব একদম মিলে গিয়েছে।
মালদহ জেলায় ৮০ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে বয়েছে গঙ্গা। ফরাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর উজান এবং ভাটিতে শুরু হয় নদী ভাঙন। গত দু’ দশকে ভাঙনে ২৯টি মৌজা সহ বেশ কয়েক হাজার বিঘা জমি গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে। বিলুপ্ত একটি গোটা গ্রাম পঞ্চায়েত—কেবি ঝাউবোনা। পঞ্চাশের দশকে কপিল ভট্টাচার্যের সন্দেহ ছিল, ব্যারেজ ডিজাইনে যে মাত্র ২৭ লক্ষ কিউসেক জল ধরা হয়েছে, তা ব্যারেজের এবং দু’পাশের বাঁধের জন্য ব্যয় কম দেখানোর জন্য। বাস্তবক্ষেত্রে বন্যার ফলে বামকূলের বাঁধ ঘুরে গঙ্গা মনিহারি, কাটিহার, মালদহের বিস্তীর্ণ জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে সেটাই হয়েছে। মালদহ জেলার বহু গ্রাম নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। ফরাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পক্ষে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি হবে বলে যে যুক্তি দেওয়া হতো, তাও মানতে চাননি কপিল ভট্টাচার্য। তিনি সেই পঞ্চাশের দশকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ফরাক্কায় ব্যারেজ বেঁধে ও ভাগীরথীকে গঙ্গার সঙ্গে একটা নতুন খালের সাহায্যে সংযুক্ত করে দিয়েই ভাগীরথীর স্বাভাবিক মজে যাওয়া আটকানো যাবে কেন? এই প্রশ্নের কোনও উত্তর কেউ দিতে পারেননি। যেসব স্বাভাবিক কারণে ভাগীরথীর উৎস মজে গিয়েছে ও গঙ্গার সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, সেই সব স্বাভাবিক কারণের কোনও প্রতিকারই ফরাক্কা ব্যারেজ করতে পারবে না। সুতরাং এই পন্থায় ভাগীরথীর নাব্যতা পুনরুজ্জীবিত করে কোনও লাভ নেই।
ফরাক্কা ব্যারেজের বিরোধিতা করতে গিয়ে কপিল ভট্টাচার্য তিস্তা সহ যে সব নদী উত্তর-পূর্ব হিমালয় থেকে নেমে এসেছে, সে ব্যাপারেও লিখেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অর্থাৎ উত্তর বিহার ও অসমের হিমালয়-নির্গত নদীগুলি দুর্দান্ত। কুশি, মহানন্দা, তিস্তা প্রভৃতি নদী কোন বছরের বন্যায় কত জল বহন করে, এতে কোন খাত দিয়ে নামবে বলা দুঃসাধ্য। হিমালয়ের এই অংশে কখনও কখনও ২-৪ ঘণ্টার মধ্যে এত বেশি বৃষ্টিপাত হয় যে, তা চিন্তারও অতীত। এই সব নদী দিয়ে হঠাৎ সেই জল নেমে এসে প্লাবনের বিপর্যয় ঘটায়। সুতরাং এইসব নদীর সম্যক পর্যবেক্ষণ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত ফরাক্কায় গঙ্গা-ব্যারেজ নির্মাণে বিপুল অর্থব্যয় অত্যন্ত হঠকারী কাজ হবে।’ এটাই ছিল তাঁর ফরাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি। ২০২৩ সালের অক্টোবর অতিবৃষ্টির কারণে তিস্তা নদীর লোনক হ্রদ ভেঙে যে হঠাৎ বন্যা আছড়ে পড়েছিল, সেই ঘটনাও বিশেষজ্ঞদের মনে করিয়ে দিয়েছিল কপিল ভট্টাচার্যের কথাগুলি। আবার, কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির যে যুক্তি কপিল ভট্টাচার্য খণ্ডন করেছিলেন, সেটাও যে সত্য, তা প্রমাণিত হতে বেশি দেরি হয়নি। তাই কলকাতা বন্দরে এখনও বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। ফলে হলদিয়াতে গড়তে হয়েছিল আরও একটি বন্দর। অথচ, কোনও এক বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র নাকি তাঁকে দাগিয়ে দিয়েছিল ‘পাকিস্তানের চর’ বলে।
আজ এই ফরাক্কা ব্যারেজই যাবতীয় সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু! গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর। এই আবহে সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে ‘ফরাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবীকরণের জন্য ‘যৌথ কারিগরি কমিটি’ তৈরি করা হয়েছে। কার্যত এই পদক্ষেপে দু’দেশের জলবণ্টন চুক্তি নবীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হল বলে অনেকে মনে করছেন। আর তাতেই আপত্তি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, ‘এই পদক্ষেপ আসলে বাংলাকে ভাতে মারার চক্রান্ত। রাজ্য সরকারকে এড়িয়েই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাংলার বুকে বাংলাকে এড়িয়ে এবং বাংলার স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এমন কোনও কাজ করা সহজ নয়। বাংলার জল না জানিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। বাংলার জল বিক্রি মানে আগামী দিনে গঙ্গার ভাঙন আরও বাড়বে, বাড়িঘর ভেঙে জলের তলায় চলে যাবে। ফরাক্কার জল নিয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে ভুগছি আমরা। যে অর্থ দেওয়ার কথা ছিল তা দেয়নি। গত দু’তিন দশকে ব্যারেজের আশপাশে পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে চর গজিয়েছে। ড্রেজিং করেনি। ফলে কলকাতা বন্দর নষ্ট হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা জলের তলায় চলে যাচ্ছে। অথচ, সিকিমে ১৪টা হাইড্রেল পাওয়ার স্টেশন হয়েছে। সিকিম সব জল আটকে দিয়েছে। তখন কেন কিছু বলেনি। আমার জল দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু, থাকলে তো দেব। আমি বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু, বাংলাকে বিক্রি করে দেওয়ার স্বার্থে নয়।’ জল চুক্তির সময় মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে রাজ্য সরকারকে ৭০ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রের। তার কানাকড়িও তারা দেয়নি।
তথ্য বলছে, ফরাক্কা ব্যারেজে ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গঙ্গায় গড় জলপ্রবাহ ছিল ১,০৭,৫১৬ কিউসেক। প্রতি বার শুখা মরশুমে কমত জলপ্রবাহ। এপ্রিল মাসের শেষে জলপ্রবাহ কমে দাঁড়াত ৬০,৯৯২ কিউসেকে। ফরাক্কার মূল ব্যারেজ থেকে জল ধুলিয়ান, সুতি, জঙ্গিপুর, লালগোলা হয়ে ঢোকে বাংলাদেশে। ফরাক্কা ব্যারেজের পাশ দিয়ে একটি খাল কেটে তার মাধ্যমে ৩৮ কিমি দূরে জঙ্গিপুরে গঙ্গার জল নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সালের ওই জলপ্রবাহ ধরে ১৯৯৬ সালে বণ্টন চুক্তি হয়েছিল। তারপর কেটে গিয়েছে চার দশক। অভিযোগ, গত চার দশকে প্রতি বছর প্রায় ৮০ কোটি টন পলি ভেসে ফরাক্কা ব্যারেজের আশপাশে জমছে। তাতে ফরাক্কা ব্যারেজের জলধারণ ক্ষমতা অনেক কমেছে। আসল সমস্যা ব্যারেজের ড্রেজিং। কেন্দ্র এর জন্য একটা টাকাও খরচ করে না।
জলবণ্টন চুক্তি মোতাবেক, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন ৪০ হাজার কিউসেক করে জল পায় ভারত। ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে ফিডার ক্যানাল হয়ে কলকাতা বন্দরে যায় সেই জল। অবশিষ্ট জল মূল ব্যারেজ হয়ে যায় বাংলাদেশে। তবে মার্চ-এপ্রিলে নদীতে জল কমতে শুরু করলে সমস্যা বাড়ে। চুক্তি অনুযায়ী, মার্চ মাসে ২০ দিন বাংলাদেশে ৩৫ হাজার কিউসেক করে জল যায়। পরবর্তী ১০ দিন ভারত পায় একই পরিমাণ জল। এপ্রিলে উল্টো। ওই মাসে ভারত ২০ দিন পায় ৩৫ হাজার কিউসেক জল। বাংলাদেশ শেষ ১০ দিন পায় একই পরিমাণ জল। বাকি সময় নদীতে যে জলপ্রবাহ থাকবে, তা পাবে দু’দেশই। জানা গিয়েছে, ২০১৬ সালে জল বণ্টন চুক্তির ফলে ফিডার ক্যানালে জলপ্রবাহ অনেক কমে গিয়েছিল। সেই সময় পাশের এনটিপিসি-তে ২,১০০ মেগাওয়াটের ৬টি বিদ্যুৎ ইউনিট জলাভাবে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে এনটিপিসি নিজেরা আলাদা ইনটেক ক্যানাল তৈরি করে জল আগে থেকে ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে। অন্য দিকে, মূল ব্যারেজের জলপ্রবাহ তলানিতে ঠেকার ফলে গঙ্গা এবং পদ্মা জুড়ে গ্রীষ্মকালে প্রচুর চর গজিয়ে উঠেছে। গঙ্গার জল সরবরাহের উপর নির্ভরশীল বহু এলাকার বাসিন্দাও ওই সময় তীব্র জলকষ্টে ভোগেন। আবার প্রতি বছর ৩১ মে চুক্তি শেষ হতেই ব্যারেজে আছড়ে পড়ে জলস্রোত। সেই জলের তোড়ে ধুলিয়ান, সুতি, জঙ্গিপুর, লালগোলার বহু গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়ে।
শুধু তাই-ই নয়, প্রায় আট বছর আগে ফরাক্কা ব্যারেজ থেকে ঠিক ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাংশায় পদ্মা নদীর উপর হাসিনা সরকার বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগী হওয়ায় আপত্তি তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দু’দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত জলঙ্গি এবং মাথাভাঙা নদী ইতিমধ্যেই পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ‘এর ফলে সুন্দরবনে মিষ্টি জলের প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।’ তাঁর অভিযোগ, চীনকে দিয়ে ড্যাম (জলাধার) বানিয়েছে বাংলাদেশ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফ কথা, জল অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণধারণের রসদ নিয়ে কোনও সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই। অতএব, লড়াই-আন্দোলন একমাত্র পথ।
বাংলার মানুষ জানতে চায়, মমতার জলযুদ্ধে বঙ্গ বিজেপির খগেন মুর্মুরা কোন দিকে— পশ্চিমবঙ্গ নাকি বাংলাদেশ?
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রখর অনুমান ক্ষমতার গুণে কার্যোদ্ধার। ব্যবসা, বিদ্যা, দাম্পত্য ক্ষেত্রগুলি শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.১৩ টাকা৮৪.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৮.৩২ টাকা১১১.৮৭ টাকা
ইউরো৯১.২৫ টাকা৯৪.৪৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
5th     September,   2024
দিন পঞ্জিকা