উপার্জন বেশ ভালো হলেও ব্যয়বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। শরীর খুব একটা ... বিশদ
নোবেল
বাংলাদেশের ছেলে নোবেল। তিনি কলকাতায় এসেই সবার মন জয় করে নিয়েছেন। শুনলে অবাক হতে হয়, গানের কোনও প্রথাগত শিক্ষা তাঁর নেই। ‘ছোটবেলা থেকে গান শুনতে ভালোলাগত। আসলে আমি একজন ভালো শ্রোতা। ২০১৬ সালে আমি ঠিক করি এবার আমার গান করা উচিত। তখন থেকে মিউজিক করা শুরু করি’, বললেন নোবেল। জি বাংলার এই প্ল্যাটফর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করল কীভাবে? বললেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজন এই অনুষ্ঠান দেখতে খুব ভালোবাসেন। ওরাই আমাকে অডিশন দেওয়ার কথা বলেন।’ গান বাজনা শুরু করার পরে বাংলাদেশে নোবেল একটি ব্যান্ড করেছিলেন। ‘ওখানে আমার একটা ব্যান্ড ছিল। কিন্তু আমরা তো একটু অন্য ধরনের মিউজিক করতাম তাই কেউ খুব একটা শুনত না। আমাদের কেউ শো দিত না। আমি ছোটবেলা থেকেই জেমসের গান শুনতাম। এখানে এসে ওই শোনাটা কাজে লেগেছে। তবে, ব্যান্ডে জেমস বা আইয়ুব বাচ্চুর গান গাইতাম না’, এমনটাই বললেন নোবেল। তখন তিনি গানও লিখতেন। তবে এই মঞ্চে খানিক অন্য ধরনের গান গাইতে হচ্ছে। নোবেল মনে করেন, ‘এখানে গান গাইলে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছি। এরকম তো নয় যে, আগে গান গাইতে পারতাম না, এখানে এসে অনেককিছু শিখে গিয়েছি।’ কলকাতায় আসার পরে নোবেল ব্যান্ড ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশে কয়েকজন বন্ধু মিলে আবার নতুন ব্যান্ড করার পরিকল্পনায় রয়েছেন নোবেল। নোবেল ‘ভিঞ্চিদা’ ছবিতে একটি গান গেয়েছেন। এটিই তাঁর প্রথম প্লেব্যাক। এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমি তো অনুপমদা (রায়)-র ফ্যান। তাঁর সঙ্গে কাজ করা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সমান।’
গৌরব সরকার
বাংলার সঙ্গীত মহলে গৌরব কিন্তু ইতিমধ্যেই পরিচিত নাম। তাহলে আবার প্রতিযোগিতায় কেন? বললেন, ‘আমি এই অনুষ্ঠানের প্রায় প্রত্যেকটা সিজন দেখেছি। আমার মনে হয় একমাত্র এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৃথিবীর সমস্ত সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। আমার নিজের গানকে সবার কাছে পৌঁছে দিতেই এখানে আসা।’ গৌরব তাঁর ঠাকুরমা রত্না সরকার কাছে প্রথম তালিম নেওয়া শুরু করেন। গৌরবের ঠাকুরমা সলিলীল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরীর মতো মানুষদের সঙ্গে কাজ করেছেন। গৌরব বললেন, ‘আমি ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখেছি পণ্ডিত আনন্দ গুপ্তর কাছ থেকে। তারপর আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে সুযোগ পাই। সেখানে প্রায় সাড়ে তিন বছর পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে তালিম নিই। সেই সময় পড়াশোনার জন্য বছর দু’য়েক গান শেখা বন্ধ ছিল।’ এরপরে গৌরব গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন গৌতম ঘোষালের কাছে। ‘আমি ছোটবেলা থেকেই মহীনের ঘোড়াগুলি, কবীর সুমন, নচিকেতা এঁদের গান শুনে বড় হয়েছি। তার সঙ্গে পুরনো গান তো ছিলই। কিন্তু ওই নতুন গানগুলি আমায় খুব আকৃষ্ট করত। সেখান থেকেই নতুন বাংলা গান করার আগ্রহ জন্ম নেয়,’ এমনটাই বলছিলেন গৌরব। এর আগেও বিভিন্ন মাধ্যমে গৌরব নতুন বাংলা গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। পাশাপাশি দু’টি বাংলা ছবিতে প্লেব্যাকের কাজ করেছিলেন। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ছবিতে গান গাওয়ার অফার পেয়েছেন।
গুরুজিত্ সিং
দুর্গাপুরের বাসিন্দা পাঞ্জাবি যুবক গুরুজিত্ এখন ক্রমেই বাঙালি দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ‘আমার বাবার কাছে বাংলা-হিন্দি-পাঞ্জাবি মিলিয়ে প্রায় দশ হাজারের বেশি ক্যাসেট আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় থেকে গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমি বাবার ব্যবসাতে কাজ করা শুরু করি,’ বলছিলেন গুরুজিত্। এরপর দুর্গাপুরেই খেয়াল, ঠুমরি, দাদরাতে তালিম নেওয়া শুরু করেন তিনি। কিন্তু আগ্রহ ছিল আধুনিক, ফিল্মের গান এবং ভক্তিগীতিতে। চাকচিক্যপূর্ণ মঞ্চ তাঁকে আকর্ষণ করত। মঞ্চের ভীতি কাটানোর জন্য তাঁর বাবা কোনও ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। ‘তিন মাস রিহার্সাল করার পরে আমি সেই রক ব্যান্ডের হয়ে গান গাই। ২০০৯ সালে প্রথম শো করে আমি ৫০ টাকা পেয়েছিলাম। ওই নোটটা এখনও আমার কাছে রাখা আছে। আমার বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বড় কোনও জায়গায় শিখতে পারিনি,’ বলছিলেন গুরুজিত্। একটা সময় লাইভ শো করার জন্য বিভিন্ন অর্গানাইজেশনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছিলেন। সেইসব অনুষ্ঠানগুলিতে গুরুজিতকে পাঞ্জাবি গায়ক হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো। টাকার পরিমাণও ছিল খুব কম। শুধুমাত্র পাঞ্জাবি গান গাইতে গুরুজিতের ভালোও লাগত না। ছোটবেলা থেকেই যেহেতু ভজন গাইতে পারতেন তাই গুরুদুয়ারে গিয়ে কীর্তন এবং মন্দিরে গিয়ে ভজন গাওয়া শুরু করলেন। সেখানেই এক পুরোহিত তাঁকে একটি শ্যামাসঙ্গীত তৈরি করতে বলেন। মন্দিরের অনুষ্ঠানে সেই গান গাওয়ার পরে অনেক লোকের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। তখন থেকেই ভক্তিগীতি গাইতে শুরু করেন। ‘এখন শুধুমাত্র এখানেই ফোকাস করতে চাই। এখানে যতদিন আছি মানুষের কাছে বেশি করে পৌঁছতে পারছি। এই বছর মহালয়ার দিনে আমি একটি ভক্তিগীতি নিয়ে আসতে চলেছি। বড় বাজেটে কাজ করার ইচ্ছে আছে’, বললেন গুরুজিত্।
অনন্যা চক্রবর্তী
অনন্যা জানতেনই না কবে সারেগামাপা-র অডিশন আছে। ‘আমার বন্ধুরা অডিশনের খবর রাখে। ওরা আমায় হঠাত্ করে ফোন করে বলে, তুই কি আসবি?’, বললেন অনন্যা। সাড়ে দশটার সময় ঠিক করেন অডিশনে তিনি যাবেন। যোধপুর পার্ক বয়েজে এসে দেখেন বিশাল লাইন। একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে লাইন টপকে এগিয়ে গিয়ে দেখেন তাঁরই অনেক বন্ধু একেবারে শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যস! পরে এসেও আগে অডিশন দিয়ে ফেললেন। বন্ধুদের হল না, কিন্তু অনন্যা সুযোগ পেয়ে গেলেন। ‘এখানে অনেককিছু শিখতে পারলাম। বিশেষ করে টেকনিক্যাল অনেককিছু জানতে পেরেছি। এই জিনিসগুলি প্রত্যেকদিন গ্রুমারদের কাছ থেকে শিখি’, বলছিলেন অনন্যা। তিনি ছোটবেলায় আবৃত্তি শিখতেন। এছাড়া মা যেহেতু গান গাইতেন তাই হারমোনিয়াম নিয়ে ছোটবেলায় তালিম নিতে বসে পড়তেন। এরপর কিছুদিন পণ্ডিত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে খেয়াল শেখেন। অনন্যা বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই লোকসঙ্গীতের উপর আমার বিশেষ ঝোঁক ছিল।’ অনন্যার একটা সময় মনে হয়, এই গান বাড়িতে বসে শেখা যাবে না। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পরেই অনন্যা একা বোলপুরে বাউলের আখড়ার সন্ধানে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ‘ফেসবুকে কিছু বাউলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৩০০ টাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাই। হাওড়ায় গিয়ে দেখি ট্রেন সেই সন্ধেবেলা,’ হাসতে হাসতে বলছিলেন অনন্যা। তারপর ওখানে পৌঁছে গিয়ে মাকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানিয়ে দেন। বিভিন্ন বাউল মেলায় যাতায়াত চলতেই থাকে। বোলপুরেই একটি আশ্রমে থাকতে শুরু করেন তিনি। ‘গান নিয়ে এগনো ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছিলাম কমার্স নিয়ে তারপর বাংলা নিয়ে আশুতোষ কলেজে। রবীন্দ্রভারতীতে ভোকাল মিউজিক নিয়েও পড়েছিলাম। শেষ সেমেস্টারের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এটা শেষ হলে দেব,’ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন অনন্যা।
অঙ্কিতা ভট্টাচার্য
গান বিষয়টা যে কী, সেটা অঙ্কিতা বোঝেন তাঁর ঠাকুরমাকে দেখে। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির সহযোগিতা পেয়ে এসেছেন। তার পর হঠাত্ করেই নাচ করার ইচ্ছে জাগে। অতএব অঙ্কিতা শুরু করেন নৃত্যচর্চা। কিন্তু তাঁর বাবা চাইতেন, মেয়ে গানই করুক। কাজই আবার শুরু হল সঙ্গীতচর্চা। এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা যখন চলছে অঙ্কিতার বয়স তখন মাত্র সাত-আট বছর। উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙায় স্থানীয় রাধাপদ পালের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন। ‘এরপর রথীজিত্ ভট্টাচার্যের কাছে আমি প্রায় ছ’বছর গান শিখেছি। সেখান থেকে জোকা স্টুডিওতে অডিশন দিই। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল যেন আমি এখানে গান গাই। সেই স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে দেখে মাঝে মাঝে চোখে জল এসে যায়’, বলছিলেন অঙ্কিতা। ইছাপুর হাই স্কুলে সবে মাত্র ক্লাস টুয়েলভে উঠেছেন অঙ্কিতা। শিক্ষক থেকে শুরু করে সহপাঠী প্রত্যেকেই পাশে দাঁড়িয়েছেন।
স্নিগ্ধজিত্ ভৌমিক
দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর শহরের গ্রাম শেরপুরে স্নিগ্ধজিতের জন্ম। গান শেখার শুরু হয় বাবার হাত ধরে। স্নিগ্ধজিত্ তাঁর বাবাকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে দেখেন। ‘আমাদের যৌথ পরিবার ছিল। বাবা-মা বাদে বাড়ির কেউই আমার গান গাওয়া পছন্দ করতেন না। কানের দুল বিক্রি করে মা আমায় হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল। বাড়িতে রেওয়াজ করতে পারতাম না। প্রতিবেশী বাবাইদার বাড়িতে গান গাইতাম,’ বলছিলেন স্নিগ্ধজিত্। কিছুদিন বাদে স্থানীয় একজনের কাছে তালিম নেওয়া শুরু হয়। কিন্তু আর্থিক সমস্যার জন্য সেটাও বন্ধ করে দিতে হয়। হারমোনিয়ামটিও বিক্রি করতে হয়। তারপর ট্র্যাক ক্যাসেট কিনে বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়া শুরু করেন। মানুষের কাছ থেকে বাহবাও পেতে থাকেন। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ বদলায় না। ‘বুনিয়াদপুরের নতুন আলো ক্লাব আমায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছিল। তারপর রায়গঞ্জে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে পড়তে এলাম। ওখানেও অনেক মানুষ আমায় সাহায্য করেছেন’, বলছিলেন স্নিগ্ধজিত্। পরিস্থিতির চাপে পড়ে এর মাঝে কলেজ শেষে স্নিগ্ধজিৎকে পালিয়ে বিয়ে করতে হয়।
এদিকে বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে। তখন ঘরে ঘরে গ্যাস লাইটার বিক্রি করতেন তিনি। ‘আমার স্ত্রী অদিতি চাকরি করে সংসার চালাত। আমি তখন গানের জন্য কলকাতায় আসা শুরু করেছি। অদিতি রক্ত বিক্রি করে আমায় তানপুরা কিনে দিয়েছিল,’ বলছিলেন স্নিগ্ধজিত্। ২০১৩ সালে কলকাতায় এসে একটি পানশালায় গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। সেই পরিবেশটাকে মানিয়ে নিতে খানিক সময় লেগেছিল। প্রায় দু’বছর এখানে কাজ করে সংসার চলে। ‘২০১৫ সালে মুম্বইয়ে দ্য ভয়েজ নামক একটি রিয়েলিটি শোতে আমি চান্স পাই। ওটা আমার জীবনে একটা বড় ঘটনা। প্রচুর শো পেতে শুরু করি। আমার পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি,’ বললেন স্নিগ্ধজিত্। ২০০৫ সাল থেকে সারেগামাপা-এর অডিশন দিচ্ছেন তিনি। তারপর আজ সুযোগ পেলেন। তিনি বলছিলেন, ‘সারেগামাপা এক চুটকিতে আমার জীবন বদলে দিল। আমি তিনজনের নাম করতে চাই যাদের ছাড়া এক পা এগোতে পারতাম না দেবাশিস দত্ত, অরূপ সিংহ এবং অরূপ কুমার ঝা।’
ছবি: দীপেশ মুখোপাধ্যায়