খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
এমনই একটা টানাপোড়েন শিক্ষা-ব্যবস্থায় চলছে দেখে বিদ্যাসাগর যতখানি বিড়ম্বনা ভোগ করতে লাগলেন, তেমনই সমাজের কতকগুলো অব্যবস্থায় বিশেষ করে মহিলারা যে কত কষ্ট পাচ্ছেন— তা ভেবে তার প্রতিকার করার জন্যও তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মেয়েদের অভিভাবকরা তাঁদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিচ্ছেন। ফলে একটু বয়স হতে না হতেই তাঁরা বিধবা হয়ে পড়ছেন। অল্পবয়সি বিধবাদের দেখলেই তাঁর মন খারাপ হতো। বুঝতে পেরেছিলেন মেয়েরা যে বিধবা হচ্ছেন, আর তার জন্যে তাঁদের কষ্টের অবধিমাত্র থাকছে না। আর তার মূল কারণ এই বাল্যকালে তাদের বিয়ে দেওয়া। তাই হিন্দু কলেজের সিনিয়র ছাত্রেরা মিলে ‘সর্বশুভকরী’ নামে একটি পত্রিকা বের করে তার গৌরব বিধানের জন্যে যখন বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে লেখা চেয়ে আবদার করতে লাগলেন— তিনি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ দেখিয়ে তাতে একটি নিবন্ধ লিখে বসলেন। পরের সংখ্যায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখলেন মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে। এই দুটো বিষয়ে বিদ্যাসাগর একেবারে ডুবে গেলেন। কিন্তু পরিস্থিতি অন্যদিকেও টেনে ধরেছে।
বন্ধু মদনমোহন সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে দিয়ে মুর্শিদাবাদে জজপণ্ডিতের পদে যোগ দিয়ে চলে গেলেন। শিক্ষা বিভাগ ধরলেন বিদ্যাসাগরকে শূন্য সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যোগ দিতে। বিদ্যাসাগর সরাসরি না করে দিলেন। পীড়াপীড়ি করতে বললেন— ঠিক আছে, যদি আমাকে ওই বিভাগে অধ্যক্ষ করে দাও— আমি যোগ দিতে পারি। সরকার বললে তাই সই। ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর সেই প্রার্থিত পদেই যোগ দিলেন— মাইনে বেড়ে দাঁড়াল নব্বই। শিক্ষাবিভাগ বলল, নামে সংস্কৃত কলেজ কিন্তু সংস্কৃত পড়ায় যেন উপযুক্ত মান লক্ষ করা যাচ্ছে না। কেন এমনটি হচ্ছে আপনি একটা রিপোর্ট তৈরি করে আমাদের দিন তো সব দিক খতিয়ে দেখে। তাই তিনি দিলেন। অমনি সেক্রেটারি রসময় দত্তের খুব গোঁসা হল। এ তো দেখছি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া হচ্ছে। বিদ্যেসাগর রিপোর্ট লিখবে তিনি থাকতে? এবার তাঁকে তাই মেনে চলতে হবে। এমনটা হতে চলেছে— এমন আঁচটাই তিনি করছিলেন। তাই সরাসরি পদত্যাগপত্র জমা দিলেন শিক্ষাসমাজের কাছে। মোয়াট সাহেব দেখলেন— এ তো মহা ফের হল। করিসাঙ পিপ্পলিখণ্ড কফ নিবারিতে। উল্টাইয়া বসিল কফ মজ্জার সহিতে। এখন তাঁর ভরসা তো ওই একজনই। অতএব বিদ্যাসাগরকেই সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষপদে বসাতে বাধ্য হলেন। সেক্রেটারি, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দুই পদ উঠিয়ে দিয়ে অধ্যক্ষপদের দায়িত্বে মিশিয়ে দিয়ে কেবল একটি অধ্যক্ষপদ তৈরি হল— তেমনই সুপারিশ ছিল বিদ্যাসাগরের। এখন তিনিই একাই একশো— বিদ্যাসাগরের মাইনে বেড়ে দাঁড়াল সাকুল্যে দেড়শো টাকা। তাঁর ছেড়ে দেওয়া পদে এলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন— পরে বিদ্যাসাগরের দেওয়া প্রথম বিধবা বিবাহের সেই বিখ্যাত বর মহোদয়। মাথায় চাপ তো কম নিলেন না বিদ্যাসাগর। ফল ফলল কিছুদিনের মধ্যেই— উৎকট শিরঃপীড়ায়, মাথার যন্ত্রণায়, ইংরেজিতে যাকে বলে Caphalitis— সেই রোগে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আর সমবয়সি বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত মশায়ও এই রোগে খুব ভুগতেন।
এর সঙ্গে একটা বিষম বেদনার ঘটনা ঘটে গেল, তাঁর হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ, মহাত্মা ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের মৃত্যু ঘটে গেল। সেই বেথুন সাহেব যার নামে আজকের বিখ্যাত মহাবিদ্যালয় মেয়েদের জন্যে— বেথুন কলেজ। এর প্রতিষ্ঠাতা তিনিই, হিন্দু কলেজের সেই বিখ্যাত পড়ুয়া, পরে রাজা উপাধিভূষিত, দক্ষিণারঞ্জন (দক্ষিণানন্দ আসলে) মুখুজ্যের দেওয়া জায়গাতে গড়ে ওঠা হেদুয়ার সেই বিখ্যাত কলেজের স্থপতি— বেথুন সাহেব চলে গেলেন। পরদুঃখকাতর বিদ্যাসাগরের সে কী কান্না! হেলিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে নিজের শকটে চড়িয়ে সমাধিস্থানে নিয়ে এলেন। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হল। গভর্নর সাহেব বিদ্যাসাগরকে বেথুন কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দিলেন— বিনা বেতনে সেই কাজ দায়িত্বের সঙ্গে পালন করতে লাগলেন তিনি। স্ত্রী শিক্ষার জন্যে যিনি পাগল— তিনি কি মাইনে নিতে পারেন। বন্ধু মদনমোহন তাঁর দুটি কন্যা ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে বেথুনে ভর্তি করেছেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও মেয়েকে দিয়েছেন— তখনও পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মশায়ের কোনও কন্যার জন্ম হয়নি যে তিনি মেয়েকে ভর্তি করবেন। বিশ্ব নিন্দুকেরা বলতে লাগলেন, নিজের মেয়ে নেই তো, তাই পরের মেয়েদের ভর্তি করিয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এই সব বলে বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধীরা খুব তড়পাতে লেগে গেলেন।
ওই যে রিপোর্টের কথা বলে এলাম, তাতে একটা বিষয়ের আঁচ ছিল। বিদ্যাসাগর মশায় পড়ানোর নামে ছেলেদের গায়ে হাত তোলা, বেত মারার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একদিন তিনি দেখলেন, সংস্কৃত কলেজের জনৈক অধ্যাপক ক্লাসের মধ্যে ছেলেদের দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছেন। অধ্যাপক মশায়কে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি— ‘কী হে! তুমি যাত্রার দল বানিয়েছ নাকি? তার জন্যেই কি ছেলেদের তালিম দিচ্ছ? তুমি বোধ হয় দূতী সাজবে?’ অধ্যাপক মশায় অপ্রস্তুতের একশেষ। আর একদিন আর একটা ক্লাসে, বাইরে থেকে দেখলেন, অধ্যাপকের টেবিলে একটা বেত রয়েছে। অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকে অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেত কেন হে?’
— আজ্ঞে মানচিত্র দেখাবার জন্যে।
— বুঝেছি, রথ দেখা কলা বেচা দু’রকমই হয়। ম্যাপ দেখানো হয়, আবার ছেলেদের পিঠে সদ্ব্যবহার হয়।
এমনিতে রসিক, কিন্তু যাকে বলে ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ —ক’টা দিন যেতে না যেতেই একটা সার্কুলার (বিজ্ঞপ্তি) জারি করে দিলেন— ‘ছেলেদের শাস্তিদান নিষেধ’। এই রসিক মানুষটাকে যখন শিরঃপীড়ায় পেড়ে ফেলেছিল, তখন তিনি যে কাণ্ডটা করতেন, তা এখনকার লোকে জানেন না হয়তো। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখলেন বিদ্যাসাগরের শরীরে রক্তের পরিমাণ ‘বেড়ে’ গিয়েছে। ডাক্তার নীলমাধব মুখোপাধ্যায় দেখেশুনে শরীর থেকে ঘাড়ের দস্ত খুলে বেশ খানিকটা রক্ত বের করে দিয়ে বললেন— একটুখানি ব্যায়াম করবেন তো। অমনি তিনি মুগুর কিনে এনে ভাঁজতে আরম্ভ করলেন আর ডন-বৈঠক ঠুকতে লাগলেন। তাতেই গড়ে উঠল সুঠাম আর সুগঠিত শরীর। ওই যে বলা হয়ে থাকে এঁড়ে বাছুরটা ঘাড় ঘোরাতে পারে না। তার কারণ রক্তের ওই উচ্চচাপ। সেটা সামলেছেন, তেমনই সামলাতে লাগলেন স্ত্রীশিক্ষার নানা সমস্যা। বিদ্যালয়ের বালিকারা যে তাঁর মেয়ের মতো। একবার রাজা দিনকর রাও বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় দেখতে গিয়ে মেয়েদের মিষ্টি খাওয়ানোর জন্যে তিনশো টাকা দিয়ে আসেন। বিদ্যাসাগর মশায় জানতেন মিষ্টি খাওয়ার চেয়ে তাদের পরনের শাড়ির প্রয়োজন বেশি। ওই টাকা দিয়ে তিনি শাড়ি কিনে এনে মেয়েদের দিয়ে একটা দীর্ঘস্থায়ী স্বস্তি প্রদান করলেন।
(ক্রমশ)