খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
উদ্বাস্তু-ভরা বঙ্গে ভানু যখন নিজেকে ধীরে ধীরে বাঙালদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে প্রতিপন্ন করে তুলছেন, জহর তখন হাতের কাছে যা রোল পেয়েছেন তাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছেন। জল যেমন যখন যে পাত্রে থাকে, তখন সেই পাত্রের আকার নেয়। ঠিক তেমনই জহরের এই যে কোনও চরিত্রে এঁটে যাওয়ার চেষ্টাটাই হয়তো তাঁকে বড় পরিচালকদের অন্য রকমের চিত্রনাট্যে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।
সত্যজিৎ রায় প্রথমে ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোট্ট রোল দিয়েছিলেন— তুলসী চক্কোত্তি অভিনীত পরেশ দত্তের চাকর ‘ব্রজহরি’। দশ বছর পরে হাল্লার মন্ত্রী। ঋত্বিক ঘটকও তাই। প্রথমে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে কনস্টেবলের এক চিলতে রোল। সাত বছর বাদে ‘সুবর্ণরেখা’র অনেকখানি জুড়ে ফাউন্ড্রি ওয়ার্কশপের ‘ফোরম্যান মুখুজ্জে’। নিয়েছিলেন ‘বগলার বঙ্গদর্শন’-এও, কিন্তু ছবিটা শেষপর্যন্ত হয়নি। শেষে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’য় যখন জহর গেঁয়ো মাতালের চরিত্র করছেন, তখন প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া জহর।
ভানু আর জহরকে দর্শক কমেডিয়ান হিসেবেই মনে রেখেছেন, একথা সত্যি। পর্দায় দর্শক ওঁদের দেখলেই হেসে লুটোপুটি খেতেন। আর পরিচালকরাও ভানু-জহরকে দু-একটা সিনে গুঁজে দিতেন। তাতে কমিক রিলিফও হতো, আবার ছবির গুরুত্বও বাড়ত। এই আক্ষেপ পরবর্তীকালে ভানুর লেখাতেও ধরা পড়েছে। তরুণ মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে জহর সম্পর্কে বলেছেন, ‘ওঁর গায়ে কমেডিয়ানের তকমা জুড়ে দেওয়া অনুচিত।’ ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘একটুকু বাসা’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘ঠগিনী’ ছবিতে জহরকে নিয়েছিলেন তিনি। ‘পলাতক’-এ জহরের অভিনয় নিয়ে এখনও উচ্ছ্বসিত তনুবাবু। তাঁর মতে, ‘এক কবিরাজ, কিন্তু অসম্ভব যাত্রাপাগল, সন্ধের পর রোগী দেখে না, শুধু রিহার্সাল করে। ওর মেয়ের বিয়ে হয় বাউন্ডুলে এক ছেলের সঙ্গে। এতে ওর ইন্ধন ছিল। বিয়ের রাতে সে উধাও। মেয়েটা চুপ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে জহরদা পিছন থেকে ঘরে ঢুকে পড়লেন কিছু একটা খোঁজার অছিলায়। বাবার অসহায় অবস্থা, তার অপরাধবোধ এত সুন্দর ফুটিয়ে তুললেন! এটাই আসল জহর রায়!’
খানিক নামডাক হওয়ার পরে ভানু ছোটখাট রোল নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জহরের বাছবিচার ছিল না জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। ভানু যেখানে আড়াইশো টাকা নিচ্ছেন রোজ, জহর নিচ্ছেন মোটে সত্তর। তা নিয়ে ভানুর কাছে বকুনিও খেয়েছেন। কত যে ছবি জহর করেছেন তার হিসেব নেই! অন্তত পৌনে তিনশো তো বটেই! ভানুর ছবির সংখ্যাও এর আশপাশেই। আর দু’জনে একযোগে করেছেন প্রায় ৮৩টি ছবি। দুই বন্ধুই এক বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। সরাসরি তাঁদের নামেই ছবি হয়েছে— ‘এ জহর সে জহর নয়’, ‘ভানু পেলো লটারী’ আর ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট’। মজার কথা, এর মধ্যে যেটিতে জহরের নাম নেই, সেটিও কিন্তু আদ্যন্ত জহরময়। এই সৌভাগ্য ‘একলব্য শিষ্য’ জহরের গুরু চ্যাপলিনেরও হয়নি, হয়নি লরেল-হার্ডিরও। ‘চাটুজ্যে-বাঁড়ুজ্যে’ ছবিতে ভানু-জহরকে দিয়ে লরেল-হার্ডির ঢঙে কমেডি করানোরও চেষ্টা হয়। তার জন্য হার্ডির ঢঙে গোঁফও ছেঁটেছিলেন জহর। ‘দেবর্ষি নারদের সংসার’ এবং ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবির মধ্যমণিও তিনিই।
‘পরশপাথর’ ছবিতে যখন ‘ব্রজহরি’র চরিত্র করছেন জহর রায়, ততদিনে বাংলা ছবিতে অন্তত দশ বছর হয়ে গিয়েছে তাঁর। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’,‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’...। পাশেই দাপটে অভিনয় করছেন তুলসী চক্রবর্তী, তুলসী লাহিড়ী, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদারেরা। তবু তার মধ্যেই নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন জহর এবং তাঁর দোসর ভানুও। একজনের আদরের ‘ভেনো’, অন্যজনের ‘জহুরে’।
বরং এই আদ্যপ্রান্ত হাসির বাইরে এমন কিছু কিছু চরিত্র জহর পেয়েছেন এবং করেছেন, যা তাঁকে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছে। কে ভুলবে ‘বাঘিনী’ ছবির শুরুতেই সেই চোলাই ঠেকের মালিককে? যে কিনা পুলিসের তাড়া খেয়ে পালায়, মা মরা মেয়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে, তার পর পায়ে পেরেক বিঁধে সেপটিক হয়ে মরে। আবার উৎপল দত্তের পুরোপুরি রাজনৈতিক ছবি ‘ঘুম ভাঙার গান’। সেই ছবিতে আবার কী অন্য পরতের অভিনয় তাঁর! সংলাপ বলার সঙ্গে সারা শরীরকে ব্যবহার করার অনন্যতাই ছিল জহরের অভিনয়ের বৈশিষ্ট। কোথাও কম, কোথাও বেশি—ঠিক যেখানে যেমনটা দরকার। এই বিষয়ে বিশ্বসেরা কমেডিয়ানদের সঙ্গে তাঁর অভিনয়রীতির মিল চোখে পড়ে।
কয়েকটা ছবিতে গানের লিপ দেওয়ার সঙ্গে জহরের অনবদ্য কমেডি অভিনয়ের কথা দর্শক কী করে ভুলবেন! ১৯৫৮ সালে ‘ভানু পেলো লটারি’ ছবিতে ‘ব্রহ্মা যখন দাঁড়িপাল্লায়...’, একই বছরের ‘সূর্যতোরণ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ওরা তোদের গায়ে মারবে লাথি চিরদিন...’, সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে কামু মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের সঙ্গে জহর রায় নিজেও গলা মিলিয়েছেন সেই কালজয়ী গানে— ‘আছো হেথা যত আমির ওমরা’ বা ১৯৭১ সালের ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে ‘মোসাহেব লাল’ জহরের লিপে অনুপ ঘোষালের গাওয়া ‘ছো ছো ছো ক্যায়া শরম কি বাত...’ সবকটা দৃশ্যেই জহরের শরীরী অভিনয় মনে রাখার মতো। গান ছাড়াও ‘ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট’ ছবির যে দৃশ্যে মঞ্চে নাচ হচ্ছে এবং জহর রায় সেই অবস্থায় মঞ্চে ঢুকে লিলি চক্রবর্তীকে খুঁজছেন নাচতে নাচতে। শারীরিক সক্ষমতার এহেন নিদর্শনই প্রমাণ দেয় তাঁর অভিনয়ের পরিমিতিবোধের। প্রমাণ হয়, তিনি হালকা চালের কোনও অভিনেতা নন, যথার্থ অর্থেই আন্তর্জাতিক মানের এক অভিনেতা।
(ক্রমশ)
‘এ জহর সে জহর নয়’ ছবির একটি দৃশ্যে সুপ্রিয়াদেবী ও জহর রায়
অলঙ্করণ: চন্দন পাল